ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জনকণ্ঠের পথচলা ও শিক্ষাসাগর

অধ্যাপক মো. ইকরামুল হক

প্রকাশিত: ০০:৫২, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

জনকণ্ঠের পথচলা ও শিক্ষাসাগর

১৯৯৩ সালের মহান ২১ ফেব্রুয়ারি ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’ পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয়

১৯৯৩ সালের মহান ২১ ফেব্রুয়ারি ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’ পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। সেই থেকে ৩০ পেরিয়ে ৩১ বছরের পথচলা। নানা বাধাবিপত্তি এবং চড়াই-উতরাই পার করে অনেক জ্ঞানী-গুণী মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে পত্রিকাটি আজ অব্দি গণমানুষের পত্রিকা হিসেবে সমাদৃত। পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রয়াত মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ স্যারের দুরদর্শী চিন্তার বহির্প্রকাশ হলো ‘শিক্ষাসাগর’ নামক পাতাটি। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের পত্রিকার পাঠক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার একটি পরিকল্পনাও ছিল।

মানুষ সারা জীবন যা কিছু শেখে তার মাত্র শতকরা ২০ ভাগ অর্জন করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার পুঁথিগত বিদ্যা থেকে। বাকি অংশটুকু অর্জিত হয় পাঠ্য বহির্ভূত পড়াশোনা এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশ হতে। এই পাঠ্য বহির্ভূত পড়াশোনার অর্থই হলো পত্রিকা/বই পড়া। এদেশের পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা সহায়ক হিসেবে ভূমিকা রাখার লক্ষ্যে ‘শিক্ষা সাগর’ পাতাটি চালু করা হয়। সে সময় সাধারণ শিক্ষার্থীরা নোট বা গাইড বই পড়তে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল।

শিক্ষাবিদদের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের নোট/গাইড বই থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা চলছিল জোরেশোরে। তখনই জনকণ্ঠ তাদের শিক্ষাসাগর পাতায় দেওয়া সমাধানগুলো প্রচলিত নোট বা গাইড বইয়ের চেয়ে কিছুটা ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে। ফলে শিক্ষার্থীদের কাছে এটা ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায়। অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রিন্ট মিডিয়ার জগতে পত্রিকাটি শীর্ষস্থান দখল করে যাতে ‘শিক্ষা সাগর’ পাতাটির ভূমিকা উল্লেখ করার মতো।

পত্রিকার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাঠদানে সহায়তা করার ধারণাটি এদেশে প্রথম জনকণ্ঠই সামনে নিয়ে আসে। বর্তমানে প্রায় সকল জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকায় শিক্ষা সহায়ক পাতাটি স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে।
আমার সুদীর্ঘ ৩৪ বছরের শিক্ষকতা এবং শিক্ষা প্রশাসনের অভিজ্ঞতা দিয়ে ‘শিক্ষা সাগর’ নামক পাতাটিকে প্রত্যক্ষভাবে দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য পত্রিকাটির বর্তমান সম্পাদকের নিকট কৃতজ্ঞতা রইল। করোনাকালে যখন সরাসরি শ্রেণি কক্ষে পাঠদান বন্ধ ছিল তখন আমরা ভেঙে পড়া শিক্ষা ব্যবস্থাকে চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করেছি শিক্ষা সাগরের মাধ্যমে। সফলতার হার না হয় পাঠকদের হাতেই ছেড়ে দিলাম।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হতে স্বনামধন্য শিক্ষকবৃন্দ যারা তাদের মেধা-প্রজ্ঞা দিয়ে পত্রিকার মাধ্যমে শিক্ষাদানের কাজটি করে গেছেন তারাও ধন্যবাদ পেতেই পারেন। যদিও পত্রিকার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানচর্চায় ভূমিকা রাখার বিষয়ে শিক্ষাবিদদের মধ্যে মতদ্বৈততা রয়েছে। তবে অধিকাংশ শিক্ষাবিদ এর পজেটিভ দিকই দেখেছেন। বিগত বছরগুলোতে ‘শিক্ষা সাগর’ পাতায় ‘প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি’ নামে একটি নিয়মিত কলাম প্রকাশিত হয়ে চলেছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস চাকরি প্রার্থীরা এ থেকে ব্যাপকভাবে উপকৃত হচ্ছেন।
২০২৩ সালে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় (প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে) ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ক্লাসগুলো হলো প্রথম, দ্বিতীয় এবং ষষ্ঠ, সপ্তম। শুধু পাঠ্যবই নয় মূল্যায়ন পদ্ধতিতেও এসেছে পরিবর্তন। চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। আমার বিশ্বাস আগামীতে আমাদের শিক্ষক/শিক্ষার্থীরা এই নতুন পদ্ধতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবে। তবে আমার মনে হয় পরিবর্তন আনার পূর্বে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের (বিশেষ করে শিক্ষকদের) কার্যকর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়নি/হয়নি।

তবে এ কথাও স্বীকার্য যে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এতো বিশাল সংখ্যক শিক্ষককে সরাসরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করাও চাট্টিখানি কথা নয়। এছাড়া নিজ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি ব্যয়বহুল ও শিক্ষকদের শেখানো খুবই কষ্টসাধ্য। বিশেষ করে খাতা-কলমে পরীক্ষা ব্যতীত মূল্যায়নের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালিয়ে যেতে হবে কারণ এর কোনো বিকল্প নেই।
যে সব কারণে শুরু থেকেই জনকণ্ঠ একটি আকর্ষণীয় সংবাদপত্র হয়ে উঠেছিল এর মধ্যে প্রধান কারণ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অন্য পত্রিকা আসার অনেক আগেই জনকণ্ঠ পৌঁছে যেত। আরও একটি অন্যতম কারণ ছিল লেখাপড়ার পাতাটি। তখন প্রায় সকল পাঠক পত্রিকাটি সংগ্রহ করতো। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মূল আকর্ষণ ছিল ‘শিক্ষাসাগর’ পাতাটি।

বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য বিষয়ভিত্তিক আলোচনা ছাড়াও এতে রয়েছে পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ বিষয়ে স্বনামধন্য শিক্ষাবিদদের পরামর্শ যা শিক্ষার্থীদের জন্য খুবই জরুরি। অন্যদিকে কোচিংবাণিজ্য বন্ধ করার জন্য সরকার নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে চলেছে। এই অবৈধ কোচিং বাণিজ্য যেন কমিয়ে আনা যায় সেজন্য শিক্ষাসাগর তার ভূমিকা রেখে চলেছে।

এ লক্ষ্যে উচ্চশিক্ষার জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীদের আবেদন করার পদ্ধতিসহ পরীক্ষা সম্পর্কিত যাবতীয়  পরামর্শ দিয়ে চলেছে। প্রশ্ন হতে পারে, পত্রিকার মাধ্যমে শিক্ষণ কার্যক্রম ফলপ্রসূ হয় কিনা? দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় শুধু শ্রেণিকার্যক্রম দ্বারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার সূচারুরূপে সম্পন্ন করা সম্ভবপর নয় তা নিশ্চিত অনুমিত। এর কারণ বহুবিধ।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, যোগ্য শিক্ষকের অভাব, প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অপ্রতুলতা, শিক্ষার্থীদের মেধার তারতম্য ইত্যাদি। ফলে যে শিক্ষার্থী শ্রেণি কক্ষের পাঠদান দ্বারা নিজকে তৈরি করতে পারে না তাকে বাইরের কারও সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা গৃহশিক্ষক, কোচিং সেন্টার বা বিদ্যালয় কোচিং ইত্যাদির ওপর নির্ভর হয়ে পড়ি। এছাড়াও তথাকথিত গোল্ডেন জিপিএ-৫ পাওয়ার প্রতিযোগিতার কারণে প্রায় সকল শিক্ষার্থী কোনো না কোনোভাবে প্রতিষ্ঠান বহির্ভূত শিক্ষা ব্যবস্থ্রা সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে।

এতে দরকার হয় অতিরিক্ত সময় ও অর্থ দুটোরই। ফলে অভিভাবকের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে যায়। এদের জন্য ‘শিক্ষাসাগর’ হতে পারে অন্যতম বিকল্প। আমার দৃঢ় বিশ্বাস জনকণ্ঠের শিক্ষাসাগর পাতাটি যদি নিয়মিতভাবে একজন শিক্ষার্থী বা চাকুরিপ্রার্থী ধারাবাহিকভাবে অনুসরণ করেন তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায় তিনি উপকৃত হবেন।
শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। বর্তমান সরকার এই অধিকার বাস্তবায়নের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠী কোনো না কোনোভাবে শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। এক্ষেত্রে সরকার, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক-কর্মচারী, শিক্ষা প্রশাসনসহ সবার সমন্বিত উদ্যোগই পারে কাক্সিক্ষত সাফল্য এনে দিতে। স্বল্প পরিসরে হলেও এক্ষেত্রে ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’ তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখে চলেছে। কোনো জাতি বা গোষ্ঠী কতটা উন্নত তা পরিমাপের একমাত্র একক হলো শিক্ষা। তাই আমরা সবাই শিক্ষার উন্নয়নে এগিয়ে আসবো এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : কো-অর্ডিনেটর, শিক্ষাসাগর পাতা

×