ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ জুন ২০২৫, ১ আষাঢ় ১৪৩২

বিশ্বের বৃহত্তম কয়লার মজুত

ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশিত: ২১:০৫, ২১ মে ২০২৩

বিশ্বের বৃহত্তম কয়লার মজুত

ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম

বিশ্বে কয়লার সবচেয়ে বড় খনি ধরা হয় যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াইয়োমিংয়ের নর্থ অ্যান্টিলোপ রোশেল কোল মাইনকে। মাইনিং টেকনোলজির তথ্য অনুযায়ী, এখানে কয়লার উত্তোলনযোগ্য মজুত ১৭০ কোটি টন। বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ কয়লার সবচেয়ে বড় মজুতটি অবস্থিত জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে। ছয় দশক আগে এখানে জরিপ ও অনুসন্ধান চালিয়েছিল জাতিসংঘ ও তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের খনিজ সম্পদ বিশেষজ্ঞ দল। সেই সময়ের জরিপের ভিত্তিতে অনুমান করা হয়, এখানে কয়লার মোট মজুত রয়েছে ১০৫ কোটি ৩০ লাখ টন। এরপর ২০১৫ সালে খনিটিতে কয়লা খনির গ্যাস বা কোল বেড মিথেন অনুসন্ধানে ভারতীয় এক প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয় পেট্রোবাংলা।

মাইনিং অ্যাসোসিয়েট প্রাইভেট লিমিটেড (এমএপিএল) নামে ওই প্রতিষ্ঠানের পরের বছর প্রকাশিত জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, জামালগঞ্জে কয়লার প্রকৃত মজুত আগের হিসাবের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি হতে পারে, যার সম্ভাব্য মোট পরিমাণ ৫৫০ কোটি টন। এর মধ্যে কতটুকু উত্তোলনযোগ্য তা এখনো নিরূপণ করা যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর এক-দশমাংশও (৫৫ কোটি টন) যদি উত্তোলন করা যায়, তাহলেও খনিটি উত্তোলনযোগ্য কয়লার মজুতের দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষ ১০ খনির তালিকায় উঠে আসবে। এ তালিকায় বর্তমানে নবম ও দশম স্থানে রয়েছে যথাক্রমে অস্ট্রেলিয়ার গুনিয়েলা রিভারসাইড ও সারাজি খনি। এ দুই খনিতে উত্তোলনযোগ্য কয়লার মজুত যথাক্রমে ৫৪ কোটি ৯০ লাখ টন ও ৫০ কোটি ২ লাখ টন।
দেশের কয়লাভিত্তিক বড় দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন নিয়ে আবারও টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। সময়মতো ডলার না পাওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে কয়লা আমদানি। কয়লার অভাবে দুই সপ্তাহ ধরে বন্ধ হয়ে আছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন। ডলার না পেলে উৎপাদন বন্ধ হতে পারে দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রায়ও। আর এতে আরও বাড়তে পারে লোডশেডিং। গত ডিসেম্বরে একটি ইউনিট উৎপাদনে আসার পর এ পর্যন্ত কয়েক দফায় বন্ধ হয়েছে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ মালিকানায় নির্মিত বাগেরহাটের রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। গত ১৫ এপ্রিল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ হয়ে যায়। এরপর চারদিন পর এটি আবার চালু হয়। কিন্তু কয়লার অভাবে ২৪ এপ্রিল থেকে এটি আবার বন্ধ হয়ে যায়। নতুন করে আমদানি করা কয়লার জাহাজ চলতি সপ্তাহে চট্টগ্রামে পৌঁছেছে।

বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া পার্টনারশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফপিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাঈদ একরাম উল্লাহ বলেন, ডলার-সংকটের কারণে কয়লা আমদানি নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছিল। কয়লার জাহাজ চলে এসেছে। দুই দিনের মধ্যে উৎপাদন শুরু হবে। মজুত কয়লা দিয়ে এ মাস হয়ত কোনোরকমে চালানো যাবে। এর মধ্যে ডলার না পেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে আবারও। চুক্তির প্রায় ১০ বছর পর গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করে কেন্দ্রটি। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র বলছে, দেশে তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কম চালানো হচ্ছে। আবার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও পুরোদমে চালানো যাচ্ছে না। এর মধ্যে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়। ঘূর্ণিঝড় মোখা সৃষ্টি করেছে নতুন সঙ্কট। 
এখন ঢাকাসহ দেশের অনেক এলাকায় প্রতিদিন গড়ে এক ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং করতে হচ্ছে। যে কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর আগে পিডিবিকে জানাতে হয়। এরপর বিদ্যুৎ উৎপাদন সূচির সঙ্গে তা সমন্বয় করে পিডিবি। পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) এস এম ওয়াজেদ আলী সরদার বলেন, কয়েক দিনের মধ্যের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হবে। তবে কবে থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হবে, তা এখনো চূড়ান্ত নয়। দেশে বর্তমানে পাঁচটি খনিতে ৭ হাজার ৮০৩ মিলিয়ন টন কয়লার মজুত রয়েছে বলে জানিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। যে কটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রয়েছে বা নির্মাণাধীন রয়েছে, সেগুলোর দীর্ঘ সময়ের জ্বালানি হিসেবে এই মজুত কয়লা ব্যবহার করা যায়। অথচ এসব কয়লা উত্তোলনে সরকারের তেমন আগ্রহ নেই। যত আগ্রহ আমদানিতে।

জানা গেছে, বিশাল মজুত সত্ত্বেও এ পর্যন্ত দিনাজপুরের পার্বতীপুরে অবস্থিত বড়পুকুরিয়া ছাড়া অন্য কোনো খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করেনি সরকার। এ খনিটি ১৯৮৫ সালের আবিষ্কার হয়। সেখানে প্রায় ৩৯০ মিলিয়ন টন কয়লার মজুত রয়েছে। ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বাণিজ্যিকভাবে বড়পুকুরিয়া খনি থেকে কয়লা উত্তোলন শুরু হয়। তাও সেটা খনির পাশেই স্থাপিত কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। অর্থাৎ, চাহিদার অর্ধেক কয়লাও খনি থেকে উত্তোলন করতে পারছে না বড়পুকুরিয়া কর্তৃপক্ষ। জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বড়পুকুরিয়া খনির সেন্ট্রাল বেসিন থেকে প্রতিবছর গড়ে ০.৮ লাখ টন কয়লা উত্তোলন হচ্ছে।

যা বড়পুকুরিয়ার ৬২৫ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাহিদার তুলনায় খুব কম। এরই মধ্যে পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে। এই কেন্দ্রের প্রয়োজনীয় সব কয়লা ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা হচ্ছে। এ ছাড়াও দিনাজপুরের নবাবগঞ্জে ১৯৯৫ সালের দীঘিপাড়া কয়লা খনি আবিষ্কৃৃত হয়েছে। জ্বালানি বিভাগের তথ্য বলছে, এই খনিতে প্রায় ৭০৬ মিলিয়ন টন কয়লা মজুত রয়েছে। ১৯৯৭ সালে আবিষ্কৃত হয় দিনাজপুরের ফুলবাড়ি কয়লা খনি। এই খনিতে মজুত কয়লার পরিমাণ ৫৭২ মিলিয়ন টন। রংপুরের পীরগঞ্জের খালাসপীর এলাকায় ১৯৮৯ সালে আরেকটি কয়লা খনি আবিষ্কার হয়। এখানে ৬৮৫ মিলিয়ন টন কয়লার মজুত রয়েছে। জয়পুরহাটে ১৯৬২ সালে জামালগঞ্জে কয়লার আবিষ্কার হয়। 
জামালগঞ্জ খনিতে ৫ হাজার ৪৫০ মিলিয়ন টন কয়লা মজুত রয়েছে। 
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বড়পুকুরিয়া খনির সেন্ট্রাল বেসিন থেকে কয়লা উত্তোলনে একটি জরিপ করা হয়েছে। জরিপ অনুযায়ী, শুধু বড়পুকুরিয়া থেকেই বছরে প্রায় ১০ টন করে প্রায় ৩০ বছর ১৭০ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা যেতে পারে। দীঘিপাড়া কয়লা ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ একটি স্টাডি করে যে তথ্য পেয়েছে, তাদের মজুত ৭০৬ মিলিয়ন টন কয়লা থেকে বার্ষিক তিন মিলিয়ন টন হারে প্রায় ৩০ বছরে ৯০ টন উত্তোলন করা যাবে। জামালগঞ্জ খনি থেকে প্রায় ৫ হাজার ৪৫০ মিলিয়ন টন এবং খালাসপীর ক্ষেত্র থেকে প্রায় ৬৮৫ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব। অথচ কয়লানীতি হলো না এখনো। ২০০৪ সালে কয়লা নীতি প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। ১৬ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও চূড়ান্ত হয়নি কয়লা নীতি।

২০১৪ সালে (প্রথম দফায়) বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে নসরুল হামিদ বলেছিলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে কয়লা নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। সেই ঘোষণার পর আর এ পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো খবর নেই। কয়লা নীতিকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছিলেন প্রতিমন্ত্রী দায়িত্ব নেওয়ার পর। তিনি ২০১৪ সালে ২ ফেব্রুয়ারি পেট্রোবাংলা পরিদর্শনের সময় বলেছিলেন, দেশ, জনগণ ও পরিবেশের বিষয়টি বিবেচনা করেই সুষ্ঠু কয়লা নীতি প্রণয়ন করা হবে। কয়লা নীতি যত দ্রুত প্রণয়ন করা হবে, ততই দেশের মঙ্গল।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক-বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি.

×