ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

অনেকেই শর্ত মানে না, উপকরণ নেই, ভাড়াটে ক্যাম্পাস, রোগী নেই, উচ্চ ফি

বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন-

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ২৬ আগস্ট ২০১৮

বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন-

নিখিল মানখিন ॥ দেশের অধিকাংশ বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। অনুমোদন নেয়ার সময় সরকারী কর্তৃপক্ষের কাছে দেয়া শর্তসমূহ পরবর্তীতে আর মেনে চলে না অনেক কলেজ। অনেক কলেজের অনুমোদন আছে, হাসপাতাল নেই। শিক্ষার্থীদের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের জন্য পর্যাপ্ত মেডিক্যাল উপকরণ নেই। ভাড়াটে ক্যাম্পাস ও শিক্ষক দিয়ে চলে। শিক্ষার্থীদের শেখার জন্য পাওয়া যায় না পর্যাপ্ত সংখ্যক রোগী। নেয়া হয় উচ্চ ভর্তি ফি। কলেজ কর্তৃপক্ষের ইচ্ছে মতো সব কিছু চলে । সরকারী নিয়ন্ত্রণ নেই। ডাক্তারি ডিগ্রী পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে কলেজ কর্তৃপক্ষের ওপর। বাইরে থেকে হস্তক্ষেপের খুব বেশি সুযোগ নেই। দেশের চলমান কিছু সংখ্যক বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজের এমন চিত্র তুলে ধরেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই নতুন মেডিক্যাল কলেজ অনুমোদনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যথাযথভাবে তদন্ত করে দেখার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন চিকিৎসক নেতৃবৃন্দ। আর বিএমডিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি অভিন্ন মূল্যায়ন কমিটি গঠন করার কথা জানিয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি এক সেমিনারে বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলোর মান নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, প্রতিটি বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজকে বিদ্যমান আইনের শতভাগ মেনে চলতে হবে। নিম্নমানের কলেজ থেকে ডিগ্রী নিয়ে বের হওয়া চিকিৎসকরা সমাজের জন্য আত্মঘাতী হয়ে ওঠে। আর বিএমডিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি অভিন্ন মূল্যায়ন কমিটি গঠন হতে যাচ্ছে সরকার বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। কিছু সংখ্যক বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজের কারণে পুরো চিকিৎসা সেক্টর প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেনবাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) এর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মাহমুদ হাসান। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, বিভিন্ন কারণে পর্যাপ্ত দক্ষ চিকিৎসক তৈরি হচ্ছে না। অনেক বেসরকারী কলেজে শিক্ষক, মেডিক্যাল উপকরণ ও রোগীর সঙ্কট রয়েছে। কিছু সংখ্যক মেডিক্যাল কলেজে হাসপাতাল পর্যন্ত নেই। হাসপাতাল, রোগী ও পর্যাপ্ত মেডিক্যাল উপকরণ না থাকায় শিক্ষার্থীরা প্র্যাকটিক্যাল দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়ে। নতুন মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আর শিক্ষকদের যোগ্যতা ভালভাবে মনিটরিং করা হয় না। একজন শিক্ষককে শিক্ষাদান ও চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে হয়। অনেক সময় শিক্ষাদানের তুলনায় চিকিৎসাদানে বেশি সময় দিতে হয় শিক্ষকদের। অনেক শিক্ষক একাধিক মেডিক্যাল কলেজে সম্পৃক্ত থাকেন। তিনি আরও বলেন, বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলোর মান বজায় রাখতে হবে। নিম্নমানের কলেজ থেকে বের হয়ে একজন দক্ষ চিকিৎসক হওয়া এবং মানসম্মত চিকিৎসা সেবা দেয়া সম্ভব নয়। এ ধরনের চিকিৎসকরা অনেক সময় জাতির জন্য হুমকি হয়ে ওঠেন। ভাড়াটে ক্যাম্পাসে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ থাকে না। নতুন কলেজ অনুমোদন দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান অধ্যাপক মাহমুদ হাসান। বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব জানান, দক্ষ চিকিৎসক সৃষ্টি এবং মানসম্মত কলেজ গড়তে হলে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির প্রয়োজন রয়েছে। আর তা আন্তরিকভাবেই বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ নিম্নমানের বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজের বিরুদ্ধে এক সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও আরেক সরকার এসে তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। কলেজগুলোর ওপর শক্তিশালী ও স্বচ্ছ মনিটরিং ব্যবস্থা থাকলে দেশে দক্ষ চিকিৎসক ও মানসম্মত কলেজ বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব। খসড়া আইনে যা আছে- খসড়া আইনে বলা হয়েছে, খসড়া আইন অনুযায়ী কোন ভাড়া বাড়িতে কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন করা যাবে না। কলেজ একাডেমিক ভবন ও হাসপাতাল ভবন আলাদা থাকতে হবে। কোন অবস্থাতেই দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের ধারণা গ্রহণযোগ্য হবে না। হাসপাতালে দরিদ্র জনগণের জন্য বিনা ভাড়ায় কমপক্ষে শতকরা ১০ ভাগ বেড সংরক্ষণসহ ফি চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতে হবে। কলেজে ১ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে হাসপাতালে থাকতে হবে ৫টি শয্যা। সর্বনিম্ন ৫০ জন ছাত্রছাত্রীর আসনবিশিষ্ট বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের জন্য মহানগর এলাকায় কমপক্ষে কলেজের নামে দেড় একর জমিতে অথবা নিজস্ব জমিতে কলেজের একাডেমিক ভবনের জন্য ১ লাখ বর্গফুট এবং হাসপাতাল ভবনের জন্য ১ লাখ বর্গফুট ফোরস্পেস থাকতে হবে। আর মহানগরীর বাইরে ৩ একর নির্মাণযোগ্য জমিতে অথবা নিজস্ব জমিতে ১ লাখ বর্গফুট ফোরস্পেস থাকতে হবে। তবে প্রারম্ভে একাডেমিক ও হাসপাতাল মিলে সর্বনিম্ন মোট ১ লাখ ২৫ হাজার বর্গফুট প্রয়োজনীয় অবকাঠামোসহ ফোরস্পেস থাকলে মেডিক্যাল কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করার অনুমতি দেয়া যাবে। তবে পরবর্তী ২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ২ লাখ বর্গফুট ফোরস্পেসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করতে হবে। আর বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল শুধুমাত্র নির্ধারিত প্লট/ জমিতেই স্থাপন করতে হবে। কলেজের নামে কোন তফসিলি ব্যাংকে ১ কোটি টাকার স্থায়ী আমানত রাখতে হবে। কলেজ অনুমোদিত হলে স্থায়ী আমানতটি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া এই অর্থ উত্তোলন বা ব্যয় করা যাবে না। তবে গবর্নিং বডির সিদ্ধান্ত মোতাবেক মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে কলেজ কর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র বছরান্তে প্রাপ্ত সুদ উত্তোলন করে কলেজের হিসাবে স্থানান্তর করতে পারবে। ৫০ শয্যা বিশিষ্ট একটি বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার কমপক্ষে ২ বছর পূর্ব হতে প্রস্তাবিত ক্যাম্পাসে প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামোসমূহ ন্যূনতম ২৫০ শয্যার একটি আধুনিক হাসপাতাল চালু থাকতে হবে। পরবর্তীতে চিকিৎসা শিক্ষার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণ হাসপাতালে রূপান্তর করা যাবে। পরিদর্শনকালে কোন কলেজ যথাযথভাবে পরিচালিত হচ্ছে না বলে প্রতীয়মান হলে সংশ্লিষ্ট কলেজে আসন সংখ্যা হ্রাস বা ছাত্রছাত্রী ভর্তি সাময়িকভাবে স্থগিত করা যাবে। অনিয়ম গুরুতর অথচ সংশোধনযোগ্য না হলে প্রয়োজনে কলেজের অনুমোদন স্থগিত/বাতিলা করা যাবে। কোন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাকাল্টি অব মেডিসিন অথবা মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টি নামকরণ করে এমবিবিএস কোর্সে ছাত্র ছাত্র ভর্তি করা যাবে না। কলেজের নিজস্ব একাডেমিক হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোন সরকারী/আধা সরকারী/ স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার/বেসরকারী হাসপাতাল বা ক্লিনিক বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের বাস্তব প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার করা যাবে না। তবে ফরেনসিক মেডিসিন ও রেডিওথেরাপি বিষয়ে সরকারী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল ব্যবহার সুবিধা প্রদান করা হবে। কোন উদ্যোক্তা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বিএমডিসি এর লিখিত ব্যতীত মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে পারবেন না। নীতিগত অনুমোদন প্রাপ্তির ২ বছরের মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে ব্যর্থ হলে প্রাপ্ত অনুমোদন সরাসরি বাতিল বলে গণ্য হবে। কলেজে প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ, আধুনিক সুযোগ সুবিধা সংবলিত লাইব্রেরি, খেলাধুলা, বিনোদন ও ছাত্রছাত্রীর আবাসিক ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রতিটি বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গে ফিল্ড সাইট প্রশিক্ষণের জন্য একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও একটি কমিউনিটি সংযুুক্ত থাকতে হবে। প্রতিটি কলেজে মেডিক্যাল এডুকেশন ইউনিট ও কোয়ালিটি নিশ্চিতকরণ কর্মসূচী থাকতে হবে। সরকার যেকোন সময় প্রয়োজনে এ নীতিমালা পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং সংশোধন করতে পারবে বলে জানায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। অথচ দেশের অনেক বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে খসড়া আইনের তোয়াক্কাই করা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। নির্ধারিত ফি’র দ্বিগুণ খরচ ॥ এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর প্রতি বছরের মতো এবারও ভর্তি ফি’র বিষয়টি আলোচনায় চলে এসেছে। ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। কয়েক বছর ধরে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে শুধু ভর্তি ফি ১৪ লাখ ২০ লাখ টাকা নেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। আর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর অনেক কলেজে ভর্তির সুযোগ পেতে অনানুষ্ঠানিকভাবে অনেক শিক্ষার্থীকে দিতে হয়েছে বাড়তি টাকা। যা কাগজে-কলমে লিখিত থাকে না। প্রথম শ্রেণীর মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেতে অনেক শিক্ষার্থী গোপনে মোটা অঙ্কের টাকা দেয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। ভর্তি পরীক্ষার পাশাপাশি ভর্তি ফি নিয়ে এবারও আতঙ্ক প্রকাশ করেছেন অনেক মেডিক্যাল ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবক। গত সেশনের অভিজ্ঞতা তাদের বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলোর নিজেদের মতো করে বাড়তি ভর্তি ও কোর্স ফি আদায় করে আসছে । দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলোর বিরুদ্ধে শিক্ষার নামে বাণিজ্য বসানোর অভিযোগ উঠে আসছে। বিগত শিক্ষাবর্ষে ভর্তি ফি, উন্নয়ন ব্যয়, বিধিসহ নামী-বেনামী অনেক খাতের অজুহাত দেখিয়ে চড়া ফি আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। ওইসব প্রতিষ্ঠানের ভর্তি বাণিজ্যসহ নানা নিয়মের বিষয়টি দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মেধাবী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বেশ ভাবিয়ে তুলেছে।
×