
বাংলাদেশে আশঙ্কাজনকভাবে গরম বৃদ্ধি পেয়েছে। মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনই এর প্রধান কারণ। গত এক বছরে দেশের মানুষ ৯৪ দিন অস্বাভাবিক উচ্চ তাপমাত্রা সহ্য করেছে—যা স্বাভাবিকের চেয়ে ৪৪ দিন বেশি। শুক্রবার প্রকাশিত এক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করেছে ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন (ডব্লিউডব্লিউএ), ক্লাইমেট সেন্ট্রাল এবং রেড ক্রস রেড ক্রিসেন্ট ক্লাইমেট সেন্টার। এতে বলা হয়, মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪০০ কোটি মানুষ, অর্থাৎ বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যা, গত এক বছরে অতিরিক্ত ৩০ দিন বা তার বেশি সময় চরম গরমের মুখোমুখি হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি, যেখানে বড় ধরনের তাপপ্রবাহের ঘটনা জলবায়ু সংকটের কারণে বহু গুণ বেড়ে গেছে। ২০২৪ সালের ২০ থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত একটি তাপপ্রবাহ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ১১ গুণ বেশি ছিল, এবং ৩ থেকে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত আরেকটি তাপপ্রবাহ ছিল ৫ গুণ বেশি।
এই তথ্যগুলো এমন এক সময় প্রকাশ পেল, যখন আগামী ২ জুন বিশ্বব্যাপী পালিত হবে “হিট অ্যাকশন ডে”—যা মূলত একটি বৈশ্বিক সচেতনতা প্রচারাভিযান। এর লক্ষ্য হলো তাপাঘাত ও হিট স্ট্রোকের মতো স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় প্রস্তুতি বাড়ানো।
বিজ্ঞানীরা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশে চরম গরম বাড়িয়ে তুলছে এবং কোটি কোটি জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে ফেলছে। ঘনবসতিপূর্ণ শহর, বিপুল সংখ্যক খোলা জায়গায় কাজ করা শ্রমিকদের কারণে বাংলাদেশ বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। অতিরিক্ত তাপমাত্রা জনস্বাস্থ্যের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে, শ্রম উৎপাদনশীলতা হ্রাস করছে, ফসলের ক্ষতি করছে এবং দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত করছে।
ইমপেরিয়াল কলেজ লন্ডনের সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল পলিসির ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন গবেষক ড. মারিয়াম জাকারিয়া বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন এখন স্পষ্টভাবে প্রতিটি মহাদেশের জীবনযাত্রাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। গত এক বছরে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চার বিলিয়ন মানুষের জন্য বিপজ্জনক গরম এক মাস বেড়ে গেছে। এ সংখ্যাটি পৃথিবীর অর্ধেক জনসংখ্যা—এক কথায় ভয়াবহ।”
গবেষণায় ২৪৭টি দেশ ও অঞ্চলের গরমের প্রভাব বিশ্লেষণ করা হয়। এর মধ্যে ১৯৫টি দেশে চরম গরমের দিন দ্বিগুণ বেড়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। গত এক বছরে ঘটে যাওয়া ৬৭টি বড় তাপপ্রবাহের প্রতিটিই জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো ও গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ফলাফল।
বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর গড় তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদী সমাধান হলো কার্বন নির্গমন কমানো এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা হ্রাস করা।
ক্লাইমেট সেন্ট্রালের ড. ক্রিস্টিনা ডাল বলেন, “পৃথিবীর এমন কোনো জায়গা নেই, যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে মুক্ত। আর তাপ হচ্ছে এর সবচেয়ে প্রাণঘাতী ফল। আমাদের এখনই এই নতুন জলবায়ু বাস্তবতায় খাপ খাওয়াতে হবে এবং আরও খারাপ হওয়ার আগেই তা প্রতিরোধ করতে হবে।”
ডব্লিউডব্লিউএর সহ-প্রধান ও ইমপেরিয়াল কলেজ লন্ডনের জলবায়ু বিজ্ঞান বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ড. ফ্রিডেরিক অটো বলেন,
“প্রতি ব্যারেল তেল পোড়ানো মানে প্রতি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন এবং উষ্ণতার প্রতি ভগ্নাংশ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাপপ্রবাহ আরও বেশি মানুষকে আক্রান্ত করবে। ফলে এখনই জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যেতে হবে।”
রেড ক্রস রেড ক্রিসেন্ট ক্লাইমেট সেন্টারের শহর ও অ্যাট্রিবিউশন বিষয়ক প্রধান রূপ সিংহ বলেন, “আমাদের দ্রুত তাপপ্রবাহ মোকাবেলার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আরও উন্নত প্রারম্ভিক সতর্কতা ব্যবস্থা, হিট অ্যাকশন প্ল্যান এবং শহর এলাকায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে।”
সানজানা