
নির্বাচন সামনে রেখে চাঙ্গা বিএনপির নেতাকর্মীরা
লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সফল বৈঠকের ঢেউ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। রোজার আগে নির্বাচনসহ দেশের সংকট নিরসনে বিভিন্ন বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপির সমঝোতা হওয়ায় সবার মুখে মুখে দুই নেতার প্রশংসা। তাই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির নেতা-কর্মীরা এখন চাঙ্গা।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে যখন দেশের রাজনীতির আকাশে কালো মেঘ সে সময় শুক্রবার লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে কি সিদ্ধান্ত আসে তা নিয়ে ছিল রাজনৈতিক অঙ্গনসহ বিভিন্ন মহলে চরম আগ্রহ। বৈঠক থেকে কাক্সিক্ষত ফল আসে কি না তা নিয়ে কারও কারও মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত দুই নেতার মধ্যে বৈঠক সফল হওয়ায় সর্বস্তরের মানুষ দেশের ভবিষ্যত নিয়ে আশাবাদী হয়। এ বৈঠকে সবচেয়ে লাভবান হয় বিএনপি।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্র ক্ষমতা ছাড়ার প্রায় ১৯ বছর পর অনুকূল পরিবেশ ফিরে পায় বিএনপি। নির্বাচন হলেই বিএনপি ক্ষমতায় যাবে দলটির নেতা-কর্মীরা এমনটিই মনে করতে থাকেন। তবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলে আসছিলেন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপির জন্য সহজ হবে না।
তার মুখে এমন কথা শুনে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে কিছুটা আশঙ্কা বিরাজ করে। তবে দলীয় হাইকমান্ডের ধারণা ছিল, তাড়াতাড়ি নির্বাচন হলে এবং সে নির্বাচন সুষ্ঠু হলে বিএনপিই ক্ষমতায় যাবে। কিন্তু বিএনপি তাড়াতাড়ি নির্বাচন চাইলেও সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আশ্বাস না পেয়ে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে চরম হতাশার ছায়া নেমে আসে।
বিএনপির পক্ষ থেকে বারবার ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবি জানানো হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকেও বারবার জানানো হয়Ñ এ বছর ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। এ পরিস্থিতিতে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলোর নেতা-কর্মীরা মনোক্ষুন্ন হন। ঈদুল আজহার আগে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন জানান, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হতে পারে।
এতে ক্ষুব্ধ হয় বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তাদের মিত্র রাজনৈতিক দলগুলো। এ পরিস্থিতিতে লন্ডনে ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠক নিয়ে শুরু হয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে টানটান উত্তেজনা। তবে এ বৈঠকে নির্বাচনের সময়সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যখন ঐকমত্য হয় তখন দলটির নেতা-কর্মীদের মধ্যে দেখা দেয় খুশির জোয়ার।
সূত্র মতে, লন্ডনে দুই নেতার বৈঠকে রোজার আগে নির্বাচনের ব্যাপারে সমঝোতা হওয়ার পর সারাদেশে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। দল ও দেশের ভবিষ্যত নিয়ে তারা আশাবাদী হয়। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই দলীয় হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে সারাদেশের বিএনপি নেতা-কর্মীদের কাছে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি অগ্রসর করার নির্দেশ যায়। আর নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির কাজে সক্রিয় হয়।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান জনকণ্ঠকে জানান, বিএনপির দাবি ছিল নির্বাচন অনুকূল পরিবেশে অর্থাৎ রোজার আগে করা। কারণ, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার দশ মাস পরও নির্বাচন না হওয়ায় বিএনপির সর্বস্তরের নেতা-কর্মীসহ জনমনে হতাশা ছিল। তবে রোজার আগে নির্বাচন হওয়ার ঘোষণায় সবাই খুশি। আমরা আগে থেকেই নিজ নিজ সংসদীয় এলাকায় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে সক্রিয় ছিলাম। এখন নেতা-কর্মীরা আরও আগ্রহসহকারে প্রস্তুতির কাজ করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলা পর্যায়ে বিএনপির এক নেতা জনকণ্ঠকে বলেন, লন্ডনে ড. ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠক সফল হওয়ার পর পরই সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের মধ্যে খুশির বন্যা বয়ে যায়। সেই সঙ্গে কেন্দ্র থেকে নির্দেশ আসে নির্বাচনী প্রস্তুতি এগিয়ে নেওয়ার। এই নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি পাড়া-মহল্লা পর্যায়ে নির্বাচনী প্রস্তুতি এগিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়ে যায়। নির্বাচনের সময় যত এগিয়ে আসবে প্রস্তুতি ততই জোরদার করা হবে।
লন্ডনে ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠকের পর দেওয়া যৌথ বিবৃতিতে ২০২৬ সালে রোজা শুরুর এক সপ্তাহ আগে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে বলে আভাস দেওয়া হয়। যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়- অত্যন্ত সৌহার্দ্যমূলক পরিবেশে তাঁদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার কাছে আগামী বছরের রমজানের আগে নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রস্তাব করেন। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও মনে করেন, ওই সময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভালো হয়।
এ সময় প্রধান উপদেষ্টা আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা জানান। ড. ইউনূস বলেন, সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।
তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার এই অবস্থানকে স্বাগত জানান এবং দলের পক্ষ থেকে তাঁকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। প্রধান উপদেষ্টাও তারেক রহমানকে ফলপ্রসূ আলোচনার জন্য ধন্যবাদ জানান। এ খবর লন্ডন থেকে দেশে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির সর্বস্তরের নেতা-কর্মীসহ দেশের মানুষের মধ্যে খুশির বন্যা বয়ে যায়। দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিএনপি নেতা-কর্মীদের আনন্দ উল্লাস করতেও দেখা যায়।
এদিকে আগেই প্রতিটি সংসদীয় আসনের জন্য ৩ জন করে প্রার্থী ঠিক করে রেখেছেন বিএনপি হাইকমান্ড। তবে ৩০০ আসনের জন্য প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করবেন সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর। সে সময় সমমনা কিছু দলকে কিছু আসন ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টিও চূড়ান্ত করা হবে। ১৭ জুন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে শেষবারের মতো সংলাপে গিয়ে বিএনপি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দলীয় প্রস্তাব তুলে ধরবেন বলে সূত্র জানায়।
এ বছর ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বিএনপির বর্ধিত সভায় সারাদেশের সর্বস্তরের নেতাদের কাছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করার বার্তা দেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেই সঙ্গে তিনি বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন থেকে কেন্দ্র থেকে দলের যে কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে তা দলীয় নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থেকে সফল করতে হবে। এর পর থেকে কেন্দ্রের নির্দেশে কাজ করে যাচ্ছে সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা।
লন্ডন বৈঠকের পর নির্বাচনের সময় স্পষ্ট হওয়ায় এখন আবার নতুন করে সারাদেশের নেতা-কর্মীদের কেন্দ্র থেকে বার্তা পাঠানো হয়। এ বার্তা যাওয়ার পর নেতা-কর্মীরা নির্বাচনী প্রস্তুতির বিষয়ে আরও সক্রিয় হয়। বিশেষ করে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের দলীয় সম্ভাব্য প্রার্থীরা বিভিন্নভাবে গণসংযোগ কর্মসূচি জোরদার করতে শুরু করছেন বলে জানা যায়। গণসংযোগ বাড়িয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে কথাও বলছেন তারা।
সূত্র জানায়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে শীঘ্রই বিএনপি সারাদেশে সভা-সমাবেশসহ নির্বাচনকেন্দ্রিক বিভিন্ন কর্মসূচি পালন জোরদার করবে। আর এসব কর্মসূচি সফল করতে কেন্দ্রীয় সিনিয়র নেতারাও জেলা-উপজেলা সফর করবেন। এছাড়া প্রতিটি সংসদীয় আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীরাও মাঠে সক্রিয় থাকবেন। আর এ বিষয়টি বিভিন্ন মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করবেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
প্রায় ১৯ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকে রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করে এ পর্যন্ত এসেছে। বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলোর নেতা-কর্মীদের মতে, গত ৩টি জাতীয় নির্বাচনে দেশের সিংহভাগ মানুষ ভোট দিতে পারেনি। তাই অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ভোট হলে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলোকে দেশের মানুষ আগ্রহ নিয়ে ভোট দেবে।