ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বইমেলা প্রতিদিন

করোনার আগ্রাসনে নির্ধারিত সময়ের আগেই সমাপ্তি

প্রকাশিত: ২২:৫৮, ১১ এপ্রিল ২০২১

করোনার আগ্রাসনে নির্ধারিত সময়ের আগেই সমাপ্তি

মনোয়ার হোসেন ॥ হবে কি হবে না- এমন দোলাচলের মাঝেই শুরু হয়েছিল অমর একুশে বইমেলা। মহামারীর চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির পরিবর্তে স্বাধীনতার সাক্ষ্যবহ মার্চ মাসে মেলার সূচনা হয়। বিগত বছরের তুলনায় এবার প্রাণের মেলার প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। তাই মেলা জমে ওঠা নিয়ে শুরু থেকেই ছিল সংশয়। সন্দিহান ছিলেন প্রকাশক, লেখক থেকে পাঠক। এই দুঃসময়ের মাঝেও ১৮ মার্চ থেকে যাত্রা শুরু করা মেলা প্রথম সপ্তাহের পর ধীরে ধীরে প্রাণবন্ত হয়ে উঠছিল। বিশেষ করে বিকেল থেকে সন্ধ্যার পর বাড়ছিল পাঠকের পদচারণা। দৃশ্যমান হচ্ছিল নতুন আসা গল্প-কবিতা, উপন্যাসসহ বিবিধ বিষয়ক বইয়ের প্রতি বইপ্রেমীদের অকৃত্রিম অনুরাগ। তবে হঠাৎ করেই মেলার সময়সূচী পরিবর্তনে ঘটে যায় ছন্দপতন। রাত নয়টা পর্যন্ত চলমান মেলাটি প্রথমে রাত আটটায় এবং পরবর্তীতে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় সমাপ্তির সিদ্ধান্ত নেয় আয়োজক বাংলা একাডেমি। এরপর লকডাউনের কবলে পড়া মেলার সময়সূচী হয় বেলা ১২টা থেকে বিকেল পাঁচটা। তখন থেকেই গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল, ক্রমাগত করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির বাস্তবতায় যে কোন সময় বন্ধ হতে পারে মেলা। অবশেষে গুঞ্জন থেকে সত্যি হলো সেই আলোচনা। ২৮ দিনের সফরটি নেমে এলো ২৬ দিনে। অর্থাৎ মেলার সময় দুদিন কমে আগামী ১৪ এপ্রিলের পরিবর্তে শেষ হচ্ছে ১২ এপ্রিল। শনিবার সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এই সিদ্ধান্তের কথা জানান। এদিকের মেলার সময় ফুরিয়ে আসায় শনিবার তুলনামূলকভাবে বইয়ের বিক্রি কিছুটা বেড়েছে। বিশেষ করে বিকেল চারটার পর প্যাভিলিয়ন থেকে ছোট-বড় স্টলে কম-বেশি পাঠকের আনাগোনা চোখে পড়েছে। হাতে হাতে ঘুরেছে গদ্য-পদ্য কিংবা রাজনীতি, ইতিহাসসহ নানা বিষয়ের বইয়ের ব্যাগ। সেই সুবাদে লোকসানের মাঝেও প্রকাশকরা কিছুটা হলেও স্বস্তি অনুভব করেছেন। এর বাইরে মেলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলেই এক বাক্যে মেনে নিয়েছেন, প্রতিবন্ধকতাকে নিয়েই শুরু হয়েছে বইয়ের এই উৎসব। তাই অন্য কিছুর পরিবর্তে করোনার কারণেই মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বইমেলা। নির্ধারিত সময়ের আগে শেষ হওয়ার বিষয়ে কথা হয় জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদের সঙ্গে। আলাপচারিতায় তিনি বলেন, গত বছরে মহামারীর শুরু থেকেই সঙ্কটে ভুগছে সৃজনশীল প্রকাশনা। লোকসানের বোঝা বেড়েই চলেছে। বিগত সেই ১২ মাসের লোকসানের সঙ্গে এবার যুক্ত হলো অমর একুশে বইমেলার ক্ষতি। এই মেলাকে ঘিরে আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর আশা করেছিলাম। উদ্ভূত বাস্তবতার কারণে সেটি সম্ভব হলো না। এ নিয়ে বেশি কিছু বলার অবকাশ নেই। তাই পরিস্থিতির কারণেই নির্দিষ্ট সময়ের আগেই মেলা সমাপ্তির সিদ্ধান্তটি মেনে নিতে হবে। করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকার ঘোষিত নির্দেশনার সঙ্গে একাত্ম না হওয়ার কোন সুযোগ নেই। কারণ মহামারীর প্রকোপ রোধ করতে সরকার খুবই সচেতন। বিজ্ঞজনদের মতামত নিয়েই পরিস্থিতি মোকাবেলায় নানা সিদ্ধান্ত নেয়ার পাশাপাশি সেগুলো বাস্তবায়নে করা হচ্ছে। এই অবস্থায় মেলা বন্ধের সিদ্ধান্তকে আমরাও স্বাগত জানাই। তবে সৃজনশীল প্রকাশনাসংশ্লিষ্টদের ক্ষতির বিষয়ে পরবর্তীতে আমরা প্রকাশকরা বৈঠক করব। আমাদের ক্ষতিপূরণে ওই বৈঠকে উঠে আসা সম্মিলিত সিদ্ধান্তগুলো সরকারের সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পেশ করা হবে। নির্দিষ্ট সময়ের দুদিন আগে মেলার সমাপ্তি প্রসঙ্গে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী জনকণ্ঠকে বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে আমরা এ বছর বইমেলা করে সংক্রমণের ঝুঁকিকে বাড়াতে চাইনি। সেই বাস্তবতায় বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে আমরা ভার্চুয়াল বইমেলা করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রকাশকরা তাতে রাজি হননি। উল্টো বইমেলা করার আয়োজনটিকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। মূলত প্রকাশকদের চাপে পড়েই এ বছর বইমেলার আয়োজন করতে হয়েছে। সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার শঙ্কা থাকা সত্ত্বেও সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় মেলার আয়োজন করেছি। এমনকি লকডাউনের মাঝেও মেলা চালু রেখেছি। আর এই মেলা চালাতে গিয়ে একাডেমির কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাম্রলিপি প্রকাশনীর প্রকাশক তারিকুল ইসলাম রনি বলেন, লোকসান হতে পারে- এমন ধারণা নিয়েই আমরা মেলায় অংশ নিয়েছি। সব শেষে সেই আশঙ্কায় সত্যি হয়েছে। ছোট থেকে বড় সকল প্রকাশকই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে পরিস্থিতির কারণেই নতুন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাতে হবে। কারণ ১৪ এপ্রিল থেকে কঠোর বিধিনিষেধ মেনে পুরোদমে লকডাউন শুরু হবে। সেক্ষেত্রে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত মেলা চালু থাকলে প্যাভিলিয়ন থেকে স্টলের অবকাঠামো ভেঙ্গে সেগুলোকে সরিয়ে নেয়া আরও কঠিন হতো। করোনাবিষয়ক বইয়ের কথা : এ বছর অতিমারীকে উপজীব্য করে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু বই। এগুলোর বাতিঘর এনেছে মঈনুস সুলতানের‘যুক্তরাষ্ট্রের মফস্বলে করোনা সংকট ও বর্ণবিভেদের বৃত্তান্ত’ ও রিজওয়ানুল ইসলামের ‘করোনাঘাতে অর্থনীতি ও শ্রমবাজার’। সময় এনেছে ওবায়দুল কাদেরের ‘করোনাকালে’। বিভাস এনেছে ধ্রুব এষের ‘করোনাধারা’। ছায়াবীথি এনেছে মাহবুব আলমের ‘করোনাকালে সাম্প্রদায়িকতা ও রাজনৈতিক বিদ্বেষ’। প্রথমা এনেছে আবুল বাসারের অনুবাদে ড. মাইকেল মোসলির ‘কোভিড ১৯ : করোনাভাইরাস যা জানা দরকার’, রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীরের ‘যুদ্ধোত্তর থেকে করোনাকাল’। অন্যপ্রকাশ এনেছে ওয়ামেক আজফার রাজার ‘করোনা উপাখ্যান’। চৈতন্য এনেছে ডাঃ অপূর্ব চৌধুরীর ‘ভাইরাস ও শরীর’। নতুন বই : বাংলা একাডেমির জনসংযোগ উপবিভাগের তথ্য অনুযায়ী, শনিবার মেলার ২৪তম দিনে নতুন বই এসেছে ১০৮টি। এদিনের বিষয়ভিত্তিক বইয়ের মধ্যে গল্পর বই রয়েছে ২০টি, উপন্যাস ৯টি, প্রবন্ধ ১টি, কবিতা ৩৫টি, গবেষণা ২টি, ছড়া ৬টি, শিশুসাহিত্য ৭টি, জীবনী ৪টি, রচনাবলি ১টি, বিজ্ঞান ১টি, ইতিহাসের ৩টি, ধর্মীয় ৭টি, অনুবাদ ৩টি, সায়েন্সফিকশন ১টি ও অন্যান্য ৮টি। এদিনের উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে মিজান পাবলিশার্স এনেছে লে. কর্নেল (অব.) এম এ হামিদের ধর্মবিষয়ক বই ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলাম’, সেলিনা হোসেনের শিশুতোষ বই ‘আকাশপরী ও আলী ইমামের ‘গল্পগুলো পশুপাখির’। প্রিয় বাংলা এনেছে হানিফ সংকেতের ‘সংগত প্রসঙ্গত অসংগত’। পাঞ্জেরী এনেছে কিশোর ক্লাসিক অনুবাদ ‘দি মিল অন দি ফ্লস জর্জ ইলিয়ট’ এবং সঙ্গীতা ইমামের শিশু-কিশোর সাহিত্য ‘অনাকাক্সিক্ষত স্পর্শ’। রয়েল পাবলিশার্স এনেছে তাসমিম সুলতানার উপন্যাস ‘ঝরাপাতা’। এছাড়া ২৪ দিন পর্যন্ত প্রকাশিত মোট বইয়ের সংখ্যা ২ হাজার ৫২৯টি।
×