ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

একাই একটি প্রতিষ্ঠান

 এস ডি সুব্রত

প্রকাশিত: ০১:০৬, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

একাই একটি প্রতিষ্ঠান

 এস ডি সুব্রত

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গবেষক, শ্রদ্ধেয় আকর্ষিত ব্যাক্তিত্ব, একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রখ্যাত ভাষাবিদ ড. আহমদ শরীফ। বাংলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতির অন্যতম নায়ক, বাহক আহমদ শরীফ চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার সুচক্রদ-ী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ১৯২১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি এবং মৃত্যুবরণ করেন ১৯৯৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। ড. আহমদ শরীফ ছিলেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাহিত্যঙ্গনের একজন প্রধান আলোচিত, সমালোচিত ও বিতর্কিত।

তার সমালোচনা হতো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কারণ তিনি কারও মন না যুগিয়ে অকপটে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতেন। তিনি ব্যক্তিগত স্বার্থের কথা ভাবতেন না, তিনি মানুষের কল্যাণের কথা ভাবতেন। প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের হাত থেকে সমাজকে প্রগতির পথে নিয়ে যেতে যে কয়েকজন হাতেগোনা মুক্তমনা মানুষ আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন আহমদ শরীফের নাম তাদের মধ্যে অন্যতম। সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্রান্তিকালে অবলীলায় অকপটে দেশ ও সমাজের পক্ষে নিজের মতো প্রকাশ করেছেন।
তার বাবার নাম আব্দুল আজিজ এবং মাতার নাম মিরাজ খাতুন। জীবনসঙ্গিনী ছিলেন সালেহা মাহমুদ। চট্টগ্রামে মুসলমানদের মধ্যে প্রথম এন্ট্রান্স পাস করা এবং বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ ছিলেন তার কাকা এবং একইসঙ্গে পিতৃপ্রতিম। জন্মের পর থেকেই আহমদ শরীফ আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদের কাছে পুত্র স্নেহে লালিত-পালিত হয়েছেন এবং এ সম্পর্ক বজায় ছিল শেষ পর্যন্ত।
আহমদ শরীফ ১৯৩৮ সালে পটিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পাস করেন। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ১৯৪০ সালে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৪২ সালে স্নাতক পাস করেন। ১৯৪৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে দ্বিতীয় বিভাগে চতুর্থ স্থান নিয়ে স্নাতকোত্তর পাস করেন। ১৯৬৭ সালে সৈয়দ সুলতান তার গ্রন্থাবলী তার যুগ শীর্ষক অভিসন্দর্বের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
আহমদ শরীফ তার জীবনের সিংহভাগ সময় ব্যয় করেছেন মধ্যযুগের সাহিত্য ও সামাজিক ইতিহাস রচনার কাজে যা ইতিহাসের অনন্য দলিল।
ড. আহমদ শরীফের গ্রন্থ সংখ্যা একশোরও বেশি। তার প্রথম সম্পাদিত গ্রন্থ ‘লায়লী মজনু’ ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হয়। তার মৌলিক গ্রন্থ ‘বিচিত চিন্তা’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালে। স্বদেশ চিন্তা, যুগ যন্ত্রণা, মধ্যযুগের সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ, বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য, জিজ্ঞাসা ও অন্বেষা, সংকট; জীবনে ও মননে তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
   জন্মসূত্রে মুসলমান হয়েও তিনি স্বঘোষিত নাস্তিক। স্বঘোষিত নাস্তিক বলে অনেকে তাকে মুরতাদ ঘোষণা করেন। ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সক্রিয়। তিনি উইলের মাধ্যমে মরণোত্তর চক্ষু ও মরণোত্তর চক্ষু দান করে গেছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য।
লাকসাম পশ্চিমগাও নওয়াব ফয়জুন্নেসা কলেজে বাংলার অধ্যাপকরূপে তার কর্মজীবন শুরু হয়। কিছু দিন তিনি রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা অফিসে কাজ করেন। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে গবেষণা সহকারী হিসেবে যোগদান করেন এবং পরে শিক্ষক হন। মধ্যযুগের কবি সৈয়দ সুলতানের উপর গবেষণা করে ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ পিএইচডি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকালীন জীবনে তিনি বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান,কলা পরিষদের ডিন, সিন্ডিকেট এ, শিক্ষক সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩ সালের ৩০ শেষ জুন অবসর গ্রহণ করেন। পরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছরের জন্য অধ্যাপক পদে সমাসীন ছিলেন।
বাংলা একাডেমির প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ষোলো শতকের কবি দৌলত উজির বাহরাম খার ‘লায়লী মজনু’ সম্পাদনা করেন আহমদ শরীফ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগেরও প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ তার সম্পাদিত ‘পুঁথি পরিচিত’। তিনি মধ্যযুগের চল্লিশোর্ধ কাব্যের পুঁথি সম্পাদনা করেছেন। যেমন- আলালের তোহফা (১৯৫৮), সিকান্দর নামা (১৯৭৭), মুসলিম কবির পদসাহিত্য (১৯৬১), বাঙালির সুফি সাহিত্য (১৯৬৯), বাউলতত্ত্ব (১৯৭৩) রসুল চরিত (১৯৭৮) ইত্যাদি।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রণয়নে অনবদ্যতা এখানে যে তিনি হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সকল বাঙালির সাধনাকেই অসাম্প্রদায়িক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি তে বিচার করেছেন। আহমদ শরীফ একদিকে যেমন ছিলেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক ও গবেষক অন্যদিকে ছিলেন দেশের বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ। চল্লিশের দশক থেকে শুরু করে আজীবন লিখেছেন। তিনি দেশ , সংস্কৃতি, ইতিহাস, দর্শন, নৃতত্ত্ব, ধর্ম, ভাষা, রাজনীতি, সমাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে অনেক লিখেছেন। তিনি সমাজ সচেতন একজন পর্যবেক্ষকও ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের ও বিশ্বের চলমান বিষয় নিয়ে নিরন্তর লিখেছেন। তিনি ছিলেন যুক্তিনিষ্ঠ বিজ্ঞান মনস্ক প্রগতিশীল লেখক।
গবেষণা, প্রবন্ধ ও চিন্তাশীল রচনার জন্য তিনি দাউদ সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, রাষ্ট্রীয় একূশে পদক ও কলকাতার রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডি লিট ডিগ্রি লাভ করেন।
অন্যায় ও গণবিরোধী কাজের জন্য তিনি যে কোনো সরকারের তীব্র সমালোচনা করতেন। দেশী-বিদেশী নানা ষড়যন্ত্র আর সাম্রাজ্য বাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন তুমি। ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, সেনাশাসন ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। তিনি সব সময় কঠোর ভাষায় কথা বলেছেন এবং কলম চালিয়েছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তিনি সরকার ও ধর্মান্ধদের রোষানলে পড়েছেন বারবার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এক সভায় ১৯৫৯ সালে ভাষা আন্দোলন ও স্মৃতি দিবস উপলক্ষে সর্ব সম্মতিক্রমে গৃহীত প্রস্তাবে শিক্ষা কমিশন কর্তৃক প্রস্তাবিত বাংলা ভাষার জন্য অবৈজ্ঞানিক রোমান হরফ প্রবর্তনের তীব্র বিরোধিতা করেন।
বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের পর অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকার সংক্ষেপে অপূর্ব সংসদই প্রথম লিখিত আকারে স্বাধীনতার প্রথম ইশতেহার প্রকাশ করেছিলেন যা ড. আহমদ শরীফ রচনা করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে বিচারপতি হাবিবুর রহমান বলেন যে ড. আহমদ শরীফ ইশতেহারে পূর্ব পাকিস্তানের নাম বাংলাদেশ এবং জাতীয় সংগীত হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের     ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি প্রস্তাব করেছিলেন। (আব্দুল আজিজ বাগমার রচিত স্বাধীনতার স্বপ্ন; অর্জন ও উন্মেষ)
 ১৯৭৩ সালে ২৩ শেষ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন আহমদ শরীফ সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ‘চরিত্রের অভাব ছাড়া বাংলাদেশে আর কোনো অভাব নেই।’ তিনি বলতেন আমাদের তিন শ্রেণির বুদ্ধিজীবী আছে। সরকার ঘেঁষা, সরকার ভীরু ও সরকারবিরোধী। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে বাংলাদেশ লেখক শিবিরের অষ্টম দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে র উদ্বোধন করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন চাটুকার ও তোষামোদকারীদের হাত থেকে বাঙালির আজন্ম লালিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে হবে। তিনি বলেন- সত্য ও অপ্রিয় কথা কাউকে না কাউকে বলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। জ্ঞানের সঙ্গে সাহসের, শক্তির সঙ্গে সদিচ্ছার সম্মিলন ঘটলে মানুষের অসাধ্য আর কিছুই থাকে না।
   ধর্মকে বাদ দিয়ে মানবতার কথা বলতে অনেক দিন পর্যন্ত কেউ এগিয়ে আসেননি। একজন এসেছিলেন হটাৎ পূর্ভাবাস ছাড়াই, যিনি একাই একটি সংগঠন, একটি প্রতিষ্ঠান, একটি আন্দোলন, একটি অধ্যায়, তিনি আহমদ শরীফ।
   শুধু মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী নয়, আধা বাঙালি আধা মুসলমান বুদ্ধিজীবী সমাজও এর জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। আহমদ শরীফ সাহস আর চিন্তার অপূর্ব সমন্বয়ে উপুর্যুপরি আঘাতে ল-ভ- করে দিয়ে গেছেন অজ্ঞতা ও মূর্খতার অন্ধকার প্রাচীর। তার লেখার শুরু থেকে মৃত্যু অবধি এই তা-ব থামেনি। চিন্তার এক নতুন গতিপথ, ভবিষ্যতের লড়াইয়ের নতুন হাতিয়ার নির্মাণ করে সৃষ্টি করে গেছেন ভবিষ্যতের এক দীপ্যমান রূপকল্প।
আহমদ শরীফ ছিলেন সফল কর্মময় জীবনের অধিকারী। তার লেখায় জ্ঞান গত দায়বদ্ধতা আমৃত্যু তাকে সক্রিয় রেখেছিল। তার বিশেষ গ্রন্থরাজির সঙ্গে আজও অনেকের পরিচিতি ঘটেনি তার ব্যক্তি সংঘটনের ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অসম্পৃক্ততার কারনে। অপঠিতই অনেক গ্রন্থ। তিনি আমাদের মাঝে নেই কিন্তু তার অসাধারণ সব গ্রন্থ আগামীর মুক্ত চিন্তা বিকাশে অসামান্য অবদান রাখবে নিঃসন্দেহে।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

×