ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষির উন্নয়নে বাস্তব পদক্ষেপ;###;লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩ লাখ মেট্রিক টন বেশি উৎপাদন

আমনের বাম্পার ফলনে ভরে গেছে কৃষকের গোলা

প্রকাশিত: ১১:০৭, ১০ এপ্রিল ২০১৯

আমনের বাম্পার ফলনে ভরে গেছে কৃষকের গোলা

ওয়াজেদ হীরা ॥ আমনের বাম্পার ফলনে ভরে গেছে কৃষকের গোলা। গোলাভরা সোনালি ধানে হাসির ঝলক কৃষকের মুখে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে চাল উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১৩ লাখ টন বেশি। যদিও বাজারে বর্তমানে ধানের মূল্য নিয়ে নাখোশ চাষীরা। তবে উৎপাদন নিয়ে সন্তুষ্টই মাঠপর্যায়ের কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা। কৃষিতে সরকারের ধারাবাহিক নানা উন্নয়ন কার্যক্রমের ফলে এই সাফল্য আসছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি উৎপাদিত পণ্যে কৃষক যেন ন্যায্য দাম পান সে বিষয়ে গুরুত্ব দেয়ার কথাও বলছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, ক্রমেই দেশের কৃষিজমি কমে আসছে। দেশের কৃষি জমিগুলো ভরাট করে কেউ বসতবাড়ি কিংবা মিল কারখানা গড়ে তুলছেন। বিষয়টি সরকারের সর্বোচ্চ মহলের দৃষ্টিতেও এসেছে। ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন প্রকল্প অনুমোদনকালে বারবার সতর্কবার্তা দিচ্ছেন যে, প্রকল্প বাস্তবায়নে কৃষিজমি রক্ষা করতে হবে। তবে মাঠপর্যায়ের বাস্তব চিত্রটা হলো এখনও থেমে নেই কৃষিজমি ভরাট ও বিভিন্ন কারখানা স্থাপন। এমন পরিস্থিতিতে খাদ্যে নিরাপত্তা দেয়া কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য প্রতিনিয়তই একটি চ্যালেঞ্জ। তবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অল্প জমিতে অধিক ফলনের জন্য প্রতিনিয়তই কাজ করছে। কৃষি মন্ত্রণালয় ও মাঠপর্যায়ের কৃষক সবার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে পর্যায়ক্রমে নানা উদ্যোগ আর কৃষকদের নানা পরামর্শ প্রদান সব মিলিয়ে বাড়ছে দেশের উৎপাদন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানিয়েছে, গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের চেয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমন চাষের জমির লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা বাড়ানো হয়। সেই সঙ্গে বাড়নো হয় চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও। আবহাওয়া ভাল থাকার কারণে আমন রোপণের সময়ই বাম্পার ফলনের আশা করছিলেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা। বাস্তবের চিত্রটাও তাই। বাম্পার ফলনের চেয়েও যেন বেশি কিছু! কৃষি সম্প্রসারণের সরেজমিন উইং জানিয়েছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩ লাখ টন ফলন বেশি হয়েছে আমনে। সম্প্রতি কৃষি মিডিয়া সংলাপের এক অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী ও কৃষি সচিবও আমনে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও অধিক ফলন হওয়ার কথা জানান। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকও বলেছেন, আমাদের এ বছর আমনে উৎপাদন হয়েছে লক্ষ্যের চেয়ে ১৩ লাখ টন বেশি। আমাদের এখন পুষ্টি ও নিরাপদ খাদ্য নিয়ে ভাবতে হবে। একই অনুষ্ঠানে কৃষি সচিব মোঃ নাসিরুজ্জামান জানান, আমাদের উৎপাদন ক্রমেই বাড়ছে। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে এখন আমরা আরও বেশি উৎপাদন করতে পারছি আমাদের নানা প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী বিভিন্ন জাতের কারণে। সেই সঙ্গে মাঠপর্যায়ে কৃষকদের সঙ্গে কৃষি কর্মকর্তাদের যোগাযোগও একটা কারণ। যদিও আমন উৎপাদনের এই হিসেব এখনও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মাঠপর্যায়ের তথ্যের সঙ্গে সমন্বয় করে চূড়ান্ত হয়নি। তবে শীঘ্রই হিসাব চূড়ান্ত করা হবে বলেও জানা গেছে। সরেজমিনের একাধিক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, দেখুন আমাদের যে উৎপাদন প্রতিবছরই আমরা নিজস্বভাবে মাঠপর্যায়ের একটা হিসাব করি পরে সেটি বিবিএসের হিসেবের সঙ্গে চূড়ান্ত হয়। চূড়ান্ত করতে গিয়ে কিছুটা এদিক সেদিক কম বেশি হয়। কৃষি সচিব মোঃ নাসিরুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের এবার আমনে ভাল উৎপাদন হয়েছে। দ্রুতই বিষয়টি বিবিএসের সঙ্গে চূড়ান্ত হবে আশা করছি। উৎপাদনের সাফল্যের পেছনে অনেক কারণই রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আমরা নতুন আবিষ্কার করা জাতগুলোর বীজ কৃষকদের দিচ্ছি। পর্যায়ক্রমে এই বীজগুলো মাঠে চলে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন প্রণোদনা রয়েছে এটি একটি বিষয়। কৃষকরা ভাল দাম পেলে আরও বেশি উৎপাদন করতে উৎসাহিত হন বলেও জানান তিনি। সচিব বলেন, সরকারের নানামুখী পদক্ষেপে সব মিলিয়ে আমাদের উৎপাদন বাড়ছে। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও প্রতি বছর আমনের উৎপাদন বাড়ছে। ২০১৭ সালে আমনের উৎপাদন প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ টনে পৌঁছায়। সেইসময় বন্যায় ফসল ভাসলেও ঘুরে দাঁড়ান কৃষকরা। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ কোটি ৪০ লাখ ৭৬ হাজার টন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে মোট উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৫৩ লাখ ৫৭ হাজার টন। উৎপাদনের সাফল্যের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে নতুন নতুন উদ্ভাবিত জাত, আধুনিক ব্যবস্থাপনা ও সরকারের সঠিক নীতি। কৃষকের স্বার্থ খেয়াল রেখেই সরকার কাজ করে যাচ্ছে বলেও জানা গেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ মৌসুমে ৫৬ লাখ ৪২ হাজার ৯৯৯ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছিল। এর আগের বার ২০১৬-১৭ বছর ৫৬ লাখ ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে ১ কোটি ৪০ লাখ ৭৬ হাজার টন আমন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কৃষি সম্প্রসারণের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মীর নূরুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের জমির সীমাবদ্ধতা আছে অল্প জমিতে অধিক ফলনের জন্য আমাদের সংশ্লিষ্ট বিভাগ কাজ করে যায়। এবারও আমাদের হিসাবে ১৩ লাখ টন বেশি উৎপাদন হয়েছে এটা একটা ভাল খবর। তবে আমরা জনগণকে নিরাপদ খাদ্য দিতে চাই। আমরা সে লক্ষ্য নিয়েও কাজ করছি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইংয়ের উপপরিচালক (মনিটরিং) মোঃ মিজানুর রহমান এর আগে জানিয়েছেন, ২০১৮-১৯ মৌসুমে ৫৬ লাখ ৪২ হাজার ৯৯৯ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়। এর মধ্যে বোনা আমন লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ২৪ হাজার ৯৯৯ হেক্টর জমি আর রোপা আমনের লক্ষ্য ৫৩ লাখ ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে। রোপা আমনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, চলতি মৌসুমে জমির যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এর মধ্যে উফশী জাত ৪২ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমি, হাইব্রিড ১ লাখ ৩৫ হাজার হেক্টর জমি এবং স্থানীয় জাতের ৯ লাখ ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হবে। আবাদ পরবর্তী সময়ে জানা গেছে ৫৬ লাখ ৪৩ হাজারের মতো হেক্টর জমিতে আবাদ হওয়ার লক্ষ্য থাকলেও হয়েছে ৫৮ লাখ ৭৯ হাজার হেক্টর জমিতে। যা প্রায় ২ লাখ ৩৬ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে আবাদ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে জানা গেছে, এবার সব মিলিয়ে ১ কোটি ৪০ লাখ ৭৬ হাজার টন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে বোনা আমন থেকে ৩ লাখ ৯০ হাজার টন আর রোপা আমন থেকে ১ কোটি ৩৬ লাখ ৯৪ হাজার টন। রোপা আমনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন লক্ষ্য ছিল উফশী জাতের। উফশী জাত থেকে ১ কোটি ১৮ লাখ ৪৩ হাজার টন, স্থানীয় জাত থেকে আসবে ১৩ লাখ ৮৫ হাজার টন এবং হাইব্রিড থেকে ৪ লাখ ৬৬ হাজার টন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কৃষি সম্প্রসারণের সরেজমিন উইংয়ের অতিরিক্ত পরিচালক ড. আলহাজ উদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, আমনের উৎপাদন ভাল, পূর্বের চেয়ে বেশি হয়েছে। কৃষক উৎপাদন করে খুশি। আর আবাদের লক্ষ্য যা ছিল সেখানেও আবাদ বেশি হয়েছে। কৃষক-কৃষি কর্মকর্তার সবার হাত ধরেই আমাদের কৃষিতে সাফল্য আসছে।
×