
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন সব শ্রেণির চাকরিকে ‘অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সেইসঙ্গে কাজে না ফিরলে আন্দোলনকারীদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে।
রবিবার বিকেলে সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে সরকারের এই কঠোর অবস্থানের কথা জানানো হয়। এর আগে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে বিষয়টি আলোচনা করা হয়। আলোচনায় কর্মসূচি স্থগিত না করলে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে অর্থ উপদেষ্টার বৈঠক বাতিল করা হয়। সেইসঙ্গে এনবিআরের চাকরি অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস হিসেবে ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আন্দোলনরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক না হলেও, অর্থ উপদেষ্টা রবিবার বিকেলে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। বৈঠকে রাজস্ব বোর্ডের উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। আলোচনায় ব্যবসায়ীরা উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় কমিটি গঠনের পরামর্শ দেন। সে আলোকে ব্যবসায়ীদের বৈঠকেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় পাঁচ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে কমিটিতে কারা আছেন এবং কমিটির কার্যপরিধি কী হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত জানাননি অর্থ উপদেষ্টা।
অপরদিকে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পরপরই সরকারের পক্ষ থেকে এনবিআর পরিস্থিতি নিয়ে এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রদান করা হয়। এতে বলা হয়, ‘অতি জরুরি আমদানি-রপ্তানি ও বৈদেশিক বাণিজ্যের কার্যক্রম চলমান রাখার স্বার্থে সরকার এনবিআরের আওতাধীন কাস্টমস হাউস, আইসিডি, বন্ড কমিশনারেট এবং শুল্ক স্টেশনগুলোর সব স্তরের চাকরি ‘অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘দেশের বাজেট বাস্তবায়নে উন্নয়নমুখী কর্মকা- পরিচালনার প্রধান অন্তরায় হলো দুর্বল রাজস্ব সংগ্রহ ব্যবস্থা। রাষ্ট্রের প্রয়োজনের তুলনায় রাজস্ব আহরণ অনেক কম, যার পেছনে রয়েছে ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা, অনিয়ম ও দুর্নীতি। এই বাস্তবতায় সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা সব অংশীজনের পরামর্শ অনুযায়ী নেওয়া হয়েছে।’
গত দুই মাস ধরে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার প্রেক্ষিতে কর্মবিরতি ও শাটডাউনের মতো কর্মসূচি চালিয়ে আসছেন। এর ফলে দেশের আমদানি-রপ্তানি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাজস্ব আদায় কার্যক্রমে চরম অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।’
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, ‘আন্দোলনের নামে চলমান এই কর্মকা- পরিকল্পিত ও দুরভিসন্ধিমূলক। এটি জাতীয় স্বার্থ এবং নাগরিক অধিকারের পরিপন্থি। সরকারের পক্ষ থেকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের প্রস্তাব দেওয়া হলেও তা প্রত্যাখ্যান করে তারা অনমনীয় অবস্থানে রয়েছে।’
সরকার এও বলেছে, ‘আমরা আশা করি, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অনতিবিলম্বে কর্মস্থলে ফিরে যাবেন এবং জাতীয় স্বার্থ-পরিপন্থি ও আইনবিরোধী কর্মকা- থেকে বিরত থাকবেন। অন্যথায় জনগণের স্বার্থ ও দেশের অর্থনীতির সুরক্ষায় সরকার প্রয়োজনীয় কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে।’
প্রসঙ্গত, এনবিআরের চলমান অচলাবস্থা ইতোমধ্যেই দেশের বাণিজ্যিক কার্যক্রমে অপূরণীয় ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি করেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া, শুল্ক আদায় ও পণ্য খালাস কার্যক্রম।
অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে এনবিআর ঐক্য পরিষদের বৈঠক হয়নি ॥ কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে আন্দোলনরত এনবিআর কর্মকর্তাদের নির্ধারিত বৈঠক হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর ঐক্য পরিষদ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চলমান অচলাবস্থা নিরসনের উপায় খুঁজতে রবিবার বিকেল ৪টায় এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল।
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের যুগ্ম মহাসচিব শফিউল বাসার বাদল বলেন, অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে আমাদের বসার কথা ছিল। এজন্য আমরা মার্চ টু এনবিআর কর্মসূচি স্থগিত করি। আমাদের একটা প্রতিনিধি দল বৈঠকে অংশ নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি স্থগিত না করলে তিনি আলোচনায় বসবেন না। আমরা কর্মসূচি স্থগিত করে আলোচনায় বসব না। তিনি বলেন, আবার ষড়যন্ত্রের মধ্যে পড়তে চাই না। কর্মসূচি চলমান অবস্থায় আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, অর্থ উপদেষ্টা এমন কোনো সিডিউল দেননি। বৈঠকের বিষয়টি আমরা জানি না।
শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক ॥ এনবিআরের আন্দোলনরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক না হলেও অর্থ উপদেষ্টা দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। রবিবার বিকেল পৌনে ৬টার দিকে সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এ বৈঠক শুরু হয়। সন্ধ্যা ৭টার দিকে বৈঠক শেষ হয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের আন্দোলনের কারণে সার্বিক আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম তথা ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিনের সঙ্গে বৈঠকে বসেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা।
বৈঠক শেষে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় পাঁচ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে কমিটিতে কারা আছেন এবং কমিটির কার্যপরিধি কী হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত জানাননি অর্থ উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, ‘এনবিআর কীভাবে সংস্কার করা যায় সে বিষয়ে কমিটি আলাপ-আলোচনা করবে। তারা সবার কথা শুনবে।’ ৫ সদস্যের কমিটিতে কারা কারা আছেন? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, কমিটিতে কারা আছেন তাদের নাম আমি এখন বলব না।
এনবিআরের ৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নে কারা আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ওটা আমার কনসার্ন, ডিপার্টমেন্ট না।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশের (আইসিসিবি) সভাপতি মাহবুবুর রহমান, আইসিসিবি সহ-সভাপতি ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী, মেট্রোপলিটন চেম্বারের (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি রহমান, এমসিসিআই সহ-সভাপতি ও ট্রান্সকম গ্রুপের সিইও সিমিন রহমান, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকিন আহমেদ প্রমুখ। বৈঠকে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানও উপস্থিত ছিলেন।