ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু

অরবিন্দ মৃধা

প্রকাশিত: ০১:০৪, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু

রাজপথে প্রথম রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন শুরু করেন প্রতিবাদী, প্রগতিশীল কিছু ছাত্রনেতা

রাজপথে প্রথম রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন শুরু করেন প্রতিবাদী, প্রগতিশীল কিছু ছাত্রনেতা। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনের মাধ্যমে নেতৃত্বের সামনের কাতারে চলে আসেন তৎকালীন ছাত্র নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।
বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের শুরুতে বাঙালি জাতির আন্দোলনের সূত্রপাত।
দুটি ধাপে ভাষা আন্দোলন হয়। প্রথম ধাপ : ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। এই আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমান এ সমমনাগণ নেতৃত্ব দিয়ে ছাত্রদের সংগঠিত করেন।
দ্বিতীয় ধাপ : ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, এই আন্দোলন তাঁরই পরিকল্পনা ও নির্দেশিত পথে এগিয়ে চলে। বাংলা ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা নিয়ে এ অনুষঙ্গের আলোকপাত।
১৯৪৮ এ পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রথম ঢাকায় এলে তাঁকে ব্যাপকভাবে সংবর্ধনা জানানো হয়। তিনি রেসকোর্স মাঠ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য রাখেন, বঙ্গবন্ধু এ বিষয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘১৯ মার্চ জিন্নাহ ঢাকায় আসলে হাজার হাজার লোক তাঁকে অভিনন্দন জানাতে তেজগাঁ হাওয়াই জাহাজের আড্ডায় হাজির হয়েছিল। ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিল।...আমরা সকলেই ভিজে গিয়েছিলাম।

জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানে এসে ঘোড়দৌড় মাঠে বিরাট সভায় ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হবে।’ আমরা প্রায় চার পাঁচশত ছাত্র এক জায়গায় ছিলাম সেই সভায়। অনেকে হাত তুলে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিল, ‘মানি না’। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কনভোকেশনে বক্তৃতা করতে উঠে তিনি যখন আবার বললেন, ‘উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’ তখন ছাত্ররা তাঁর সামনেই বসে চিৎকার করে বলল, না-না-না। জিন্নাহ প্রায় পাঁচ মিনিট চুপ করে ছিলেন, তারপর বক্তৃতা করেছিলেন।’
জিন্নাহ সাহেব চলে যাওয়ার কয়েকদিন পর ফজলুল হক হলের সামনে এক সভায় ভাষা বিষয়ে বক্তব্য প্রদানকালে এক ছাত্র বলেছিলেন, জিন্নাহ যা বলেছেন আমাদের তাই মানতে হবে। শেখ মুজিব তার প্রতিবাদ করে বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘কোনো নেতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তার প্রতিবাদ করা এবং তাকে বুঝিয়ে বলার অধিকার জনগণের আছে।’ তিনি ঐ সভায় আরও বলেন, ‘বাংলা ভাষা শতকরা ছাপান্নজন লোকের মাতৃভাষা, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সংখ্যাগুরুদের দাবি মানতেই হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব।

তাতে যাই হোক না কেন আমরা প্রস্তুত আছি। সাধারণ ছাত্ররা আমাকে সমর্থন করল।’ এরপর ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জেলায় জেলায় গিয়ে তিনি প্রতিবাদ সভা সমাবেশ অব্যাহত রাখেন। 
আন্দোলন সংগ্রামের সপক্ষে মিছিল মিটিং প্রতিবাদ সমাবেশ করে ছাত্র জনতাকে উস্কে দেওয়ার অপরাধ খাড়া করে পুলিশ শেখ মুজিবকে ১৯৪৯ এর ডিসেম্বরে গ্রেফতার করে বিনা বিচারে সাজা দেওয়ার প্রতিবাদে তিনি নিজে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে আমরণ অনশনের ঘোষণা দিয়ে অনশন শুরু করলে পাকিস্তান সরকার তাঁকে এবং জনাব মহিউদ্দীন সাহেবকে ঢাকা কারাগার থেকে ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তর করে।
১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ থেকে এক টানা ১২ দিন তিনি আমরণ অনশন পালনকালে সরকার বাধ্য হয় তাঁকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে। ২৭ ফেব্রুয়ারি মুক্তি আদেশ পড়ে শুনানোর পর ফরিদপুর জেলে সহযোদ্ধা মহিউদ্দীন সাহেব ২ চামচ ডাবের পানি মুখে দিয়ে তাঁর অনশন ভঙ্গ করান। এই সময় তিনি এতো অসুস্থ হয়েছিলেন যে বাঁচার মতো আশা ছিল না। তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান অতিকষ্টে কয়েকদিন ধরে বাড়ি নিয়ে যান। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘পাঁচদিন পর বাড়ি পৌঁছালাম। মাকে তো বোঝানো কষ্টকর। ‘হাচু আমার গলা ধরে প্রথমেই বলল, ‘আব্বা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই।’
২১ ফেব্রুয়ারি ওরা ঢাকায় ছিল, যা শুনেছে তাই বলে চলেছে।...আমি খুব দুর্বল, বিছানায় শুয়ে পড়লাম।’ এই সময় দীর্ঘ কারাভোগের পর জাতির পিতার কাছে তাঁর মমতাময়ী রতœগর্ভা মা সায়েরা খাতুন প্রশ্ন করে বলেছিলেন, ‘বাবা তুইতো পাকিস্তান পাকিস্তান করে চিৎকার করেছিস, এদেশের মানুষ তো তোর কাছ থেকে পাকিস্তানের নাম শুনেছিলো। আজ তোকে সেই পাকিস্তানের জেলে কেন নেয়?... যে তোকে জেলে নেয়, আমাকে একবার নিয়ে চল, বলে আসব তাকে মুখের উপর।’ (কারাগারের রোজনামচা)
  ভাষার দাবিতে ১৯৫২ খ্রিঃ মে মাসে শেখ মুজিব একাই পাকিস্তান যান। পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহমুদুল হক ওসমানী এবং জেনারেল সেক্রেটারি শেখ মঞ্জুরুল হক দলবল নিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানান। তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ সতীর্থ রাজনীতিকগণের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষা আন্দোলন, নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার, নির্যাতন বিষয়গুলো তুলে ধরেন এবং কয়েকস্থানে সভা করেন ও প্রেস কনফারেন্স করে নির্যাতন বন্ধ এবং তদন্ত ও বিচারের দাবি জানান।

তিনি (তৎকালীন) প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলনে জেলে আটককৃত নেতা-কর্মীদের মুক্তির দাবি জানিয়ে বলেন, ‘আমি তাকে অনুরোধ করলাম, মাওলানা ভাসানী, শামসুল হক, আবুল হাশিম, মাওলানা তর্কবাগীশ, খয়বাত হোসেন, খান সাহেব, ওসমান আলীসহ সমস্ত কর্মীকে মুক্তি দিতে। আরও বললাম, জুডিশিয়াল ইনকোয়ারি বসাতে, কেন গুলি করে ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছিল।’ (অঃ আঃ পৃ- ২১৩)
সৎ, নির্ভীক, আত্মপ্রত্যয়ী সে দিনের ছাত্র নেতা শেখ মুজিবুর রহমানই একমাত্র ব্যক্তি যিনি বাংলা ভাষার জন্য ভাষা শহীদগণের হত্যার বিচার চাইলেন, হত্যাকারী পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান খাজা নাজিমুদ্দীনের মুখোমুখি হয়ে।
এই বিরল দৃষ্টান্ত এবং ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তাঁর কর্মকা- থেকে বুঝা যায় যে, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই ছিলেন রাষ্ট্রভাষা বাংলা আন্দোলনের অনন্যপুরোধা নেতৃত্বদানকারী নেতা। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে তাঁরই যোগ্য নেতৃত্বে ১৯৭১ এ বাঙালি জাতি হাজারো বছরের পরাজয়ের গ্লানি মুছে অর্জন করে আত্মসম্মান বোধের স্বাধীনতা।
শেখ মুজিব পাকিস্তান থেকে ফিরে ১৯৫২ এর জুন, জুলাই আগস্ট মাসজুড়ে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলায় গিয়ে সংগঠন মজবুত করার জন্য জেলায় জেলায় কমিটি গঠন করেন। পরে ঢাকায় ফিরে এসে পূর্ব পাকিস্তান শান্তি কমিটির মাধ্যমে চীনে যান।
  ১৯৫২ খ্রিঃ বঙ্গবন্ধুর চীন সফর এবং শান্তি সম্মেলনে বাংলায় ভাষণ।
১ অক্টোবর চীনের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সে দেশের সরকারের আমন্ত্রণে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে শান্তি সম্মেলনে যোগদানের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানসহ পাঁচজন মনোনীত হন। উক্ত সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বাংলায় ভাষণ দেন। এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য ‘পূর্ব পাকিস্তান থেকে আতাউর রহমান খান ও আমি বক্তব্য করলাম। আমি বাংলায় বক্তব্য করলাম। আতাউর রহমান ইংরেজী করে দিলেন।...১৯৪৯ সালে ১ অক্টোবর এরা (চীন) স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল।...এবার ১ অক্টোবর তৃতীয় স্বাধীনতা দিবস।...এগারো দিন সম্মেলন হয়।’

শান্তি কমিটি সফরকারিদের বিভিন্ন এলাকায় স্বাগত জানান এবং ঘুরিয়ে দেখান। তিনি ২৫ সেপ্টেম্বর চীনে যাত্রা শুরু করে সম্ভবত অক্টোবরের ১৬/১৭ তারিখে দেশে ফিরে আসেন। এই সম্মেলনে উল্লিখিত দুজন ছাড়া ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া), খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, উর্দু লেখক ইবনে হাসান এই পাঁচজন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে অংশগ্রহণে অনুমতি পান। এই সম্মেলনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় সাঁইত্রিশটা দেশ থেকে তিনশ’ আটাত্তর জন সদস্য যোগদান করেছিলেন।
 ১৯৫২তে মাতৃভাষা বাংলা রক্ষার দাবিতে বাঙালির সূর্য সন্তানগণ জীবন দিয়ে বিশ্বে যে নজীরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, সেই ভাষাতেই চীনের শান্তি সম্মেলনে ভাষণ দিয়ে সে দিনের তেজোদীপ্ত যুবক নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষার বার্তা বিশ্ব নেতাদের জানিয়ে দিলেন। এটিই বঙ্গবন্ধুর বহিঃবিশ্বে কোনো বৃহৎ পরিসরের সভায় বাংলা ভাষণ এবং কোনো বাঙালির প্রথম বাংলা ভাষণ।

১৯১৩ খ্রিঃ নোবেল প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে বিশ্ব কবির ‘গীতাঞ্জলি (ঝড়হম ড়ভভবৎরহম) বাংলাকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করেছে। বাংলা গানের পঞ্চভাস্কর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) অতুল প্রসাদ সেন (১৮৭১-১৯৩৪) রজনীকান্ত সেন যওঃ) দিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩) কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৮-১৯৭৬) অপ্রতিরোদ্ধ সৃষ্টি বাংলা ভাষাকে বিংশ শতাব্দীতে করে তুলেছিল জাজ্বল্যমান।’ সেই বিশ শতকে, যখন গুটিকয়েক ভিনভাষী শাসক রক্তচক্ষু দেখিয়ে বাংলাভাষাকে স্তব্ধ করার চেষ্টা করেছে তখনই বাঙালি জাতির কাণ্ডারী রূপে শেখ মুজিবুর রহমান পাবিারিক সুখ স্বাচ্ছন্দ্য উপেক্ষা করে, জেল জুলুম মাথায় ধারণ করে বাংলা ভাষার মিষ্টি মধুর কথা বাংলা ভাষণের মাধ্যমে নানা ভাষাভাষির মানুষের কানে পৌঁছে দিয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
 চীন সম্মেলন থেকে ঢাকায় ফিরে তিনি নেতা-কর্মীদের কারামুক্তির জন্য এবং সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য জেলা, মহাকুমায়, থানা ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে সাংগঠনিক কার্যক্রম দ্বারা আওয়ামী লীগের কর্মীবাহিনী গড়ে তোলেন এবং শাসনতন্ত্র তৈরি করতে জনমত সৃষ্টি করেন। এরই মধ্যে ১৯৫৪ খ্রিঃ সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করে।

তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘১৯৫৫ সালে নতুন কেন্দ্রীয় আইনসভায়- আওয়ামী লীগ ১২ (বারো) জন সদস্য নিয়ে ঢুকল এবং তাদের সংগ্রামের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা বাধ্য হলো ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে’। ‘আওয়ামী লীগ যখন ১৯৫৬ সালে ক্ষমতায় বসল তখন ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করল। ১৯৫৭-৫৮ সালে এই দিবসটা সরকারিভাবেও পালন করা হয়েছে।’
হাজারো বছরের তিতিক্ষিত বাঙালি, ভাষা আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে কঠিন বন্ধুরপথ অতিক্রম করে। আজকের বাংলাভাষা, সংস্কৃতি; বাংলাদেশ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আন্দোলন সংগ্রামে লাখো শহীদের আত্মত্যাগের ফসল।
 লেখক : প্রাবন্ধিক

×