
দেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি)
তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিবেশী দেশসহ বহির্বিশ্ব যখন এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে ধুঁকছে দেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) শিল্প। দক্ষ মানবসম্পদের অভাব, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিমাতাসুলভ আচরণ এবং সরকারের উদাসীনতাকেই এই খাতের প্রধান প্রতিবন্ধকতা মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। এমন পরিস্থিতিতে একমাত্র সরকারের যথাযথ পদক্ষেপই সম্ভাবনাময় এই খাতকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন তারা। এমনটাই জানা গেছে খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে।
খাত সংশ্লিষ্টদের মতে এবং পরিকল্পনা কমিশনের প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, পতিত আওয়ামী সরকারের সময়ে তরুণদের বেকারত্ব ঘুচিয়ে কর্মসংস্থান তৈরিতে যে খাতটিতে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছিল তা হলো তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি। শুধু কম্পিউটার প্রশিক্ষণেই গত ১৬ বছরে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। ২০৩১ সালের মধ্যে আইটি খাতে ২০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। অথচ বাস্তবে এই খাতের সমস্যা কাটিয়ে সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে তেমন কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করেনি বিগত সরকার।
দীর্ঘদিন থেকেই দেশের ফ্রিল্যান্সিং খাত আইটি সেবায় নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করছে। দেশে পেমেন্ট গেটওয়ে সমস্যায় সঠিক সময়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারছে না ফ্রিল্যান্সাররা। তাছাড়া পেমেন্টের পুরোটাও তারা তুলতে পারে না। প্রতি ১০০ টাকার বিপরীতে মার্কেট প্লেস, পেমেন্ট গেটওয়ে, এনবিআর সোর্স ট্যাক্স এবং স্থানীয় ব্যাংককে মোট ৪০ টাকা প্রদান করতে হয়। এরপরও এই খাতের উন্নয়নে সরকারের সঠিক নজরদারি নেই বলে মনে করেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
ফ্রিল্যান্সারদের সংগঠন বিএফডিএস চেয়ারপারসন ডা. তানজিবা রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ফ্রিল্যান্সারদের জন্য প্রধান সমস্যা সাসটেইনেবলিটি। এখানে ট্রেইনিং নেই, স্কিলড ওয়ার্কার তৈরি হচ্ছে না। নেই হাইস্পিড ইন্টারনেট এবং হাইকোয়ালিটি হার্ডওয়্যার। এখন স্টারলিংক আসছে, কিন্তু সবাইতো এটা এফোর্ড করতে পারবে না। সেক্ষেত্রে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট গতি বাড়াতে সরকারকে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডাররা যে শেয়ারিং লাইন দেয়, তার পরিবর্তে রিয়েল আইপি দেওয়া দরকার। এ ছাড়াও ব্যাংকগুলো থেকে সঠিক সময়ে টাকা তোলা যায় না।
এসব সমস্যা সমাধানে সরকারকে হাইস্পিড ইন্টারনেট, ফ্রিল্যান্সারদের রেমিটেন্স আয়ের ওপর প্রণোদনা, হার্ডওয়্যার আমদানির ক্ষেত্রে এনবিআরের শুল্ক সীমিত করা, আন্তর্জাতিক মানের ট্রেইনিং সেন্টার স্থাপনের মাধ্যমে দক্ষ লোক তৈরি, ক্রিপটো কারেন্সি বৈধ করা এবং ফ্রিল্যান্সারদের আয়ের ওপর এনবিআরের সোর্স ট্যাক্স আরোপ বন্ধ করার পরামর্শ দেন তিনি।
ডা. তানজিবা বলেন, দেশে সাড়ে ১০ লাখ ফ্রিল্যান্সার আছে যারা ২৫৩টি মার্কেট প্লেসে কাজ করে। এরমধ্যে সক্রিয়ভাবে কাজ করে প্রায় আড়াই লাখ। তাদের প্রকৃত আয় ৫ বিলিয়ন ডলার হলেও দেশে পাইওনিয়ার গেটওয়ের মাধ্যমে বৈধভাবে মাত্র দেড় বিলিয়ন ডলার আসে। এক্ষেত্রে সরকার এগিয়ে এলে এই রেমিটেন্সের পরিমাণ আরও বাড়বে, অন্যথায় ২০৩১ সালের মধ্যে ২০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা তা পূরণ হবে না।
এর সঙ্গে কিছুটা যুক্ত করে টাইগার আইটির নির্বাহী পরিচালক রিফাত আবেদিন বলেন, আইসিটি নিয়ে আমাদের দেশে গবেষণার অভাব আছে। এই খাতে জড়িতদের দেশে সঠিক মূল্যায়ন হয় না বলে তারা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন, এ বিষয়ে সরকারকে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি সম্প্রতি বিডা যেভাবে বিজনেস সামিট করেছে তেমন আইসিটি নিয়েও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সামিট বা এক্সপো করা দরকার।
তিনি বলেন, বাংলাদেশি অনেক মেধাবী তরুণ আছে যারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাজ করছে। কিন্তু তারা বাংলাদেশে কাজ করতে আগ্রহী না। কারণ এখানে যেমন আছে অবকাঠামোগত সমস্যা, তেমনি আছে সরকারের উদাসীনতা। আছে তথ্য বিভ্রাট ও আস্থার সংকট। তবে সামগ্রিকভাবে যে সমস্যাটা প্রকট তাহলো দেশপ্রেমের অভাব।
বায়োমেট্রিক, ফেস ডিটেক্টশন এবং চোখের আইরিশ শনাক্তের মতো মিলিটারি গ্রেড প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা এই কোম্পানির বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে রিফাত বলেন, গতবছরের শেষ দিকে আমরা নেপালে একটি প্রজেক্ট শুরু করি। কিন্তু কাজটি করার সময়ে ব্যাংক গ্যারান্টি আমরা দিতে পারিনি। কারণ আমাদের যে ব্যাংকগুলো গ্যারান্টি দেবে, সেগুলো নেপালে অ্যাকসেপ্ট হচ্ছিল না। খুব সম্ভবত আমাদের ব্যাংকগুলোর ক্রেডিট রেটিং মান খারাপ হওয়ার কারণে এই অবস্থাটা হয়েছিল।
তাছাড়া আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো থেকে এমন এমন শর্তারোপ করলো যেগুলো আমাদের মতো রাইজিং কোম্পানিগুলোর জন্য খুবই কষ্টকর। তারা ব্যাংক গ্যারান্টির জন্য শতভাগ মার্জিন, যার পরিমাণ আড়াই মিলিয়ন ডলার বা ২৫ কোটি টাকা জমা রাখার শর্ত দিয়েছিল। আমরা যদি সিকিউরিটি বাবদ ২৫ কোটি টাকা ৫ বছরের জন্য ব্যাংককে দিয়ে রাখি তাহলে কাজ করার জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল কোথায় পাবো। এক্ষেত্রে বেসিস বা আইসিটি ডিপার্টমেন্ট কারো থেকেই সাহায্য পাওয়া যায়নি।
এ ছাড়া পারফরম্যান্স গ্যারান্টি বা সিকিউরিটি মানি শুধু এক বছরের জন্য হওয়ায় বহির্বিশ্বের অনেক কাজ পাওয়া যায় না। কেন না ওইসব প্রজেক্টে সিকিউরিটি মানি বা পারফরমেন্স গ্যারান্টি হয়তো একসঙ্গে ৩ বা ৫ বছরের জন্য দরকার, যেটা বাংলাদেশ ব্যাংক দিচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক্ষেত্রে প্রতিবছর রিনিউল করার সুযোগ রাখলেও তা আন্তর্জাতিক মার্কেটে কোন কাজে লাগে না।
আইটি খাতে দেশীয় কোম্পানিগুলোর আস্থার সংকটও রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, আমাদের ডেটা বা তথ্য নিয়ে বিভ্রাট রয়েছে। কোনো তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সরকারের তরফে আয়ের কথা বলা হয় এবং কিভাবে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় তা পুরোটাই ধোঁয়াশা। আবার ট্রেড অ্যান্ড বিজনেসের দেশীয় জায়ান্ট কোম্পানিগুলো বিদেশ থেকে আইটি সেবা নিলেও আমাদের তারা মূল্যায়ন করছে না। বিদেশিদের কাছে আমাদের তথ্য নিরাপদ না জেনেও তারা সেখান থেকেই কাজ করাচ্ছে।
তবে আইসিটি খাতের উন্নয়নে সরকারের সহযোগিতার পরিবর্তে দেশীয় কোম্পানিগুলোর সক্ষমতার ওপর জোর দিয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় এক আইটি ফার্মের মহাব্যবস্থাপক আলমগীর কবির। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যারা আইটি এন্টারপ্রেনার আছে, গ্লোবালি তাদের কাজ করার সক্ষমতা কতটুক আগে সেটা যাচাই করা দরকার। আমরা নিজেরাই তো আমাদের সক্ষমতা তৈরী করতে পারিনি। আইটি কোম্পানির লোকবলের দিকে তাকালে দেখা যায়, গড়ে সাধারণত ৪০-৫০ জন একটি ফার্মে কাজ করে।
কিন্তু বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিগুলোর বড় বড় অপারেশন, তারা কি এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেবে? তারা একটি কোম্পানির রিস্ক এনালাইসিস করে। কোম্পানির ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্রেংথ, ইনফ্রাস্ট্রাকচার স্ট্রেংথ, বিজনেস কন্টিনিউয়িটি স্ট্রেংথ এ ধরনের অনেক বিষয় দেখা হয় বিদেশি কাজগুলো পাওয়ার জন্য। আমার ব্যক্তিগত অভিমত, বাংলাদেশের আইটি কোম্পানিগুলো এখনো ওই পর্যায়ের সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি যে, বহির্বিশ্বের কাজ পাবে।
বর্তমানে আইটি খাতের আরেকটি চ্যালেঞ্জ কৃত্রিম বুদ্ধিমতা (এআই)। এআই’র ফলে কাজের ইফিসিয়েন্সি বেড়ে যাচ্ছে। ফলে মানুষের সঙ্গে একটা পার্থক্য তৈরি হচ্ছে। ভবিষ্যতে এটা বিশাল একটা ফ্যাক্ট হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এটাকে বিবেচনায় রেখে আমরা কতটুকু সামনে আগাতে পারব সেটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আবার আমরা দক্ষ লোকও এই শিল্পে পাচ্ছি না। বাংলাদেশ থেকে অনেকেই দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে, কারন সঠিক মূল্যায়ন না হওয়ায়, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, চাকরির নিশ্চয়তা না থাকা।
হাতেগোনা কয়েকটি বড় কোম্পানি ছাড়া আমাদের আইটি কোম্পানিগুলো চাকরির নিশ্চয়তা তৈরি করতে পারেনি। তারা শ্রম আইনের ন্যূনতম বাস্তবায়নও করছে না। এসব সমস্যা থেকে উত্তোরণে আইটি কোম্পানিগুলোকেই কাজ করতে হবে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি করে দেওয়াসহ আন্তর্জাতিক এক্সপো আয়োজনের মাধ্যমে দেশকে ব্র্যান্ডিং করার সুযোগ রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।