ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১

ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে বেকারত্ব নিরসন

ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার

প্রকাশিত: ২০:৪৬, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে বেকারত্ব নিরসন

ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য জনপ্রিয় মার্কেটপ্লেস

এসব কাজে পুরুষদের আয় যেখানে ঘণ্টায় ২১.৫৭ পাউন্ড, সেখানে নারীদের আয় ২২.৪৩ পাউন্ড। তবে এসব বৈদেশিক অর্থ দেশে আনতে বাংলাদেশের সঙ্গে পেপ্যালের কোনো চুক্তি না থাকায় অতিরিক্ত কমিশন খরচসহ রয়েছে নানা ভোগান্তি। আবার প্রয়োজনীয় কারিগরি দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সারদের পারিশ্রমিকও কম

বিশ্বায়নের ফলে আজ ছোট্ট একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে পুরো বিশ্ব প্রযুক্তির কল্যাণে। ফ্রিল্যান্সিংয়ের মতো বৈদাশিক মুদ্রা আয় ও কর্মসংস্থান তৈরির নতুন উৎস খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষিত বেকার সমাজ। ঘরে বসেই হুন্দাই ও মার্সিডিজের মতো বিশ্বখ্যাত ব্যান্ডের গাড়ির থ্রি-ডি নকশা প্রস্তুত করছেন বাংলাদেশী ফ্রিল্যান্সাররা। জনপ্রিয় ইন্টারন্যাশনাল ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেস ফাইভারের তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও ভারতের পরেই সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশী ফ্রিল্যান্সারদের অবস্থান।

ফাইবার, ফ্রিল্যান্সিং ডটকম, আপওয়ার্ক ইত্যাদি হচ্ছে ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য জনপ্রিয় মার্কেটপ্লেস। এগুলোতে রয়েছে ডাটা এন্ট্রি, কনটেন্ট রাইটিং, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, এফিলিয়েট মার্কেটিং, এসইও, ওয়েব ডিজাইন, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক্স ডিজাইন ইত্যাদি ফ্রিল্যান্সিং কাজ। আইসিটি বিভাগের ২০২৩ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজারের অধিক ফ্রিল্যান্সার রয়েছে, যাদের মধ্যে ৫ লাখ ফ্রিল্যান্সার নিয়মিত কাজ করছে।

তাদের বার্ষিক আয় প্রায় ১০০ কোটি ডলার বা ১০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। সারাবিশ্বে ১৫৭ কোটি মানুষ ফ্রিল্যান্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে বিশ্বের টপ রেটেড ফ্রিল্যান্সারদের ৬৪ শতাংশই বাংলাদেশী। সংখ্যা বিবেচনায় বৈশ্বিক ফ্রিল্যান্সারের ২৪ শতাংশ নিয়ে ভারত শীর্ষে, ১৬ শতাংশ নিয়ে বাংলাদেশ দ্বিতীয় এবং ১২ শতাংশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় অবস্থানে আছে। তবে আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের অবস্থান অষ্টম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয়।
বেকারত্ব বাংলাদেশের জন্য একটি উদ্বেগজনক বিষয়। বিবিএসের তথ্য অনুসারে দেশে বর্তমানে প্রায় ২ কোটির বেশি তরুণ ও যুব সমাজ রয়েছে। যাদের মধ্যে শিক্ষিত বেকার আছে ২৫ লাখ। বেকারদের মধ্যে ১৬ লাখ ৭০ হাজার পুরুষ আর আট লাখ ৩০ হাজার নারী। মোট বেকারের ১২ শতাংশ উচ্চ শিক্ষিত। যাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, তাদের বেকারত্বের হার মাত্র ১.০৭ শতাংশ।

উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা বেকারের হার ৮.৭৮ শতাংশ এবং মাধ্যমিক উত্তীর্ণ বেকার ২.৪২ শতাংশ। বিআইডিএসের গবেষণার মতে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করা ৬৬ শতাংশই বেকার থাকছে। লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের হিসাবে, বাংলাদেশে ১০০জন স্নাতকের মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ এবং সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের সমীক্ষা মতে, বৈষম্য আর গুণগত শিক্ষার অভাবে ৭৮ শতাংশ তরুণ পড়াশোনা করে চাকরি পায় না। গরিব পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে এই হার ৯০ শতাংশ।
দেশে মোট জনশক্তির পরিমাণ কমবেশি ৭ কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজার। জনশক্তির এই অনুপাতে চাকরির বাজার খুবই সীমিত। সরকার নিশ্চয়ই ঘরে ঘরে চাকরি দিতে পারবে না। তবে ঘরে ঘরে ফ্রিল্যান্সার তৈরি করতে পারবে। তাই এই মুক্ত পেশাকে সঠিকভাবে পরিচর্যা করে কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনীতিকে খুব ভালো অবস্থানে পৌঁছানো সম্ভব। সেজন্য প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ এবং পৃষ্ঠপোষকতা।

বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে, এমনকি যেখানে ইন্টারনেট আছে, সেরকম উপজেলা পর্যায়েও অনেকে ব্যক্তি উদ্যোগে ফ্রিল্যান্সিং করছে। কিন্তু সেটা পুরোপুরি কাঠামোগতভাবে হচ্ছে না। এক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ফ্রিল্যান্সারদের আরও প্রশিক্ষণ ও যথার্থ তত্ত্বাবধায়ন করা দরকার। যাতে ফ্রিল্যান্সাররা ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসসহ বিভিন্ন জায়গায় কাজ করার সহজ ও নির্ভরযোগ্য পরিবেশ পায়।

ইতোমধ্যেই নিজ উদ্যোগে ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে দেশের লাখ লাখ তরুণ-তরুণী সামান্য আইসিটি প্রশিক্ষণ নিয়ে কর্মক্ষম হয়ে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করছে। চাকরির পেছনে সময় নষ্ট না করে ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়ে বেকারত্বের মতো ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করছে। দেশকে অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ করছে। কোনোরকম সরকারি পৃষ্ঠপোষক ছাড়া তারা ২০০৮ সালে প্রথম  ফ্রিল্যান্সিং যুগে প্রবেশ করে।

তখন মাত্র ৪ মিলিয়ন ইউএস ডলার অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল- যা এখন বেড়ে ৬০০ মিলিয়নে পৌঁছেছে (২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী)। ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ এ খাতে ২ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার আয় করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিদেশ থেকে অর্থ আনার প্ল্যাটফর্ম এবং যথোপযুক্ত পারিশ্রমিক নিশ্চিত হলে এ আয় আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
সময়টা এখন তথ্যপ্রযুক্তির এবং এর কল্যাণে বিশ্ব চলে এসেছে হাতের মুঠোয়। এখন ঘরে বসে যেমনি সারাবিশ্বের খোঁজ-খবর রাখা যায়, ঠিক তেমনি ঘরটাও হতে পারে ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য উপযুক্ত কর্মস্থল। এসব কাজে সরকারও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। নিয়েছে নানা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। দেশীয় ফ্রিল্যান্সারদের জন্য ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১০০% ট্যাক্স ফি, অফিস ভাড়া এবং ইউটিলিটি বিলের ৮০% ভ্যাট ফি মওকুফ, বিদেশী কর্মীদের জন্য প্রথম তিনবছরের জন্য ৫০% ট্যাক্স ফি মওকুফ করেছে সরকার।

২০২০ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার ফ্রিল্যান্সারকে স্মার্ট কার্ড দেওয়া হয়েছে ব্যাংক ঋণ সুবিধা পাওয়ার জন্য। এছাড়াও বিদেশী ৫৫টি স্বীকৃত প্ল্যাটফর্ম/অনলাইন মার্কেটপ্লেসে কাজ করে আয় করলে ৪ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এগুলো হলো- আপওয়ার্ক, ফাইভার, ফ্রিল্যান্সার ডটকম, গুরু, পিপল পার আওয়ার, টপটাল, ফ্লেক্সজব, ৯৯ ডিজাইনস, সিমপ্লি হায়ার্ড, অ্যাকুয়েন্ট, পাবলফট, ডিজাইনহিল, বার্ক, গোলেন্স, ফ্রিআপ, হাবস্টাফ ট্যালেন্ট, সলিড গিগস, উই ওয়ার্ক রিমোটলি, গিগস্টার, ড্রিববল, বিহেন্স, ক্লাউডপিপস, এনভাটো, হ্যাকারন, আমাজান মেকানিকাল টার্ক, শাটারস্টক, অ্যাডোবি স্টক, আই স্টক, ডিপোজিট ফটোসস, ১২৩ আরএফ, পন্ড৫, ড্রিমসটাইম, ক্রিয়েটিভ মার্কেট, ক্যানস্টকফটো, অ্যালামি, ইউনিটি অ্যাসেট স্টোর, স্কেচফ্যাব, ফ্রিপিক, অ্যাউইন, শেয়ারঅ্যাসেল, ফ্লেক্সঅফারস, ম্যাক্সবাউন্টি, ট্রেডডাবলার, সিজে অ্যাফিলিয়েট, ভিগলিংক, জেভিজু, রাকুটেন, ক্লিকব্যাংক, আমাজন অ্যাসোসিয়েটস, ওয়ালমার্ট অ্যাফিলিয়েট, গুগল অ্যাডসেন্স, ফেসবুক মনিটাইজেশন, ইউটিউব মনিটাইজেশন, অ্যাপস্টোর ও প্লেস্টোর।

এসব মার্কেটপ্লেসে লাখ লাখ বেকার তরুণ, এমনকি ঘরে বসে থাকা অল্প শিক্ষিত নারীরাও ফ্রিল্যান্সিং করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। বাংলাদেশে ২০১৪ সালে মাত্র ৯ শতাংশ নারী এ কাজ করত। বর্তমানে সাড়ে ৬ লাখ ফ্রিল্যান্সারের মধ্যে ১১ শতাংশ নারী (অর্থাৎ ৭১ হাজার ৫০০ জন)। এসব কাজে পুরুষদের আয় যেখানে ঘণ্টায় ২১.৫৭ পাউন্ড, সেখানে নারীদের আয় ২২.৪৩ পাউন্ড।

তবে এসব বৈদেশিক অর্থ দেশে আনতে বাংলাদেশের সঙ্গে পেপ্যালের কোনো চুক্তি না থাকায় অতিরিক্ত কমিশন খরচসহ রয়েছে নানা ভোগান্তি। আবার প্রয়োজনীয় কারিগরি দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সারদের পারিশ্রমিকও কম। বাংলাদেশী ফ্রিল্যান্সাররা সাধারণত গ্রাফিক্স ডিজাইন ও ওয়েব ডেভেলপমেন্টের মতো বিষয়ে বেশি প্রশিক্ষিত। এসব কাজে যেমন তুলনামূলক অর্থও কম, তেমনি প্রতিযোগী দেশগুলোর ফ্রিল্যান্সারদের মতো তারা দরকষাকষি করতে পারে না।

ভারতের একজন ফ্রিল্যান্সার যে কাজের ১১ ডলার দাবি করে, সেখানে বাংলাদেশীরা কাজটা  করছে  মাত্র ২-৩ ডলারে। অবশ্য স্নাতক ডিগ্রি, উচ্চমাধ্যমিক এবং এর কম শিক্ষাগত যোগ্যতার সম্পূর্ণ বাংলাদেশী ফ্রিল্যান্সারদের আয় ঘণ্টাপ্রতি যথাক্রমে ২০ ডলার, ১৬ ডলার এবং দুই ডলার হয়ে থাকে।
যেহেতু ফ্রিল্যান্সিংয়ে বাংলাদেশের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। সরকার আরও পৃষ্ঠপোষক, বিনিয়োগ এবং প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিলে এই সেক্টরে শিক্ষিত বেকার তরুণদের এমনকি নারীদেরও অংশগ্রহণ আরও বাড়বে। সফল ফ্রিল্যান্সারদের ভিআইপি সুবিধা (বিমান ও ট্রেনে যাতায়াত সুবিধা, অসুস্থতায় চিকিৎসার সুযোগ এবং বৃদ্ধ বয়সে বিশেষ ভাতা ইত্যাদি), জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত করা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসে বিশেষ সম্মান দেওয়া দেওয়া যেতে পারে।

যেহেতু ঘরে বসেই ফ্রিল্যান্সিং করা যায়, তাই এই পেশাকে শহর থেকে বেরিয়ে গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো (দ্রুতগতির ইন্টারনেট এবং স্বল্পমূল্যে উন্নত মানের ল্যাপটপ) বৃদ্ধিতে সরকারের দৃষ্টি দেওয়া উচিত। তাতে গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা ফ্রিল্যান্সিংয়ে যেমন অনুপ্রাণিত হবে, তেমনি নব উদ্যমে তাদের এই অংশগ্রহণে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে দেশ মুক্তি পাবে।

পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিংয়ে বিদ্যমান সমস্যাগুলো যেমন- গুণগত প্রশিক্ষণ, পেমেন্ট সিস্টেম সহজীকরণ, ইন্টারনেট ও বিদ্যুৎ বিভ্রাট দূরীকরণ, ফ্রিল্যান্সিং কাজ ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার নামে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎকারীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ নিশ্চিত করতে পারলে ফ্রিল্যান্সিং সেক্টর হতে পারে দেশের সবচেয়ে বড় রেমিটেন্স আয়ের খাত। সৃষ্টি হতে পারে লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থানের মাধ্যম।

বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই যাত্রাকে আরও ত্বরান্বিত করবে দেশের লাখ লাখ তরুণ সমাজ ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে বেকারত্ব রোধ করে।

লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

×