ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গোলাগুলিতে দুজন নিহত

প্রকাশিত: ২২:২২, ৫ অক্টোবর ২০২০

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গোলাগুলিতে দুজন নিহত

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুই সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে ফের গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছে দুই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী। আহত হয়েছে ১৫ নারী-পুরুষ। সন্ত্রাসীরা প্রতিপক্ষের শেডে অগ্নিসংযোগও করেছে। রবিবার ভোরে কুতুপালং ক্যাম্প-২ ওয়েস্টেও ডি-৫ ব্লকে এ ঘটনা ঘটে। নিহত দুই রোহিঙ্গা হচ্ছে কুতুপালং ক্যাম্প-২ ওয়েস্টের ডি-৫ ব্লকের মৃত সৈয়দ আলমের পুত্র ইমাম শরীফ (৩২) ও ডি-২ ব্লকের মৃত ইউনুসের পুত্র শামসুল আলম (৪২)। এর আগে বৃহস্পতিবার কুতুপালং ক্যাম্পে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের গুলিতে এক মহিলা নিহত হয়। হতাহতের সত্যতা নিশ্চিত করে কুতুপালং ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক আতিকুর রহমান বলেন, ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার ও ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আর্মড পুলিশ টহলে রয়েছে। উখিয়া থানার ওসি আহাম্মদ মঞ্জুর মোরশেদ বলেছেন, দুই রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করে সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। জড়িতদের গ্রেফতারে র‌্যাব, পুলিশ ও আর্মড ব্যাটালিয়ন সদস্যরা অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। ক্যাম্প কমিটির নেতা জালাল আহমদ জানিয়েছেন, এ ঘটনায় আহত ছৈয়দ আলম, আনোয়ারা বেগম, ইমাম হোসেন, মোঃ রাসেলকে গুরুতর আহত অবস্থায় কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অন্যদের বিভিন্ন এনজিওর হাসপাতাল ও কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা রবিবার সকালে কুতুপালং ক্যাম্পের সি-ব্লকের ৩৮ শেড-৪৭-৪৮ ই-ব্লকের ১২-১৩নং শেডের কয়েকটি ঝুপড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে। খবর পেয়ে উখিয়া ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। উখিয়া থেকে সংবাদদাতা জানান, ক্যাম্পের ভেতরে চাঁদাবাজির ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে প্রতিনিয়ত গোলাগুলির ঘটনা লেগেই রয়েছে। ইতোপূর্বে ছোট-বড় একাধিকবার গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। ক্যাম্পে দোকানপাট গড়ে তোলা, ইয়াবা ও স্বর্ণ চোরাচালান কারবার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা গ্রুপগুলো সক্রিয়। একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টায় থাকে সর্বদা। ক্যাম্পভিত্তিক অবৈধ ব্যবসা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজি হাত ছাড়া করতে নারাজ ওই সন্ত্রাসীরা। প্রতিমাসে ৩৪ ক্যাম্প থেকে কয়েক কোটি টাকা চাঁদা বাণিজ্য হয়ে থাকে। সূত্র জানায়, শরণার্থী আইন উপেক্ষা করে উখিয়া টেকনাফে ৩৪ ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা দোকান বসিয়ে নগদ টাকা কামাই করছে। ওইসব ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের দোকান রয়েছে অন্তত ২৫ হাজারটি। ক্যাম্পের ভেতরে দোকান বসানো শরণার্থী আইনবহির্ভূত হলেও এক শ্রেণীর ক্যাম্প ইনচার্জ ক্যাম্পের ভেতরে দোকানগুলো বসানোর মৌখিক অনুমতি দিয়েছেন বলে জানা গেছে। ওইসব দোকান থেকে মাসিক চাঁদা আদায় করা হয় প্রায় আড়াই কোটি টাকা। এই মোটা অঙ্কের টাকার একটি অংশ যায় কতিপয় ক্যাম্প ইনচার্জের পকেটে। আরেকটি অংশ পায় ক্যাম্প ইনচার্জ কার্যালয়ে দায়িত্বরত উচ্চমান সহকারী, গোয়েন্দা পুলিশ থেকে শুরু করে পিয়ন পর্যন্ত। চাঁদার সিংহভাগ পেয়ে থাকে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। তাই ওইসব দোকান ও ইয়াবা কারবারিদের কাছ থেকে প্রতিমাসে দোকানভাড়া স্বরূপ চাঁদা আদায় করতে ক্ষমতার লড়াই দেখিয়ে থাকে রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গ্রুপের ক্যাডাররা। সূত্র জানায়, চাঁদা আদায়কে কেন্দ্র করে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গুলিবর্ষণের ঘটনায় তিনদিন আগে রোহিঙ্গা নারীর মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত ১২টা থেকে ভোর পর্যন্ত ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে দুই সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে দফায় দফায় গুলিবর্ষণের ঘটনায় কুতুপালং ৩নং ক্যাম্প এফ ব্লকে আশ্রিত রোহিঙ্গা ছৈয়দ আলমের মেয়ে সমিরা আক্তার (৪১) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এ সময় সন্ত্রাসীদের হামলায় আহত ৭ রোহিঙ্গা এখনও ক্যাম্প হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। রেজিস্ট্রার্ড ক্যাম্পের চেয়ারম্যান হাফেজ জালাল আহমদ জানান, দুই বিদ্রোহী গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ক্যাম্পের পরিস্থিতি দিন দিন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। নিরীহ রোহিঙ্গারা আতঙ্কিত ও ভীতিতে জীবনযাপন করছে। জানা গেছে, ৩৪ ক্যাম্পের ভেতরে রোহিঙ্গাদের অন্তত ২৫ হাজার দোকান রয়েছে। ওই দোকানগুলো খোলা থাকে গভীর রাত পর্যন্ত। সশস্ত্র রোহিঙ্গা গ্রুপের ক্যাডাররা ওখানে বসে আড্ডা জমায়। মিয়ানমারের হরেক রকমের অবৈধ পণ্যছাড়াও কিছু কিছু দোকানে ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা ও মদ বিক্রি করছে তারা। ক্যাম্প অভ্যন্তরে দোকানের জায়গা করে নিতে রোহিঙ্গারা স্থানীয়দের ভিটাবাড়ি দখল করে নিয়েছে। ক্যাম্পে দোকান বসানোর কাজে ক্যাম্প প্রশাসনে দায়িত্বরত কতিপয় কর্মকর্তা রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা দিচ্ছে। তারা মাস শেষে ওইসব দোকান থেকে মোটা অঙ্কের টাকা (বখরা) পেয়ে থাকেন। এ কারণে রোহিঙ্গারা স্থানীয়দের জায়গা দখল করলেও ক্যাম্প প্রশাসনের কিছু অসৎ কর্মকর্তা যেন দেখেও দেখে না। উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৭ আগস্ট থেকে পরবর্তী তিনমাসে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে উখিয়া টেকনাফে আশ্রয় নেয়। এর আগে বিভিন্ন সময় চার লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয়। নতুন পুরনো মিলে বাংলাদেশ ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রিত। তারা বর্তমানে নগদ টাকা কামাই করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও ফিরে যায়নি মিয়ানমারে। বরং দিন দিন নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে গ্রুপভিত্তিক রোহিঙ্গারা। সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত বলে আনাস গ্রুপ ও মাস্টার মুন্না গ্রুপ নামে দুটি সন্ত্রাসী গ্রুপের নাম সাধারণ রোহিঙ্গারা উল্লেখ করলেও প্রকাশ্যে বলার সাহস কারও নেই। ক্যাম্পের ভেতরে দোকানপাট বন্ধ ঘোষণা করা প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেছেন সচেতন মহল।
×