ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

জোয়ারে ভাসছে উপকূলীয় এলাকা

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ১৮ জুলাই ২০১৮

জোয়ারে ভাসছে উপকূলীয় এলাকা

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া, ১৭ জুলাই ॥ সাগরপারের জনপদ কলাপাড়ার গোটা উপকূলীয় জনপদে অস্বাভাবিক জোয়ার এখন জলোচ্ছ্বাসে পরিণত হয়েছে। যা নিয়ে দুর্যোগ আতঙ্কে রয়েছে দরিদ্র জনগোষ্ঠী। গত দেড় মাসে অন্তত ছয় হাজার পরিবারের কুড়ি হাজার মানুষের বাড়িঘর প্রায় ২০দিন জোয়ারের দুই দফা ঝাপটায় ধসে যায়। বহু পরিবার স্থায়ীভাবে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। চার হাজার পরিবার এখন বসতভিটা হারানোর শঙ্কায় পড়েছে। কারণ স্বাভাবিক জোয়ারের ঝাপটাও এখন এসব মানুষের কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়। অমাবস্যা ও পূর্ণিমার জোতে অন্তত টানা ছয়দিন দুই দফা চার/পাঁচ ঘণ্টা ডুবে থাকে বাড়িঘর। বসতঘরের ভিটেমাটি পর্যন্ত ধুয়ে যায়। ভেসে যায় রান্নার চুলা থেকে শুরু করে আসবাবপত্র। পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। সবজিসহ ফসলের ক্ষেত পর্যন্ত নষ্ট হয়ে গেছে। এমনকি টয়লেট পর্যন্ত ডুবে ব্যবহারের পানি দূষিত হয়ে পড়ছে। অস্বাভাবিক জোয়ারে এখন ছয় হাজার দরিদ্র পরিবারের বসতভিটে বাস অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ক্রমশ জোয়ারে পানির উচ্চতা বেড়ে বাড়িঘর ডুবে অসহায় হয়ে পড়ছে এসব গরিব মানুষ। কলাপাড়া উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন ও দুই পৌরসভার প্রায় চার শ’ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের বাইরে বসবাস অন্তত ছয় হাজার পরিবার। দরিদ্র এসব পরিবার সংলগ্ন নদী-খালে কিংবা সাগরে কখনও মাছ ধরছে। কখনও কামলা দিয়ে জীবিকার চাকা ঠেলছে। এরা অধিকাংশ ভূমিহীন। বাধ্য হয়ে কোন উপায় না থাকায় বেড়িবাঁধের রিভার সাইটের স্লোপে কোনমতে একটি ঘর তুলে স্ত্রী-পরিজন নিয়ে বসত গেড়েছে। প্রকৃতির বুলডোজারখ্যাত সুপার সাইক্লোন সিডরের তা-বে এসব পরিবার হারায় সহায়-সম্বল। সবকিছু। তারপরও তারা পায়নি মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই। পারেনি এক চিলতে খাস জমি পেয়ে তাতে একটি বসতঘর তুলতে। তাই বাধ্য হয়ে বেড়িবাঁধের এই স্লোপে বসবাস করছেন। চরম ঝুঁকি নিয়ে স্ত্রী-সন্তানসহ দরিদ্র এ বিশাল জনগোষ্ঠী বসবাস করে আসছেন। ফি বছর বর্ষা মৌসুমের চারটি মাস এ মানুষগুলোর ভোগান্তির শেষ থাকে না। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে বিনিদ্র রাত কাটছে তাদের। এই চারটি মাসের প্রত্যেকটি অমাবস্যা ও পূর্ণিমারে জোতে কমপক্ষে ছয় দিনে দুই দফা অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে ভাসতে হয়। আর এ সময় পুবের বাতাস তীব্র হলে ডুবে যায় ঘরের সবকিছু। তাদের কষ্টের যেন শেষ নেই। মোঃ হাবিব। নীলগঞ্জ ইউনিয়নের সলিমপুর গ্রাম ঘেঁষা বেড়িবাঁধের বাইরের স্লোপে বসবাস করছেন। ঘরটির বারান্দাসহ সব জোয়ারের পানিতে ডুবে আছে। মেয়ে কাজল জানালেন, পূর্ণিমা-অমাবস্যার জোতে ঘরের মধ্যেই পানি ঢুকে ঘরের মাটির পীড়া ভেঙ্গে নেয়। চৌকির ওপরে উঠে বসে থাকতে হয়। এভাবে ১২টি ইউনিয়নে প্রায় ছয় হাজার পরিবার বেড়িবাঁধের বাইরে জলোচ্ছ্বাসের ঝাপটা মোকাবেলা করে নামেমাত্র বসবাস করছেন। এছাড়া লালুয়ার চারিপাড়াসহ আট গ্রামের আরও তিন হাজার পরিবারের তো নিত্যদিন জোয়ারের ঝাপটায় ভাসছে। ভোলা নিজস্ব সংবাদদাতা, ভোলা থেকে জানান, তজুমদ্দিন উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের পুরাতন একটি রিং বেড়িবাঁধ ও চরফ্যাশন উপজেলার মুজিবনগর ইউনিয়নে চর মোতাহাতে বাঁধ ভেঙ্গে ৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় ৭শ’ পরিবার। জোয়ার ভাটার পানির সঙ্গে গত ২ দিন ধরে বৃষ্টি হওয়ায় পরিবারগুলোর দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। তারা এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে। জোয়ার ভাটার মধ্যে ভাসছে পরিবারগুলো। স্থানীয়রা জানান, গত শনিবার দুপুরে অমাবস্যার জো-র প্রভাবে তজুমদ্দিন উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের দালালকান্দি এলাকার মূল বেড়িবাঁধের বাইরে পুরাতন রিং বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যায়। তার পর থেকে গত ৪ দিন ধরে জোয়ার আসলেই দালালকান্দি, চৌকিদারকান্দি ও মাওলানাকান্দি গ্রাম প্লাবিত হয়। এতে তিন গ্রামের প্রায় চার শ’ পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়ে। পানিবন্দী পরিবারগুলো রয়েছে চরম বিপাকে। এক দিকে অতি জোয়ারের পানি অন্য দিকে সাপের আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়েছে অসহায় পরিবারগুলো। রান্না করার চুলা পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে গেছে। যার ফলে তাদের রান্না বন্ধ রয়েছে। টিউবওয়েল ডুবে থাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কট। অনেকইে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা কোন সাহায্য-সহযোগিতা পায়নি বলে অভিযোগ করেন। অন্যদিকে জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়ে তজুমদ্দিনের শশীগঞ্জ বাজার থেকে ধরনীর খাল লঞ্চঘাট পাকা সড়ক ডুবে যাওয়ায় আটকা পড়ে চরম দুর্ভোগে পড়ে ঢাকাগামীসহ বিভিন্ন রুটের যাতায়াতকারী সাধারণ যাত্রীরা। এছাড়াও ধরনীর খাল লঞ্চঘাট থেকে প্রতিদিন চরমোজাম্মেল, চরজহিরউদ্দিন ও কলাতলী চরে খেয়া-ট্রলারে অসংখ্য মানুষ আসা যাওয়া করে। ঢাকাগামী যাত্রী মোঃ সাদেক মিয়া বলেন, গুরুত্বপূর্ণ এই পাকা সড়কটি জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছি। সড়কটি আরও উঁচু করে মেরামত করা জরুরী। অপর দিকে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার মুজিবনগর ইউনিয়নের চর মোতাহার পয়েন্টে বিধ্বস্ত ১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সংস্কার না করায় জোয়ারের পানি হু হু করে লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। এতে করে ২/৩ শত পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বাগেরহাট স্টাফ রিপোর্টার, বাগেরহাট থেকে জানান, নদ-নদীতে জোয়ারের অস্বাভাবিক পানির চাপে শতাধিক গ্রাম জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। নদী ভাঙ্গনও মারত্মক বেড়েছে। অমাবস্যার প্রভাব, বৃষ্টি ও মৌসুমি বায়ুর চাপে পানগুছি, বলেশ্বর, ভৈরব, চিত্রা, মধুমতি, আঠারোবেকী, রূপসা, মংলা, পশুরসহ প্রায় সকল নদীর পানি জোয়ারের সময় স্বাভাবিকের চেয়ে ৩/৪ ফুট উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে নদীসংলগ্ন মোরেলগঞ্জ, কচুয়া, চিতলমারী, মংলা, রামপাল, ফকিরহাট, মোল্লাহাট, শরণখোলা ও সদর উপজেলার অধিকাংশ গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। জেলার ৩টি পৌরসভার রাস্তাঘাটও তলিয়ে যাচ্ছে। অসংখ্য পরিবার পরিবার পানিবন্দী হয়ে মানবেতর অবস্থার মধ্যে পড়েছেন। মোরেলগঞ্জ পৌরসভা মেয়র মনিরুল হক তালুকদার বলেন, অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে কমপক্ষে ৩শ’ পরিবারে রান্না বন্ধ হয়ে গেছে। অসংখ্য ঘরবাড়ি, ব্যবসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে আছে। ১ নং ওয়ার্ডে পিচঢালাই রাস্তা ধসে গেছে, ডুবে গেছে ফেরিঘাট, এসিলাহা উচ্চ বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষ ও মাঠ। মোরেলগঞ্জ সদর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মাহমুদ আলী বলেন, গাবতলা ও কাঁঠালতলা গ্রামের একটি রাস্তা নদীতে বিলীন হওয়ায় ৩ শতাধিক পরিবার পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। ডুবে গেছে গাবতলা কমিউনিটি ক্লিনিক, গিয়াসিয়া দাখিল মাদ্রাসা ও গাবতলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ। তেলিগাতী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মোর্শেদা আক্তার বলেন, এ ইউনিয়নের হেড়মা, মিস্ত্রীডাঙ্গা ও হরগাতী গ্রামের ১৫শ’ পরিবার গত তিন দিন ধরে পানিবন্দী অবস্থায় আছে। ধসে গেছে প্রায় এক কিলোমিটার ইটসোলিং রাস্তা। হোগলাবুনিয়া ইউনিয়নের নদীর তীরবর্তী বদনীভাঙ্গা, পাঠামারা ও সানকিভাঙ্গা গ্রামে পানি ঢুকে পড়ায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে খাউলিয়া ইউনিয়নের পশুরবুনিয়া, খাউলিয়া, মধ্যবরিশাল ও সন্ন্যাসী গ্রামে। অনুরূপ কথা জানিয়েছেন, ফকিরহাট, মংলা, রামপাল, চিতলমারী কচুয়া ও সদর উপজেলার অধিকাংশ ইউপি চেয়ারম্যান।
×