
এক দশকের বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞার শিকলে আবদ্ধ থাকার পর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ফের নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেয়েছে। ২০০৮ সালে সাময়িক নিবন্ধনের পর জামায়াতের ধর্মভিত্তিক ও সংবিধানবিরোধী অবস্থান নিয়ে উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে দলটি। ২০১৩ সালে হাইকোর্ট দলটির নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে, যার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন ২০১৮ সালে তা বাতিল করে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের বিধান অনুযায়ী নিবন্ধন ছাড়া নির্বাচনে প্রতীক নিয়ে অংশ নেওয়ার সুযোগ না থাকায় কার্যত জামায়াত রাজনৈতিক ব্যবস্থার বাইরে চলে যায়।
তবে সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে এবং আপিল খারিজ হওয়ার পরও, সাম্প্রতিক সময়ে দলটির নিবন্ধন পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোড়ন তুলেছে।
জানা গেছে, ২০০৮ সালে জামায়াতে ইসলামীকে সাময়িক নিবন্ধন দেওয়ার পরের বছর বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির তৎকালীন মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মাওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন। রিটে জামায়াতের তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, নির্বাচন কমিশনসহ চারজনকে বিবাদী করা হয়। তারা জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের আর্জি জানান।
এ রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক (পরে প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি মো. আবদুল হাইয়ের হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি রুল জারি করেন। ছয় সপ্তাহের মধ্যে বিবাদীদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়। রুলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০ (বি) (১) (বি) (২) ও ৯০ (সি) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়।
জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে রুল জারির পর ওই বছরের ডিসেম্বরে একবার, ২০১০ সালের জুলাই ও নভেম্বরে দুবার এবং ২০১২ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে দুবার তাদের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়। এতে দলের নাম ‘জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ করাসহ বেশ কিছু সংশোধনী আনা হয়।
পরে ২০১৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি আবেদনকারীরা এ রুল শুনানির জন্য বেঞ্চ গঠনে প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করেন। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ৫ মার্চ আবেদনটি বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেনের নেতৃত্বাধীন দ্বৈত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠানো হয়। ১০ মার্চ সাংবিধানিক ও আইনের প্রশ্ন জড়িত থাকায় বৃহত্তর বেঞ্চে শুনানির প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে আবেদনটি প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠানোর আদেশ দেন দ্বৈত বেঞ্চ। ওইদিন প্রধান বিচারপতি তিন বিচারপতির সমন্বয়ে বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করে দেন।
২০১৩ সালের ১২ জুন ওই রুলের শুনানি শেষ হলে যেকোনো দিন রায় দেবেন বলে জানিয়ে অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন হাইকোর্টের বৃহত্তর (লার্জার) বেঞ্চ। পরে জামায়াতকে দেওয়া নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন ২০১৩ সালের ১ আগস্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে অবৈধ বলে রায় দেন বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল-হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তর (লার্জার) বেঞ্চ।
সে সময় সংক্ষিপ্ত রায়ে আদালত বলেন, এ নিবন্ধন দেওয়া আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত। একইসঙ্গে আদালত জামায়াতে ইসলামীকে আপিল করারও অনুমোদন দিয়ে দেন। তবে এ রায়ের স্থগিতাদেশ চেয়ে জামায়াতের করা আবেদন একই বছরের ৫ আগস্ট খারিজ করে দেন আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। পরে একই বছরের ২ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে জামায়াতে ইসলামী আপিল করে।
এরপর, ২০১৩ সালে হাইকোর্টের ওই রায়ের পর দশম সংসদ নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না। আবার বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের অংশ হিসেবে তারা ভোটও বর্জন করে। তবে সে সময় নিবন্ধনও বাতিলের কোনো কার্যক্রম শুরু করা হয়নি।
কিন্তু একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কেএম নূরুল হুদার কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। তৎকালীন ইসি সচিব মো. হেলালুদ্দীন আহমদের ২০১৮ সালের ২৮ অক্টোবর স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর দলটিকে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী নিবন্ধন দেওয়া হয়েছিল। দলটি নিবন্ধন নম্বর পেয়েছিল ১৪। কিন্তু একটি মামলার রায়ে হাইকোর্ট ২০১৩ সালে দলটির নিবন্ধন প্রক্রিয়া অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে। তাই নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করলো।
এরপর রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলেও ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর জামায়াতের পক্ষে কোনো আইনজীবী উপস্থিত না থাকায় আপিল বিভাগ আপিলটি খারিজ করে দেন।
তবে সময়ের পরিক্রমায় রাজনীতিতে নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন সরকার ওই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে। এরপরই আপিল বিভাগে জামায়াতের নিবন্ধন সংক্রান্ত মামলাটি পুনরায় চালু করার আবেদন জানানো হয় এবং আজকের রায়ে তা বৈধতা পায়।
রোববার (১ জুন) সকালে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বিষয়ে একটি আদেশ দেন। সর্বশেষ শুনানিতে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) আইনজীবী আদালতকে জানান, দলটির নিবন্ধন বিষয়ে ইসি এখনো সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের অপেক্ষায় রয়েছে।
এ সময় আদালতকে জানানো হয়, সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত অনুসারে ইতোমধ্যে ইসির প্রতীকের তালিকা থেকে জামায়াতের পূর্ববর্তী প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে দলটি যদি নিবন্ধন ফিরে পায়, তবে তাদের নতুন প্রতীক গ্রহণ করতে হবে।
তবে জামায়াতের আইনজীবী ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, ‘দাঁড়িপাল্লা প্রতীককে রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে—এমন কোনো রায় নেই।’ তাই দলটি পুনরায় সেই প্রতীক ব্যবহারের অধিকার রাখে বলে দাবি করেন তিনি।
সানজানা