মানুষ স্বভবতই সামাজিক জীব
বিশ্ববিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল বলেছেন, ‘মানুষ স্বভবতই সামাজিক জীব। যে সমাজে বাস করে না সে হয় পশু না হয় দেবতা।’ মানুষ ও সমাজের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। তবে সমাজব্যবস্থা শুধু মানুষের মধ্যে বিরাজমান তা নয়, আমরা একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখতে পাই যে ক্ষুদ্র পিপীলিকা থেকে শুরু“করে সকল প্রাণীকুলের মাঝেই এই সমাজব্যবস্থা বিদ্যমান।
যখন কোন কাকের মৃত্যু হয়, তখন মৃত কাকের আশপাশে শতাধিক কাক এসে কা কা শব্দে সংশ্লিষ্ট এলাকা কাঁপিয়ে তোলে। এতে এটাই প্রতীয়মান হয়, জীবজন্তুরাও মানুষের মতোই নিজ নিজ জ্ঞাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে সমাজবদ্ধ হয়ে চলাফেরা করে। তাহলে তাদের সঙ্গে মানুষের পার্থক্য কোথায়? পার্থক্য হলো- মানুষের আছে বিবেক বিবেচনাবোধ যা অন্য প্রাণীর মধ্যে নেই। এই বিবেকের কারণেই মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। এই শ্রেষ্ঠ জীবের প্রতি দায়িত্ব বর্তায় সকল সৃষ্টিকুলকে ভাল রাখা।
তাই মানুষ সুন্দর পৃথিবী বিনির্মাণে ও নানামুখী উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে প্রকৃতির রাজ্য থেকে বেরিয়ে সংঘবদ্ধভাবে বসবাস করার তাগিদ অনুভব করে এবং সমাজ গঠন করে। সমাজে যেহেতু একই সঙ্গে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, পেশা ও শ্রেণীর লোক একত্রে বসবাস করে সেহেতু সমাজের গরিব, অসহায় ও দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের সবার কর্তব্য। কিন্তু এ দায়িত্ব কর্তব্যের কথা আমরা প্রায়শই ভুলে যাই নিজেদের ভোগ বিলাস ও ঐশ্বর্যে মেতে থাকার কারণে। আমদের উচিত নিজেদের ভোগ-বিলাসের সামান্য অংশ সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেয়া।
যারা মানবকল্যণে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন তারাই পৃথিবীতে স্মরণীয় ও বরণীয়। জাতির কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ কখনও মরে না। স্মরণের আবরণে তাদের মৃত্যু ঢাকা পড়ে। জগদ্বিখ্যাত নীতি দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল এর বিখ্যাত উক্তি ‘ম্যাক্সিমাম হ্যাপিনেস ফর ম্যাক্সিমাম পিপল’ এর অর্থ হলো- সমাজের অধিকাংশ মানুষের অধিক পরিমাণ সুখ আনয়নের জন্য নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দেয়া। শুধু তাই নয় প্রতিটি ধর্মেই মানবসেবার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) বলেছেন- ‘মানুষের মধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠ যিনি অন্যের উপকার করেছেন।’
মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব। আর তাই তো স্বামী বিবেকানন্দের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে- ‘জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।’ সত্যিই নিজের স্বার্থের জন্যই কেবল জীবন নয়। পরার্থে জীবন উৎসর্গ করার মাধ্যমেই মানবজীবন সার্থকতায় ভাস্বর হয়ে উঠে। শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলে সমাজের কোন পরিবর্তন আসবে না। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের দিকে। ভাবতে হবে চারপাশের মানুষগুলো কেমন আছে ? কিন্তু বিজ্ঞানের এই যুগে ক্রমেই আমরা যান্ত্রিক এবং আত্মকেন্দ্রিক হয়ে হয়ে যাচ্ছি।
মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ, সহমর্মিতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ কমে যাচ্ছে, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। এতে সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সামাজিক মূল্যবোধই পারে সমাজের রূপ বদলে দিতে। মোটকথা, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে একে অপরের সুখ-দুঃখের অংশীদার হওয়া এবং সাধ্যমতো সাহায্য-সহযোগিতা করার মানসিকতাই হোক আমাদের আগামী দিনের মূলমন্ত্র।
মেলান্দহ, জামালপুর থেকে