
আমাদের বাংলাদেশে নারীর অংশগ্রহণ সমৃদ্ধির বিভিন্ন খাতে আলো ছড়াচ্ছে
আমাদের বাংলাদেশে নারীর অংশগ্রহণ সমৃদ্ধির বিভিন্ন খাতে আলো ছড়াচ্ছে। সেখানে অর্থনীতি থেকে শুরু করে শিক্ষা-সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য খাতসহ নতুন ও আধুনিক বলয়ে অর্ধেক নারীদের যুগান্তকারী ভূমিকা গল্পকাহিনীকেও অতিক্রম করে যায়। শিক্ষার ক্ষেত্রে তো অনেকখানি। আর অর্থনীতিতে জোরালো অংশীদারিত্বে নারীরা কোনোভাবেই তার পুরুষ সহযোগীর তুলনায় নিজেদের খাটোও করছে না। উর্বর পলিমাটির দেশ আবহমান বাংলা আজ অবধি সুজলা, সুফলা, শস্য, শ্যামলা অঞ্চল হিসেবে চিরায়ত ঐতিহ্যে অম্লান। আর আধুনিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় ও নারীর দুরন্ত অভিগামিতায় দেশ আজ বিশ্বসীমায় অভিষিক্ত।
নিজেদের অদম্য সাহস, সমৃদ্ধ চেতনা আর অভাবনীয় নিষ্ঠায় যে মাত্রায় সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, সেটাও দেশের জন্য এক অনন্য যাত্রাপর্ব। শুধু দেশে বসেই যে তাদের দায়িত্ব সম্পাদন করছে তা কিন্তু নয় বরং প্রবাসী নারীরাও বিদেশে আয়-রোজগার করে দেশে যে মাত্রায় রেমিটেন্স পাঠায় সেটাও নাকি তার পুরুষ সহকর্মীর তুলনায় বেশি বই কম নয়। সবুজ মাঠের ক্ষেতে কৃষি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নারী কৃষি শ্রমিকের অনন্য ভূমিকা নজরকাড়া। শুধু ধান, গম এবং শাক-সবজির আবাদ নয় বরং মৎস্য চাষে গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত নারীদের নজরকাড়া অংশগ্রহণ মাছে-ভাতে বাঙালির প্রবাদবাক্য আজ অবধি স্বমহিমায় দ্যুতি ছড়াচ্ছে।
আর উদ্যোক্তার আসনে পুরুষ সহকর্মীকে ছাড়িয়ে নিজেদের সিংহভাগ আসন তৈরি করা বর্তমান সময়ের এক অবিস্মরণীয় অবদান। অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও শারীরিকভাবে নরম নারীরা এখন অবকাঠামো উন্নয়ন নির্মাণ শ্রমিকের ভূমিকায়ও অনবদ্য। তবে এমনসব মজুরি শ্রমে দৃষ্টিকটুভাবে যা উঠে আসে তা হলো তার পুরুষ সহকর্মীর তুলনায় শ্রম মজুরির তারতম্য। যা আন্তর্জাতিক শ্রম আইন অনুমোদনই করে না। আর নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণ নীতি সিডও সনদে উল্লেখ আছে বেতন-ভাতাতে নারীর প্রতি অসাম্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। নারী এগিয়ে যাচ্ছে সমান দক্ষতা ও সক্ষমতায়Ñ কিন্তু পাশাপাশি বিপর্যয়ও পিছু ছাড়ছে না। আধুনিক উন্নয়নশীল সমাজব্যবস্থায় নারীর সহনীয় আর্থ-সামাজিক বলয় নিশ্চিত করা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সচেতন দায়বদ্ধতা।
শুধু কি মজুরি শ্রমে বিভাজন? আরও কত বিভেদমূলক অব্যবস্থাপনা আর সহিংসতার আবর্তে পড়তে হচ্ছে সমসংখ্যক নারীদের তাও উন্নয়নের মাঝ পথে বিসদৃশ্যতার কালিমালিপ্ত। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ছাড়াও যৌতুকের দাবি মেটাতে গিয়ে সহিংস কোপানলই শুধু নয় বরং নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিচারিক কার্যক্রম মাঝপথে থেমে যাওয়া ছাড়াও সেখান থেকেও রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। তবে ২০২২ সালের একটি চমকপ্রদ ও অভিনব, আইনি কার্যক্রম লাঞ্ছিত নারীদের জন্য নতুন মাত্রা পাওয়া বিচার কার্যক্রমের অনন্য অবদান।
সময়ের দাবিতে, যুগের চাহিদায় আর আধুনিকতার নির্মাল্যে বিধিবদ্ধ কিছু কট্টর নিয়মনীতির রূপান্তর ঘটিয়ে আইনি ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করাও যেন পরিস্থিতির ন্যায্যতা। আগে কোনো মেয়ে যদি সম্ভ্রমহীনতার আবর্তে পড়ত সেখানে অত্যাচারী পুরুষের আগে নিপীড়িতা নারীর অতীত ইতিহাস বের করে তার চরিত্রের দুর্বলতা খোঁজার চেষ্টা করা হতো। সেটা একেবারে উপনিবেশিক ভারতের আমল থেকে চলে আসা এক বিধিবদ্ধ অব্যবস্থাপনা। সেই পুরাকালের ব্রিটিশ শাসিত ভারতের সাক্ষ্য আইনের সংশোধনী প্রস্তাব ইতোমধ্যে জাতীয় সংসদে পাস করা হয়েছে।
যা ভুক্তভোগীর জন্য বিশেষ জরুরিও ছিল। নিগৃহীত নারী শুধু যে সুবিচার পাবে তা কিন্তু নয় বরং সংশ্লিষ্টের মান, মর্যাদা ও সম্মান রাখতে নতুন কিছু বিধি ব্যবস্থাও যুক্ত করা হয়েছে অনন্য এই সংশোধনী আইনে। যা আইনি কর্মযোগের নবযাত্রা তো বটেই। ভুক্তভোগী নারীর সার্বিক কল্যাণ ও সুরক্ষায় অত্যাচারীকেই শাস্তি দেওয়ার বিধান রাখা হয়। নতুন এই সংশোধনী আইন পূর্ববর্তী ধারাকে বাতিলের পর্যায়েও নিয়ে যাবে। আশা করা হয়।
তবে সমসংখ্যক নারীদের অর্জন গাথাও সংশ্লিষ্টদেরকে উৎসাহ উদ্দীপনায় সিক্ত করছে। তেমন কয়েকটি যুগান্তকারী মাইলফলক কীর্তিমান বাঙালি নারী প্রদর্শন করে বিশ্ব সভায় নাম লিখিয়েছেন। প্রথমেই উল্লেখ করতে চাই গত বছরের সূচনালগ্নে বরিশালের নুসরাত জাহান নিজের নামটি লিখিয়ে নিলেন আন্তর্জাতিক বলয়ে। বরিশালের দক্ষিণ সাগরদি এলাকার বাসিন্দা নুসরাত জাহান। আব্দুর রশিদ ও মোসাম্মত পারভীনের একমাত্র কন্যা নুসরাত জাহান। দেশের সীমিত পরিসরকে অতিক্রম করে দুনিয়া জোড়া খ্যাতিমান হয়ে থাকল বঙ্গললনার এমন অনন্য কীর্তিময়তা।
‘৭১টি কয়েন দিয়ে সাজিয়ে মাত্র ১ মিনিটে ১ হাতে টাওয়ার বানানোয় তাক লাগিয়ে দিলেন বিশ্ববাসীকে’। শুধু কি তাই? আবার রেকর্ডও উত্তীর্ণ করেন অবলীলায়। তিনি ইউটিউবের মাধ্যমে এই কয়েন সাজানোর চর্চা করে নিজের আয়ত্তে আনতেও সময় লাগেনি। পরিশ্রমই সৌভাগ্যের চাবিকাঠি। এমন চিরায়ত প্রবাদ বাক্যকে নিয়ত চর্চা করে অনুশীলনে নিমগ্ন হয়ে যান কয়েন সাজানো শিল্পকর্মে। শেষ অবধি তিনি জিতলেনও। তবে নুসরাত বিবাহিতা। বিয়ের পরও মেয়েরা অসাধ্য সাধন করতে পারা এমন বার্তাও সকলের কাছে নিয়ে গেলেন।
সহযোগী শক্তির ভূমিকায় অবশ্যই পাশে ছিলেন স্বামী। সম্প্রতি বিবিসির ২০২২ সালের প্রভাবশালী নারীর তালিকায় সানজিদা ছোঁয়ার নাম উদ্দীপ্ত শিখায় জ্বলছে। চার ক্যাটাগরির এমন দুর্লভ পুরস্কারকে চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্টদের বিশ্ব সম্মানের অংশীদার করা হয়। আর ছোঁয়া পেয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এক অসম অভিশাপের বিরুদ্ধে লড়াকু ভূমিকা রাখার জন্য। বাল্যবিয়ে রোধ করায় তিনি বিশিষ্ট প্রভাবশালীর তালিকায় নিজেকে সম্মানের সঙ্গে তুলে ধরেন। বাংলাদেশের ময়মনসিংহের এক উদীয়মান তরুণী এই সানজিদা ছোঁয়া।
তিনি পেয়েছেন অধিপরামর্শ ও সক্রিয়তায় অবদান রাখার জন্য। যেখানেই বাল্যবিয়ের খবর পেতেন নিজের তৈরি করা সংগঠন ঘাস ফড়িংএর উদ্যোগে সেখানেই চলে যেতেন। শুধু বাল্যবিয়েই নয় যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন বন্ধেরও নিয়ামক ভূমিকা পালন করেন। সব মিলিয়ে ছোঁয়া বিশ্ব সভাকে ছুইয়ে ও মাতিয়ে দিলেন। আবারও স্মরণ করছি হাতেগোনা হলেও আমাদের বাংলাদেশের কিছু নারী তো বিশ্বের আসনে অভিষিক্ত হচ্ছে!
এবার উল্লেখ করতে চাই- ক্রীড়াঙ্গনে বাংলার লড়াকু নারীরা ‘সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ’ অপ্রতিরোধ্য জয় ছিনিয়ে আনাকে। অধিনায়ক সাবিনা খাতুন ও তার সতীর্থদের নজরকাড়া নৈপুণ্যে দেশকে বিজয় মুকুটে অভিষিক্ত করাও পরম প্রাপ্তি। অদম্য এক ইতিহাসের নির্মাতাই শুধু নয় সাহসিক ও নান্দনিক পারদর্শিতায় লাল সবুজের পতাকাকে রাঙিয়ে দেওয়াও অনন্য বিজয়ও কেতন। নিজ দেশের মাটি নয়, স্বাগতিকদের মাঠে যে বিজয় নিশান উড়িয়ে হিমালয়ের চূড়া স্পর্শ করলেন তাও এক দলবদ্ধ অভাবনীয় অভিযাত্রা। অধিনায়ক সাবিনাই সর্বোচ্চ গোলদাতার আসনটিও অলঙ্কৃত করলেন।
সবশেষে বাংলাদেশের অবকাঠামোর দুই বৃহৎ মাইলফলক উন্মোচনে সমসংখ্যক নারীদের অগ্রণী ভূমিকা ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকল। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিনেই দুই নারীর টোল গ্রহণ দেশের নারী যাত্রার ইতিহাসকে ভিন্নমাত্রা দিল। আবার বহুকাক্সিক্ষত মেট্রোরেল উদ্বোধনেও ছিল এক অনন্য চমক। আগেই সংবাদমাধ্যমের খবর হয়েছে ৬ জন নারীচালককে নিয়োগ করা। তাও আবার রীতিমতো প্রশিক্ষণ দিয়ে। সেখানে আশা করতে দ্বিধাহীন ছিলাম উদ্বোধনই যেন কোনো নারী চালকের হাত দিয়ে হয়। বাস্তব প্রেক্ষাপটে সেটাই দৃশ্যমান হলো। ইতিহাসের মাইলফলক হয়ে থাকলেন চালক মরিয়ম আফিজা। তিনিও অহঙ্কার ও গৌরবের এই অধ্যায়ের অংশীদারও বটে।
সম্প্রতি আরও এক অভাবনীয় মানব কল্যাণমূলক অবদান রেখে গেলেন সারাহ ইসলাম। আশৈশব এক মরণব্যাধিতে আক্রান্ত সারা জীবন ও মরণ যুদ্ধে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত না হয়ে যে নজির তৈরি করলেন তার মূল্য কোনো কিছুর বিনিময়ে হয়ই না। মৃত্যুর আগে নিজের দুই কিডনিও চোখের কর্নিয়া দান করে গেলেন অন্যজনের মঙ্গল কামনায়।
একজন মৃত্যু পথযাত্রী তরুণী অপেক্ষা করছেন জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়ার দুঃসহ যন্ত্রণা। সেখানে সারাহ ভাবছেন পৃথিবী ছাড়ার আগে অন্যের জন্য কিছু করা যায় কি-না। শেষ অবধি সেটাই করে গেলেন এই কল্যাণময় সারাহ। তার দুই কিডনি নিয়ে সুস্থ আছেন দুইজন নারী। মানবতাবোধের এমন দুর্লভ দৃষ্টান্ত আর কখনো কি দৃশ্যমান হবে?
লেখক : সম্পাদকীয় সহকারি, দৈনিক জনকণ্ঠ