ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

উত্তাল সাগরপথে ফের মানব পাচার, টার্গেট রোহিঙ্গারা

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২২ জানুয়ারি ২০১৯

উত্তাল সাগরপথে ফের মানব পাচার, টার্গেট রোহিঙ্গারা

ফিরোজ মান্না ॥ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর আবারও সাগর পথে শুরু হয়েছে মানবপাচার। গোপনে পাচারকারী চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এবার চক্রের টার্গেট রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। পাশাপাশি কিছু বাংলাদেশীকেও সঙ্গে নিচ্ছে। পাচারকারী চক্রের প্রলোভনে অনেকেই বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি দিচ্ছেন উত্তাল সাগর। সম্প্রতি বাংলাদেশ কোস্টগার্ড বঙ্গোপসাগরের টেকনাফ উপকূল থেকে ট্রলারে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টাকালে ৩৬ রোহিঙ্গা ও ৭ বাংলাদেশীকে আটক করেছে। মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষও ৩০ রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশীকে দেশটিতে অবৈধ প্রবেশের দায়ে আটক জেলে পাঠিয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রীর ইমরান আহমদের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে কথা বলা সম্ভব হয়নি। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, ’১৫ সালে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে সাগরে ডুবে কয়েক হাজার মানুষ মারা যায়। সেসময় থাইল্যান্ডে কয়েকশ’ গণকবরের সন্ধান মেলে। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে মানবপাচার বন্ধে কঠোর উদ্যোগ নেয়া হয়। কিছু দিন বন্ধ থাকার পর আবার হঠাৎ গোপনে সক্রিয় হয়ে উঠেছে পাচারকারী চক্র। অন্যদিকে মালয়েশিয়ার পুলিশ গত কয়েক দিনে ৩০ রোহিঙ্গাসহ বাংলাদেশীকে সাগরতীর থেকে আটক করেছে। বিষয়টি নিয়ে ঢাকা-কুয়ালালামপুর আলোচনা হচ্ছে। মানবপাচার রোধে দুই দেশ যৌথভাবে কাজ করে যাচ্ছে। দুদেশের কর্তৃপক্ষই মানবপাচার বন্ধের জন্য কঠোর ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছে। সূত্র জানায়, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার শুরু। কিন্তু ’১৫ সালে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যায় দেখা দেয়। মানবপাচারে নবেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বেছে নিয়েছে চক্রটি। এ সময়ে সাগর অনেকটাই শান্ত থাকে। সংঘবদ্ধ পাচারকারীরা মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের নৌকায় সাগরপথে পাচার করছে। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া অভিমুখী বিপদসঙ্কুল এ যাত্রায় অনেক সময় ছোট নৌকায় অতিরিক্ত লোক উঠানোয় সেগুলো সাগরে ডুবে যায় এবং অনেক মৃত্যু ঘটে। ’১৫ সালে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে কয়েকশ’ ছোট বড় গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। সরকার মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। এক পর্যায়ে পাচার কিছু দিনের জন্য থেমে যায়। সে সময় অনেক পাচারকারী নৌকাবোঝাই রোহিঙ্গাদের আন্দামান সাগরে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মানবপাচার আসলে কোন দিনই বন্ধ হয়নি। কড়াকড়িতে কিছু দিনের জন্য পাচার নিয়ন্ত্রণে ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে তারা এখন আবার মানব পাচার শুরু করেছে। এবারও একই পথে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় নেয়া হচ্ছে। তারা সাগর থেকে তীরে উঠেই বনজঙ্গলে দিনের পর দিন মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। দেশে মানব পাচার রোধে কঠোর আইন থাকলেও পাচারকারীরা আইনের ভয় পাচ্ছে না। বিপজ্জনক সাগর পথে পাচার হতে গিয়ে অনেকে মারা পড়ছে, কেউ কেউ আবার মানবেতর জীবনযাপন করছে। পাচারকারীদের প্রলোভনের শিকার হয়ে বহু মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব। কেউ কেউ বিভিন্ন দেশের কারাগারে আটক রয়েছে। পাচারকারী চক্রের খপ্পর থেকে প্রতিনিয়ত অনেক নিরীহ মানুষ পুলিশের হাতে আটক হয়। কিন্তু পাচারকারীদের কাউকে গ্রেফতার করতে পারে না পুলিশ। অভিযোগ রয়েছে পাচারকারীদের সঙ্গে পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি বিভাগের রয়েছে সখ্য। এ কারণেই পাচারকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় মানব পাচারবন্ধের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কয়েক দফা চিঠি দিয়েছে। ন্যাশনাল লেভেল শেয়ারিং ফর এডাপশন অব কম্প্রিহেনসিভ ল’ এগেনস্ট ট্রাফিকিং ও রিফিউজি এ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) জানিয়েছে, বেশিরভাগ মানব পাচার হয় মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তানসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে। এক শ্রেণীর দালালের মাধমে এই পাচার হয়। তারা বেশি বেতনের চাকরির লোভ দেখিয়ে গ্রামের গরিব মানুষকে পাচার করছে। এতে বৈধ শ্রমবাজারের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। এখান থেকে উত্তরণ ঘটাতে না পারলে দেশের অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়ে পড়বে। সরকার মানব পাচার প্রতিরোধ আইন করলেও তার প্রয়োগ হচ্ছে না। এই অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে না পারলে দেশে দেশে শ্রমবাজার হারাতে হতে পারে বাংলাদেশ। সমুদ্রপথে টেকনাফ থেকে মালেশিয়ায় অনিয়মিত অভিবাসন দেশের সার্বিক অভিবাসনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভারত ও পাকিস্তানে বেশিরভাগ পাচার হচ্ছে নারী। এদের জীবন সবচেয়ে দুর্বিষহ। পাচারকারীরা দালালদের কাছে তাদের বিক্রি করে দেয়। দালালদের হাতে পড়ার পর তাদের জায়গা হয় যৌনপল্লীতে। অথবা অন্য কোন স্থানে আটকে রেখে তাদের ওপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন।
×