ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকায় সক্রিয় ৫০ গ্যাং ॥ কিশোর গ্যাং কালচারে উৎকণ্ঠায় অভিভাবক

প্রকাশিত: ১০:১২, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯

ঢাকায় সক্রিয় ৫০ গ্যাং ॥ কিশোর গ্যাং কালচারে উৎকণ্ঠায় অভিভাবক

কাওসার রহমান ॥ কিশোর গ্যাংয়ের ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন অভিভাবকরা। তারা তাদের সন্তানদের নিয়ে উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি বিচলিত কর্মজীবী বাবা-মা। তারা সেই সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে যান, ফেরেন সন্ধ্যায়। এই সময়টায় তাদের সন্তানরা কী করে, কার সঙ্গে মেশে সেটা জানার তাদের কোন উপায় থাকে না। ফলে নিজের কিশোর সন্তান বন্ধুত্ব করতে গিয়ে ভুল করে কি-না কিংবা অপরাধীদের চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে কি-না এ নিয়ে তারা রীতিমতো উৎকণ্ঠায় আছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সন্তান গ্যাংয়ের সদস্য জানতে পারলেই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বরং পারিবারিক কিছু উদ্যোগের মাধ্যমেই এ থেকে তাদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব। কিশোরদের গ্যাংয়ে জড়িত হওয়া ঠেকাতে অভিভাবকরাই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারেন। তারা বলছেন, এ রকম ঘটনায় ছেলেমেয়ের টাকার চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে তার বাসায় ফেরার সময়সূচীরও ঠিক থাকে না। এই দুটি বিষয় দেখা গেলেই সতর্ক হওয়া উচিত। ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার কিশোর গ্যাং। স্কুল-কলেজের গন্ডি পেরোনোর আগেই কিশোরদের একটা অংশের বেপরোয়া আচরণ এখন পাড়া-মহল্লায় আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে উদ্ভটসব নাম দিয়ে খোলা হয়েছে এসব গ্রুপ। ঢাকায় অর্ধশত ‘কিশোর গ্যাং’ এর নাম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে রয়েছে। সর্বশেষ গত ৪ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুরে খুন হওয়া কিশোরটি ‘ফিল্ম ঝিরঝির’ গ্যাংয়ের সদস্য ছিল। আর ‘আতঙ্ক’ গ্যাংয়ের সদস্যরা তাকে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই মোহাম্মদপুরে মহসিন নামের ১৪ বছরের এক কিশোরের প্রাণহানি ঘটেছে। এলাকাভিত্তিক গড়ে উঠছে আলাদা আলাদা কিশোর গ্যাং। কোন কোন এলাকায় একাধিক গ্রুপ গড়ে উঠেছে। এসব গ্যাং ছিনতাই, আধিপত্য বিস্তারে মারামারি, খুনখারাবি, মাদক ব্যবসা, মাদক সেবন, ইভটিজিং সবই করছে। নিজেদের অবস্থান জানান দিতে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা স্ট্যাটাস দেয়। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমুতে তারা একে অপরের সঙ্গে ভাব বিনিময় করে। বিপক্ষ গ্রুপকে প্রতিহত করার জন্য প্রকাশ্য হুমকি-ধমকি দেয়া তাদের নিত্যদিনের কাজ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীতে শতাধিক কিশোর গ্যাং গড়ে উঠলেও সক্রিয় ৫০টি। এসব গ্যাংয়ে অন্তত কয়েক হাজার কিশোর জড়িত। এদের মধ্যে অনেকেই স্কুলের গ-ি পার হতে পারেনি। অথচ তারা ভয়ঙ্কর সব অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। র‌্যাব ও পুলিশের অভিযানে গত এক মাসে অন্তত অর্ধশতাধিক কিশোরকে আটক করে কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উত্তর বিভাগে সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং। ওই এলাকায় উল্লেখযোগ্য কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে রয়েছে- পাওয়ার বয়েজ, ডিসকো বয়েজ, বিগ বস, নাইন স্টার ও নাইন এমএম বয়েজ, এনএনএস, এফএইচবি, জিইউ, ক্যাকরা, ডিএইচবি, ব্ল্যাক রোজ, রনো, কেনাইন, ফিফটিন গ্যাং, ডিসকো বয়েজ, পোটলা বাবু, সুজন ফাইটার, আলতাফ জিরো, ক্যাসল বয়েজ, ভাইপার, তুফান, থ্রি গোল গ্যাং। এছাড়া তেজগাঁওয়ে মাঈনুদ্দিন গ্রুপ, মিরপুর-১১ তে বিহারি রাসেল গ্যাং, মিরপুর ১২ তে বিচ্চু বাহিনী, পিচ্চি বাবু ও সাইফুলের গ্যাং, সি ব্লকে সাব্বির গ্যাং, ডি ব্লকে বাবু রাজন গ্যাং, চ ব্লকে রিপন গ্যাং,ধ ব্লকে মোবারক গ্যাং। কাফরুলের ইব্রাহিমপুরে নয়ন গ্যাং, তুরাগে তালাচাবি গ্যাং, ধানমন্ডিতে রয়েছে নাইন এমএম, একে ৪৭ ও ফাইভ স্টার গ্রুপ, রায়েরবাজারে স্টার বন্ড গ্রুপ ও মোল্লা রাব্বি গ্রুপ, মোহাম্মদপুরে গ্রুপ টোয়েন্টিফাইভ, লাড়া দে, লেভেল হাই, দেখে ল-চিনে ল, কোপাইয়া দে গ্রুপ, দক্ষিণখানে শাহীন-রিপন গ্যাং, উত্তরখানের বড়বাগে নাজিম উদ্দিন গ্যাং, আটিপাড়ার শান্ত গ্যাং, মেহেদী গ্যাং, খ্রীস্টানপাড়ার সোলেমান গ্যাং, ট্র্যান্সমিটার মোড়ের রাসেল ও উজ্বল গ্যাং, হাজারীবাগে বাংলা ও গ্লোরিয়ায় লাভলেট, বংশালে জুম্মন গ্যাং, মুগদায় চান-জাদু, ডেভিল কিং ফুল পার্টি, ভলিয়ম টু ও ভান্ডারি গ্যাং, চকবাজারে টিকটক গ্যাং ও পোঁটলা সিফাত গ্যাং সক্রিয়। মূলত ঢাকায় গ্যাং কালচারের বিষয়টি প্রথম নজরে আসে ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে। জানুয়ারির মাসের ৬ তারিখে ঢাকার উত্তরায় ১৫ বছর বয়সী আর এক কিশোরকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছিল এসব গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর কিশোরদের গ্যাং সম্পর্কিত নানা তথ্য সামনে আসে। ফলে নড়েচড়ে বসে পুলিশ প্রশাসন। উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন অভিভাবকরাও। ওই হত্যা মামলার সূত্রে যে আটজনকে গ্রেফতার করা হয় তারা উত্তরার ডিসকো বয়েজ এবং বিগ বস কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। এর মধ্য গ্যাংয়ের দলনেতাও ছিল। গ্রেফতারকৃতদের মুখে সবে দাড়ি-গোঁফ গজিয়েছে। অথচ তারা পাওয়ার বয়েজ, ডার্ক শ্যাডো, নাইন স্টার এমনসব স্টাইলিশ নামের গ্রুপের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। র‌্যাবের কর্মকর্তা মুফতি মাহমুদ খান তখন জানিয়েছিলেন, এমন ফিল্মিসব নাম হলেও এদের কার্যক্রম অতটা সরল নয়। এর সদস্য কিশোররা অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। তারা মাদকের সঙ্গে কিছুটা জড়িত। আবার পাড়া-মহল্লায় বিভিন্ন জায়গায় লম্বা সময় ধরে বসে থেকে ইভটিজিং করে। এদের সঙ্গে চলতে চলতে ভাল ছেলেরাও অপরাধে ঝুঁকে পড়ে। এর সদস্যও আছে বিভিন্ন রকম। তবে প্রায়ই দেখা যায় স্কুল ড্রপ-আউট ছেলেরা যারা কিছু করে না তারা স্থানীয় অন্য ছেলেদের গ্রুপে আসার জন্য বাধ্য করে। মনের মিল হলে অন্যরাও আসে। উত্তরার ঘটনার পর বরগুনায় রিফাত শরীফ নামের এক যুবককে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার পর আলোচনায় এসেছে বন্ড ০০৭ নামের একটি গ্রুপ। কিন্তু ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশালসহ কয়েকটি বড় শহরে বিভিন্ন কিশোর গ্যাং নানা ঘটনায় আলোচনায় এলেও মফস্বল শহরে এ ধরনের সংঘবদ্ধ কিশোর দলের অপরাধমূলক তৎপরতার খবর বরগুনার আগে খুব একটা আসেনি। মূলত বরগুনার রিফাত হত্যা ঘটনার পর পরই ঢাকার বাইরের কিশোর গ্যাংয়ের চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ কয়েকটি জেলায় এ ধরনের কিশোর গ্যাংয়ের কারণে কয়েকটি হত্যাকান্ডের ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া মারধর, চুরি, ছিনতাই, ইভটিজিং, মাদক ব্যবসা, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার মতো অভিযোগও রয়েছে এসব গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে। এই ‘গ্যাং কালচারে’ জড়িত থাকার অভিযোগে গত দুই মাসে দুই শতাধিক কিশোরকে আটক করে সংশোধনাগারে পাঠিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এসব গ্যাং সদস্যের মধ্যে অনেক নামীদামী স্কুলের শিক্ষার্থী, ধনী ও শিক্ষিত পরিবারের সন্তানরাও জড়িয়ে পড়েছে। অথচ সন্তানদের এসব কর্মকা-ের ব্যাপারে অভিভাবকদের কোন ধারণাই ছিল না। কেন গ্যাং সংস্কৃতিতে জড়িয়ে পড়ছে কিশোররা ॥ পুলিশ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা, এ্যাডভেঞ্চার বা ক্ষমতা দেখানোর লোভ, মাদক, বন্ধুদের পাল্লায় পড়াসহ নানা কারণে কিশোর গ্যাংগুলো তৈরি হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. তানিয়া রহমান বলছেন, বর্তমান সময়ের ব্যস্ততার কারণে অনেক বাবা-মা সন্তানকে ঠিকমতো সময় দিতে পারেন না। এমনকি সন্তান কি করছে, কোথায় যাচ্ছে, কাদের সঙ্গে মিশছে, তাদের চাহিদা কী, এসব সম্পর্কেও তারা কোন খোঁজ রাখেন না। ফলে এই সন্তানরা বন্ধুদের কাছে আশ্রয় খোঁজে, তাদের সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে পছন্দ করে। সেখানে তারা একই ধরনের মানসিকতা খুঁজে পায়, সাপোর্ট পায়। এভাবেই তাদের ছোট ছোট দল তৈরি হয়। তিনি জানান, পরে মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে বা রাজনৈতিক বড় ভাইয়ের স্বার্থে এই কিশোররা জড়িত হতে থাকে। অনেক সময় এলাকায় আধিপত্য দেখানো, সবার সামনে নিজেকে জাহির করার লোভ থেকে তারা নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িত হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, দেখা যায়, ক্লাসের একজন বন্ধু কোন গ্যাংয়ের সদস্য হলে আরেকজনকে সেখানে সদস্য হতে প্রভাবিত করে। এ ধরনের ছেলেদের অন্যরা একটু ভয় পায়। ফলে এতে তাদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষমতার মনোভাব তৈরি হয়। ফলে তারা গ্যাংয়ের সঙ্গে আরও ভালভাবে জড়িয়ে পড়ে। পরে মাদক বা নিজেদের খরচ যোগাড় করতে তারা নানা অপরাধ করা শুরু করে। এরপর আর গ্যাংয়ের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। অনেক সময় নিজেদের দল ভারি করতে প্রথমদিকে বিনামূল্যে মাদক সরবরাহ করে শিক্ষার্থীদের আসক্ত করে তোলা হয়। পরে তাদের গ্যাংয়ের সদস্য করে নেয়া হয়। তিনি সাম্প্রতিক একটি ঘটনার উদাহরণ দিয়ে বলেন, তার পরিচিত একটি পরিবারের সন্তান ঢাকার একটি নামী স্কুলের ছাত্র, কিন্তু কয়েকদিন ধরে স্কুলে যেতে চাইছিল না। তার বাবা-মা জোর করার পর সে জানায়, সে আর ওই স্কুলে পড়তে চায় না। কারণ সেখানে উপরের ক্লাসের কয়েক ছাত্র তাকে জোর করে মাদক নিতে বলে। না হলে তাকে মারধর করা হবে বলে হুমকি দিচ্ছে। স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা বলেন, তারাও এ ধরনের ঘটনা শুনেছেন, কিন্তু তারাও অসহায়। পরে স্কুলটি পরিবর্তন করে পরিবারটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, গ্যাং কালচারের সঙ্গে বাঙালীদের কোন সম্পর্ক নেই। এটি একটি ইউরোপীয় কালচার। কিন্তু প্রযুক্তির কারণে সেটা আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে। টেলিভিশনের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে কিশোর-কিশোরীরা। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো কোন ধরনের প্রোগ্রাম দেখাতে পারবে এসব ক্ষেত্রে সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। তিনি বলেন, কয়েক দশক আগেও যেমন মা-বাবা তাদের সন্তানদের সঙ্গ দিতেন, সময় ও পরিস্থিতির কারণে এখন সেটা সম্ভব হচ্ছে না। কেউ কেউ তার সন্তানদের ডে-কেয়ার অথবা গৃহপরিচারিকার কাছে রেখে কাজে যাচ্ছেন। মূলত এসব কারণেই তাদের সন্তানরা কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। ঢাকার বাসিন্দা ইব্রাহিম হোসেন তার ছেলের কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ার ঘটনার উদাহরণ টেনে বলেন, আমি লক্ষ্য করছি যে আমার ছেলেটির আচরণ সম্প্রতি বেশ বদলে গেছে। সে ঠিক সময়ে বাসায় ফেরে না। স্কুল শেষ করেও বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে চলে যায়, আসে অনেক রাতে। ওর মায়ের কাছে বেশি হাত খরচের টাকার জন্য বায়না করে। আমি ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকি, বাসায় সময় কত দিতে পারি? কিন্তু স্কুল থেকে অভিযোগ আসার পরে সেখানে গিয়ে জানতে পারি, আরও কয়েক ছেলের সঙ্গে মিলে অন্য একজনকে মারধর করেছে। এটা জেনে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সময়কার গ্যাংয়ের এক সদস্য জানায়, স্কুলে পড়ার সময় ঢাকার একটি এলাকার একটি গ্যাংয়ের সদস্য ছিল সে। বর্তমানে সে একটি কলেজে পড়াশোনা করছে। তাদের ক্লাসের তিনটা গ্রুপ ছিল। বেশিরভাগই কোন না কোন গ্রুপের সদস্য ছিল। ওদের সঙ্গে থাকলে সবাই সমীহ করত। কারও সঙ্গে গ-গোল হলে ওরা তার হয়ে মারপিট করতে আসত, সে কারণে নিজেকে তার বেশ ক্ষমতাবান মনে হতো। সে-ও কয়েকবার অন্যদের সঙ্গে মারামারিতে অংশ নিয়েছে। কিন্তু একসময় এই গ্রুপের সদস্যরা মাদক সেবনে জড়িয়ে পড়ে, যার শিকার হয় সেও। পরিবারের সদস্যরা টের পেয়ে রিহ্যাব সেন্টারে ভর্তি করে সুস্থ করে তোলে তাকে। পরে তারা ওই এলাকা বদলে আরেক এলাকা গিয়ে তাকে অন্য স্কুলে ভর্তি করে। কুড়ি উত্তীর্ণ এই তরুণটি বলে, তখন যদি আমার পরিবার আমাকে ফিরিয়ে না আনত, আজকে হয়ত আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে যেত। উৎকণ্ঠায় অভিভাবকরা ॥ ঢাকার মোহাম্মদপুরে বাস করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ-কালীন শিক্ষক তাহমিনা আক্তার পলি। নিজের কিশোর সন্তান বন্ধুত্ব করতে গিয়ে ভুল করে কি-না কিংবা অপরাধী চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে কি-না এ নিয়ে রীতিমত উৎকণ্ঠায় থাকেন তিনি। তিনি বলেন, আমার ছেলের বয়স ১৪ বছর। আমি সবসময় চিন্তিত, ভীত ও আশঙ্কায় যে ছেলেটা কোথায়, কার সঙ্গে মিশছে। এখন তো দুনিয়া হাতের মুঠোয়। নেট... হোয়াটসঅ্যাপ ওরা ব্যবহার করে। এগুলো আমাকে ভাবায় যে আমার ছেলেটাকে আমি কোথায় দেখতে চাই আর ও কোথায় যাচ্ছে। চট্টগ্রামের সেগুফতা পারভীন বলছেন, এমনিতেই এই বয়সী সন্তানদের নিয়ে বাবা-মারা সবসময় চিন্তিত থাকেন। তার মধ্যে সমাজে নতুন উপসর্গ হিসেবে এসেছে কিশোর গ্যাং কালচার যা অভিভাবকদের আরও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। তিনি বলেন, আমার এক ছেলে ক্লাস সিক্সে আর এক ছেলে এ লেভেল শেষ করেছে। ইংরেজী মিডিয়ামে পড়ছে ওরা। আমি দেখেছি ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলের অনেকে গ্যাং বা গ্রুপে জড়িয়ে পড়েছে। ক্রাইম করে ফেলছে। আমার ছেলেকে সবসময় তাই গাইডের মধ্যে রেখেছি। বন্ধুর মতো সবসময় তার সঙ্গে ছিলাম। ইন্টারমিডিয়েটে ওঠার পর তাকে মোবাইল ও ইন্টারনেট দিয়েছি। নোয়াখালীর নাসিমা আক্তার বেবী বলছেন, ইন্টারনেটের অপব্যবহারের কারণে এগুলো বেশি ঘটছে। এ নিয়ে অনেক চিন্তিত থাকি আমরা। আমি এবং ওর বাবা চেষ্টা করি তার দিকে খেয়াল রাখতে। কিন্তু সমস্যা হলো সে তো কলেজে পড়ে। সেখানে সে কী করে বা ইন্টারনেটে কাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ বেশি হয় সেটা তো মনিটর করা সম্ভব নয়। তাই টেনশন লাগে। ঢাকার আরেক কর্মজীবী অভিভাবক নুসরাত জাহান শাওন বলছেন, সন্তানের সব সঙ্গী ও মনোজগৎ সম্পর্কে বোঝাটা খুব সহজ নয়, যে কারণে উদ্বেগও বেশি থাকে। প্রথমত আমি বুঝতে পারি না যে স্কুলে কাদের সঙ্গে মিশছে। আরেকটা বিষয় হলো সে কিভাবে চিন্তা করছে সেটা পুরোপুরি বোঝা যায় না। ইন্টারনেট সে কিভাবে ব্যবহার করছে, বিবেচনাবোধ প্রয়োগ করে করছে কি-না সেটা বোঝার মতো কোন কন্ট্রোল আমার কাছে নেই। এটাই বড় উদ্বেগের। পেশাগত জীবনে শিশু-কিশোরদের নিয়ে কাজ করছেন নুসরাত জাহান শাওন। তিনি বলেন, অভিভাবকদের উচিত সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দেয়া এবং তাদের প্রতিটি বিষয় অনুধাবনের চেষ্টা করা, যাতে সন্তান খারাপ সংসর্গে যাওয়ার সুযোগ না পায়। আবার পাড়া-মহল্লায় কিশোরদের মধ্যে কখনও কোন বিষয়ে বিরোধ হলে তা যেন খুব বেশি দূর না গড়ায় সেদিকে অভিভাবক ও এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠদের খেয়াল রাখা উচিত বলেও মনে করেন তিনি। অভিভাবকরাই পারেন গ্যাং কালচার বন্ধে ভূমিকা রাখতে ॥ সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, কিশোরদের গ্যাংয়ে জড়িত হওয়া ঠেকাতে অভিভাবকরাই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারেন। অধ্যাপক তানিয়া রহমান বলছেন, সন্তানের চলাফেরা, আচরণের দিকে লক্ষ্য রাখলেই বুঝতে পারা যাবে যে, সে আসলে কোন গ্যাং বা মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে কিনা। হয়ত সন্তানটি সময়মতো বাসায় ফিরছে না। ঠিকমতো খাচ্ছে না বা ঘুমাচ্ছে না। হয়ত বাসায় ফিরে নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকছে। অতিরিক্ত টাকা দাবি করছে। বাসায় বন্ধুদের নিয়ে বেশি আড্ডা দিচ্ছে। কাপড়-চোপড়ের ধরন পাল্টে যাচ্ছে। হয়ত হাতে বা কানে নানা ধরনের অলঙ্কার ব্যবহার শুরু করেছে। কথাবার্তা বা আচরণে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এসব লক্ষণ দেখা গেলেই সন্তানের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। তিনি বলছেন, বর্তমানে অনেক পরিবারে বাবা-মা দুজনই কাজ করেন। ফলে সন্তান কি করে, কার সঙ্গে মেশে, সেটা ঠিকভাবে খোঁজ রাখেন না। কিন্তু সন্তানের ওপর সবসময় নজর রাখা খুব জরুরী। বিশেষ করে কাদের সঙ্গে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, টাকা কোথায় খরচ করছে, ঠিক সময়ে বাসায় ফিরছে কিনা ইত্যাদি নজরে রাখা উচিত। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক (মনোরোগ) মেখলা সরকার বলছেন, সন্তানের আচরণের দিকে লক্ষ্য রাখলেই বোঝা সম্ভব যে, তার মধ্যে আসলে কোন পরিবর্তন হচ্ছে কিনা? সে কোন গ্যাং বা মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে কিনা? কারণ এ রকম কিছু ঘটলে তার আচরণে, অভ্যাসে অবশ্যই পরিবর্তন আসবে। প্রথমদিকে সেটা শনাক্ত করা গেলে খুব সহজেই ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে। তিনি বলছেন, এ রকম ঘটনায় ছেলেমেয়ের টাকার চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে তার বাসায় ফেরার সময়সূচীও ঠিক থাকে না। এই দুটি বিষয় দেখা গেলেই সতর্ক হওয়া উচিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সন্তান গ্যাংয়ের সদস্য জানতে পারলেই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বরং পারিবারিক কিছু উদ্যোগের মাধ্যমেই এ থেকে তাদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক তানিয়া রহমান বলছেন, অভিভাবকদের জন্য সন্তানকে সময় দেয়া জরুরী। তাদের সঙ্গে আস্থার, বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। আমাদের সংস্কৃতিতে পশ্চিমা অনেক কিছু ঢুকে গেছে। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াচ্ছি, বিদেশী কায়দায় চলছি, সুতরাং সম্পর্কের ক্ষেত্রে সেই স্বাভাবিকতা নিয়ে আসতে হবে। যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন, পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি করাটা জরুরী। তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন- সন্তানের স্কুলে নিয়মিত খোঁজখবর রাখা, কাদের সঙ্গে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, সেটা নিয়মিতভাবে নজরে রাখা উচিত। এছাড়া সন্তানদের হাতখরচ দেয়ার ব্যাপারেও সতর্ক থাকা উচিত, যেন সেটা অতিরিক্ত না হয়। মনোরোগবিদ অধ্যাপক মেখলা সরকার বলছেন, সন্তানের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতে হবে। তাকে বকাঝকা নয়, বরং তার কথা শুনতে হবে। কেন সে গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত হয়েছে সেটা বোঝা দরকার। সন্তানের চাহিদার ব্যাপারটি বুঝতে হবে। তিনি বলছেন, অনেক পরিবারে বাবা-মার সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব থাকে। আমরা দেখেছি, এ ধরনের পরিবারের সন্তানরাই মাদক বা গ্যাং জাতীয় ঘটনাগুলোয় বেশি জড়িয়ে পড়ে। সেই দূরত্ব কাটাতে অভিভাবকদেরই উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি বলছেন, অনেক বাচ্চার মধ্যে আচরণগত ত্রুটি থাকে। এ কারণেও অনেকে গ্যাংয়ের সদস্য হতে পারে। এক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানীদের সহায়তা নিতে হবে। তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন, এ রকম ঘটনায় সবচেয়ে ভাল সিদ্ধান্ত হতে পারে পরিবেশের পরিবর্তন। যেমন ওই এলাকা থেকে দূরের অন্য এলাকায় চলে যাওয়া, স্কুল-কলেজ বদলে ফেলা ভাল। সেক্ষেত্রে সন্তানের জন্য সমস্যাটি কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে। এই ঘটনা জানার পর অনেক অভিভাবকই তাদের সন্তানদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেছেন। এ প্রসঙ্গে এক অভিভাবক বলেন, এই যুগের ছেলেপেলেদের হাতের মুঠোয় থাকে ইন্টারনেট। তারা কী ধরনের সাইটে যায় সেটি ল্যাপটপ হিস্ট্রি দেখি। যেসব বন্ধু বাসায় আসে বা যেসব ফ্যামিলির সঙ্গে ওঠাবসা এগুলো মনিটর করি। কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য রোধে কাজ করছে র‌্যাব-পুলিশ ॥ গত ৮ সেপ্টেম্বর পুলিশ মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ জাভেদ পাটোয়ারি কিশোর গ্যাং কালচার যাতে গড়ে উঠতে না পারে সে ব্যাপারে পুলিশ সুপারদের তৎপর থাকার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। একই দিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও বলেছেন, সরকার কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়টি মনিটর করছে। দেশে কিশোর গ্যাং, বড় গ্যাং সব গ্যাংকেই ধ্বংস করে দেয়া হবে। সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক সোহেল রানা বলছেন, দেশের বিভিন্নস্থানে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য রোধে কাজ করছে পুলিশ। আইনী ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি এ ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন আইজিপি। ঢাকায় পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের কর্মকর্তা নাজমুল ইসলামও বলছেন, ইন্টারনেটের কারণে কিশোর গ্যাংয়ের ধারণা শহর থেকে মফস্বল শহরগুলোতে প্রকাশ পাচ্ছে। তবে এসবের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পুলিশও দিনে দিনে সক্ষম হয়ে উঠছে। তিনি বলেন, ঢাকার মধ্যে যেসব গ্রুপ কাজ করছিল তাদের নিষ্ক্রিয় করেছি। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, মনিটর করা হচ্ছে। কিন্তু মফস্বলে পুলিশের সাইবার দক্ষতা ঢাকার পুলিশের তুলনায় কম। বিষয়টি নিয়ে স্বয়ং আইজিপি নির্দেশনা দিচ্ছেন সাইবার কর্মকর্তা তৈরি করার। আমরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, বিভিন্ন ডিভাইস এনে কাজ করছি। পুলিশের ক্রাইম এনালাইসিস বিভাগের কর্মকর্তাদের দাবি, ঢাকাতেই গত কয়েক বছরে কিশোর গ্যাং গ্রুপের সন্ধান মিলেছে অন্তত ৫০টি। এখন নতুন করে মফস্বল জেলা শহরের কিশোররাও জড়িয়ে পড়ছে এ ধরনের অপরাধী চক্রের সঙ্গে। নাজমুল ইসলাম বলেন, অনেক গ্রুপ নিজেদের মধ্যে মাদক নিয়ে কথা বলে। আবার অনেকে আর্মস নিয়ে। অনেকে সেলিব্রিটিদের ডিস্টার্ব করা নিয়ে কথা বলে, তাদের ব্ল্যাকমেল করে, তাদের এ্যাকাউন্ট হ্যাক করার পরিকল্পনা করে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ইনস্পেক্টর জুয়েল মিয়া বলেন, এই কিশোররা সংঘবদ্ধ হওয়ায় অনেকেই মনে করেন, এদের পেছনে কোন গডফাদার বা প্রভাবশালী কেউ রয়েছে। ফলে কেউ এদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পান না। অনেক সময় আমরা তদন্তে গিয়ে দেখেছি, সত্যি সত্যি এরা গডফাদারের আশির্বাদপুষ্ট। র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে কিশোর গ্যাং দমনে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। যারা এ ধরনের অপরাধে জড়িত প্রতিটা এলাকাভিত্তিক তালিকা করেছি। তালিকা ধরে ধরে আমাদের প্রতিটা ব্যাটালিয়ন কাজ করছে। তাদের ওপর নজরদারি রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আমরা অনেক কিশোর অপরাধীকে আটক করেছি। যাদের বয়স কম তাদের কিশোর সংশোধনাগারে পাঠিয়েছি। আর যারা ১৮ বছরের ওপরে তাদের প্রচলিত আইন অনুযায়ী শাস্তির আওতায় নিয়ে এসেছি। আশা করছি, তাদের তৎপরতা কমে যাবে। কারণ একদিকে আমাদের সাঁড়াশি অভিযান চলছে অন্যদিকে স্কুল-কলেজের কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকদের বার্তা দিচ্ছি। যেন তাদের সন্তানদের বেলায় সতর্ক থাকে- তারা কি করছে, কোথায় যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল রাখার জন্য।
×