ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

অভিজিৎ রায় হত্যার প্রধান সন্দেহভাজন

ফারাবী আটক

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ৩ মার্চ ২০১৫

ফারাবী আটক

স্টাফ রিপোর্টার॥ অবশেষে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী লেখক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ড. অভিজিৎ রায় হত্যার প্রধান সন্দেহভাজন শফিউর রহমান ফারাবীকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। আটক ফারাবী অভিজিৎ হত্যার আগে ফেসবুক পোস্টে লেখে ‘অভিজিৎ রায় আমেরিকা থাকে। তাকে এখন হত্যা করা সম্ভব নয়। তবে সে যখন দেশে আসবে, তখন তাকে হত্যা করা হবে।’ আর হত্যার পর ‘আনসার বাংলা সেভেন’ নামে একটি টুইটার এ্যাকাউন্ট থেকে একাধিক টুইট করে এ হত্যাকা-কে ‘বিজয়’ হিসেবে দাবি করা হয়। প্রথম টুইটটি করা হয় হামলার পরই রাত বারোটার দিকে। যাতে বলা হয়, ‘আল্লাহু আকবর.. বাংলাদেশে আজ একটি বিশাল সাফল্য এসেছে। টার্গেট ইজ ডাউন...।’ হত্যার আগে দেয়া হুমকির কথা স্বীকার করে সন্দেহভাজন প্রধান আসামি ফারাবী। র‌্যাবের দাবি অভিজিৎ হত্যাকা-ে ফারাবীর যোগসূত্র আছে। ফারাবী অবশ্য সরাসরি হত্যাকা-ে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে। যদিও ইতোপূর্বে ফারাবীর তথ্যমতেই বহুল আলোচিত ব্লগার ইঞ্জিনিয়ার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন হত্যায় জড়িত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ৫ সদস্যকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে ডিবি পুলিশ। সোমবার র‌্যাব সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে এমন তথ্যই জানালেন র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান। তিনি বলেন, অভিজিৎ রায়ের সঙ্গে ফেসবুকে ৫ বছর আগে যোগাযোগ হয় ফারাবীর। আদর্শগত মতপার্থক্যের কারণে ২ বছর আগে অভিজিৎ ফারাবীর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। তারপরও ফারাবী বিভিন্ন সময় অভিজিৎ রায়কে মেসেজ পাঠাত। বিভিন্ন সময় অভিজিৎ রায়কে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে আসছিল ফারাবী। তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের পরই হত্যা রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হবে। খুনীদের চিহ্নিত ও আটক করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। র‌্যাব জানায়, সোমবার ভোর ছয়টার দিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে ফারাবীকে আটক করে র‌্যাব-১০-এর একটি দল। গ্রেফতারকালে ফারাবী ঢাকা ছেড়ে যাত্রাবাড়ী হয়ে চট্টগ্রাম রওনা দিচ্ছিল। বিকেলে ফারাবীকে অভিজিৎ হত্যা মামলার তদন্ত সংস্থা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আজ ফারাবীকে ঢাকার সিএমএম আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ডের আবেদন করার কথা রয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও জানান, অভিজিৎ রায়কে হত্যার দুই ঘণ্টার মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে খুনের দায় স¦ীকার করে আনসার বাংলা সেভেন নামক একটি সংগঠন। এর প্রেক্ষিতে অভিজিতের ফেসবুক পর্যালোচনা করে দেখা যায় শফিউর রহমান ফারাবী নামে এক যুবক তাকে বিভিন্ন সময়ে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে আসছিল। এরই মধ্যে অভিজিতের বাবা দাবি করেন দেড় বছর ধরে ফেসবুকে তাঁর সন্তানকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল শফিউর রহমান ফারাবী। গত এক বছর আগের ফারাবীর ফেসবুক স্ট্যাটাসে দেখা যায় ফারাবী তার মান্নান রাহী নামক এক ফেসবুক ফ্রেন্ডকে বলে যে, ‘অভিজিৎ আমেরিকায় থাকে। তাকে এখন হত্যা করা সম্ভব নয়। তবে সে যখন দেশে আসবে তখনই তাকে হত্যা করা হবে।’ এ ছাড়াও সে তার অন্য এক ফেসবুক ফ্রেন্ডকে অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী ও কন্যাসহ একটি ছবি পোস্ট করে তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে লেখে যে, ‘এটাই হলো অভিজিৎ রায়, তার স্ত্রী বন্যা ও তাদের মেয়ের ছবি, এরা সবাই আমেরিকার লুসিয়ানা প্রদেশের নিউঅরলি সিটিতে থাকেন।’ এতে আরও বলা হয়. অভিজিৎ হত্যাকা-ের পর পরই ফারাবীকে তার এক ফেসবুক ফ্রেন্ড অভিজিতের রক্তাক্ত ছবি পাঠিয়ে বলে যে, ‘ছবি পাইছেন কি।’ উত্তরে ফারাবী ছবি পেয়েছে বলে জানায়। এরপর ওই ফেসবুক ফ্রেন্ড ফারাবীর অনুভূতি জানতে চাইলে সে বলে যে, ‘আমি গ্রেফতার হব কাল-পরশুর মধ্যে।’ এ সকল বিষয় পর্যালোচনায় ব্লগার শফিউর রহমান ফারাবী অভিজিৎ হত্যাকান্ডের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে র‌্যাব জানায়। মুফতি মাহমুদ খান আরও জানান, ২০০৫-’০৬ শিক্ষাবর্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়। কিন্তু পড়াশোনা শেষ করতে পারেনি। নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে ২০১০ সালে পুলিশের হাতে একবার গ্রেফতারও হয়েছিল। গ্রেফতারের এক মাস পর জামিনে ছাড়া পায়। জামিনে বের হয়ে আবার আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে একটি জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। সক্রিয় হয়ে উঠে অনলাইনে উগ্র মতাদর্শ প্রচারে। বেকার ফারাবীর অপতৎপরতা ক্রমেই সীমা অতিক্রম করে। বিশেষ করে মুক্তমনা ব্লগারদের সঙ্গে ধর্ম বিষয়ক আলোচনা নিয়ে বিতর্ক তৈরি করে। অনেককে প্রাণনাশের হুমকি দিতে থাকে। ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ব্লগার রাজীব হায়দার খুন হলে ২৪ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করা হয় ফারাবীকে। ঐ সময় সে অনলাইনে স্ট্যাটাস দিয়ে রাজীবের জানাজায় ইমামতি করার ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যার হুমকি দিয়েছিল। অভিজিৎতের হত্যাকা-টি সম্পূর্ণ সুপরিকল্পিত বিধায় হত্যাকারীরা কৌশলে বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে। এসব বিষয়া বিবেচনায় রেখেই র‌্যাব গোয়েন্দা দল নৃশংস হত্যাকা-ের মূল রহস্য উদ্ঘাটনে তৎপর হয়। তিনি আরও বলেন, গত ৩/৪ বছর ধরে ব্লগার হিসেবে ফারাবী বিভিন্ন ব্লগে ইসলামিক চিন্তা-চেতনা নিয়ে লেখালেখি করে বেশ পরিচিতি পায়। এরই মধ্যে তার মতাদর্শের বিপরীতে অবস্থানকারীদের সে নাস্তি¡ক হিসেবে বিবেচিত করত। এভাবেই তার সঙ্গে থাবা বাবা (ব্লগার রাজীব), আসিফ মহিউদ্দিন, অভিজিৎ রায়, তসলিমা নাসরিন, দাড়ি-পাল্লা ধমাধম, দিগম্বর-পয়গম্বর, সানতুনু মহাপাত্র, অগ্নিবীন, আল্লামা শয়তান (মশিউর রহমান), সানতুনু আদিম, প্যানগান দেবতা এবং হিন্দু যোদ্ধা নামক ব্লগারদের সঙ্গে তার ধর্ম নিয়ে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়, যা বিভিন্ন সময় তারা ফেসবুকসহ বিভিন্ন ব্লগে মন্তব্যের তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। এরই মধ্যে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রয়ারি থাবা বাবা ব্লগের ব্লগার রাজীব হায়দার মিরপুরে দুর্বৃত্তদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত হন। ফেসবুকে রাজীব হায়দারের সঙ্গে তার ব্লগে মন্তব্যের কড়া তর্ক-বিতর্কে প্রমাণ থাকায় এবং নিহত রাজীবের জানাজায় অংশগ্রহণরত ইমামকে খুনের হুমকি দেয়ার অপরাধে তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেফতার করে। এজন্য তাকে গ্রেফতারের পর তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা দিয়ে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে সে পুনরায় বেরিয়ে আসে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় ফারাবী স্বীকার করেছে-অভিজিৎ রায় ইসলামের বিরুদ্ধে যে লেখালেখি করতেন তা সে ৪/৫ বছর আগে ফেসবুকের মাধ্যমে সে জানতে পারে। এরপর থেকে সে অভিজিৎ ইসলামবিরোধী লেখার প্রতিবাদে মন্তব্য লিখে প্রতিবাদ জানাত। কে এই ফারাবী ॥ মোঃ শফিউর রহমান ফারাবী। বয়স আনুমানিক ২৯ বছর। পিতা মরহুম ফেরদৌসুর রহমান। ১৯৮৬ সালে ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার সদর থানাধীন বড়ভিলা কুমারশীল মোড় কালাইশ্রীপাড়া গ্রামে তার জন্ম। ১৯৯৬ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার রেলওয়ে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৫ম শ্রেণী, পিতার চাকরির সুবাদে ২০০১ সালে নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া জয়হরি স্কাই সরকারী উচচ বিদ্যালয় এবং ২০০৫ সালে ঢাকার নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে। মাঝে ২ বছর মানসিক সমস্যায় পড়ালেখা বন্ধ ছিল। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৫-২০০৬ সেশনে পদার্থ বিজ্ঞানে ভর্তি হয়। এখনও তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪র্থ বর্ষে অধ্যায়ন করছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সময় ২০১০ সালে কর্তৃপক্ষের বেতন বাড়ানোর প্রতিবাদে ছাত্র-ছাত্রীদের বিক্ষোভের ঘটনার মামলায় সর্বমোট ২৪ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে সে গ্রেফতার হয়। এক মাস জেলহাজতে থাকার পর জামিনে মুক্তি পায়। ফারাবী স্বীকার করে ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে আটটার দিকে সে নিজ বাসায় বসে কম্পিউটারে কাজ করছিল। ফেসবুক চ্যাট করছিল। রাত্র সাড়ে দশটায় তার ফেসবুক বন্ধু সিহাব, রানা চৌধুরী, মেজবাহ কমেন্টস করে টিভি দেখতে বলে। তখনই প্রথম জানতে পারে ব্লগার অভিজিৎ ও তার স্ত্রীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়েছে। এ সময় সে অনলাইন নিউজগুলো দেখতে থাকে। অভিজিতের নিহতের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়। ২/১ দিন পর পত্রিকায় অভিজিৎ হত্যাকা-ে তার সম্পৃক্তার কথা ছাপা হলে তার মা তাকে বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে বলেন। উল্লেখ্য, বইমেলায় বই প্রকাশ ও প্রকাশনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী অভিজিৎ রায়-রাফিদা আহমেদ বন্যা দম্পতি গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দেশে আসেন। বুয়েটের সাবেক শিক্ষক অভিজিৎ পেশায় প্রকৌশলী আর বন্যা চিকিৎসক। বইমেলায় বৃহস্পতিবার রাতে একটি প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে তাঁরা ফিরছিলেন। পথে টিএসসি মোড়ে রাত সাড়ে ৯টার দিকে সন্ত্রাসীদের হামলায় ঘটনাস্থলেই মারা যান অভিজিৎ। গুরুতর আহত হয়ে বর্তমানে স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বন্যা। প্রাথমিকভাবে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব ডিবি পুলিশকে প্রদান করা হয়। র‌্যাবও স্বপ্রণোদিত হয়ে হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করার জন্য তৎপর হয়।
×