ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

আটকদের জিজ্ঞাসাবাদে ঢাবি ভিসির বাসায় হামলায় রাজনৈতিক দলের উস্কানির ইঙ্গিত

কোটা আন্দোলনে সন্ত্রাসের ঘটনায় থলের বিড়াল বেরিয়ে আসছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৪ মে ২০১৮

কোটা আন্দোলনে সন্ত্রাসের ঘটনায় থলের বিড়াল বেরিয়ে আসছে

শংকর কুমার দে ॥ কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের (ভিসি) বাসভবনে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, গাড়ি পোড়ানো, পুলিশের ওয়াকিটকি ছিনতাই এবং সন্ত্রাসের ঘটনায় থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের লন্ডন থেকে ফোন কলটি ঢাকায় আসার পরেই মূলত কোটা আন্দোলনকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছড়িয়ে দিয়ে দেশ অচল করার মাধ্যমে সরকার বিরোধী আন্দোলনে রূপ দিতে চেয়েছিল বিএনপি ও জামায়াত-শিবির। কোটা আন্দোলন উত্তাল হয়ে উঠে পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ার মুহূর্তেই কোটা পদ্ধতি বিলুপ্তের ঘোষণা দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করে ফেলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আলিয়া মাদ্রাসার এক ছাত্রসহ চারজন বহিরাগতকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে কোটা আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য রাতের গভীরে ভিসির বাসভবনে হামলা করার জন্য রাজনৈতিক দলের উস্কানি দিয়েছে এমন ইঙ্গিত পেয়েছেন বলে তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার দেবদাস ভট্টাচার্য বলেছেন, ভিসির বাসভবনে হামলা, এক ছাত্রের মৃত্যু ও এক ছাত্রী রগকাটার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে দেয়ার পেছনে কারা জড়িত ও কারণ কি? ভিসির বাসভবনে রাতের আঁধারে কেন হামলা করা হল? এই হামলার পেছনে কারও ইন্ধন আছে কি? হামলার সঙ্গে কারা কারা জড়িত? এসব নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গ্রেফতার হওয়া চারজনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ ডিবি। ভিসির বাসভবনে হামলার পেছনে রাজনৈতিক ইন্ধন ও উস্কানি ছিল কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট ডিবির একজন কর্মকর্তা জানান, শুরুতে কোটা আন্দোলন শান্তিপূর্ণ থাকলেও হঠাৎ করেই যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্দোলন ছড়িয়ে পরে সারাদেশে। কোটা সংস্কার আন্দোলন আর কোন বিশেষ শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সর্বসাধারণের প্রাণের দাবিতে পরিণত হওয়ার রূপ নেয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ উত্তাল হয়ে অচল হওয়া উপক্রম হয়ে উঠে পুরো দেশ। ঠিক সেই মুহূর্তে কোটা পদ্ধতি বিলুপ্তের ঘোষণা দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করে ফেলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশে এ পর্যন্ত যতগুলো আন্দোলন গড়ে উঠেছে তার পেছনে রাজনৈতিক দলের ইন্ধন থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। কোটা আন্দোলনের ক্ষেত্রে শুরু থেকেই এর সঙ্গে রাজনীতির কোন সম্পর্ক ছিল না থাকলেও তলে তলে বিষয়টিতে রাজনীতির প্রলেপ দেয়ার চেষ্টা করা হয়। কোটা আন্দোলনকারীরা উত্তাল হওয়ার মুহূর্তেই কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সচিবালয়ে বৈঠকে বসেন সেতুমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বৈঠকে সমঝোতাও হয়। কিন্তু অদৃশ্য ইঙ্গিতে আবার সকালে সমঝোতা হওয়ার পর বিকেলে সমঝোতা ভেঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেয় সমঝোতায় অংশগ্রহণকারী আন্দোলনকারীরা। সরকার চেষ্টা করেছে এই আন্দোলন যাতে কোন ভাবেই সরকার বিরোধী রূপ নিতে না পারে তা মোকাবেলা করতে। কিন্তু বিরোধীরা চেষ্টা করেছে আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে ফায়দা লোটা যায় তা নিয়ে। আন্দোলন শুরুর দিকেই প্রকাশ্যে বিএনপির নেতারা আন্দোলনকারীদের পক্ষে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার পরিকল্পনা করছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে আন্দোলনে বিএনপির জড়িত হওয়ার বিষয়টি সামনে আসে একটি ফোনকলকে ঘিরে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ফোন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরে শিক্ষক বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মামুন আহমেদকে। ফোনকলটি প্রকাশ্যে আসার পরেই মূলত কোটা আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার যে অপচেষ্টা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। আর এতেই কোটা আন্দোলনের নেপথ্যের রাজনৈতিক ইন্ধন থাকার বিষয়টি তদন্তের সামনে চলে আসে। কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে শেষ মুহূর্তে গেম খেলতে চেয়েছিল বিএনপি। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাকিবুল হাসান ওরফে রাকিব (২৬), মাসুদ আলম ওরফে মাসুদ (২৫), আলী হোসেন শেখ ওরফে আলী (২৮) এবং আবু সাইদ ফজলে রাব্বী ওরফে সিয়াম (২০) নামে চার যুবকে গ্রেফতার করার পর বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তারা শিক্ষার্থী না হয়েও বহিরাগত হিসেবে গভীর রাতে ভিসির বাসভবনে হামলার জন্য গিয়েছিল কেন? তাদের কাছ থেকে দুইটি মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ উদ্ধার হয়েছে। তারা কোন রাজনৈতিক দলের উস্কানিতে হামলার সময়ে গিয়েছিল কি না সেই বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী ও ডিবির অনুসন্ধানে জানা গেছে, কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন গত ৯ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আখতারুজ্জামানের বাস-ভবনে অজ্ঞাত দুষ্কৃতকারীরা প্রবেশ করে ব্যাপক ভাংচুর চালায়। দুষ্কৃতকারীরা উপাচার্যের বাসার নিচে থাকা চারটি গাড়ি ভাংচুর করে আগুনে পুড়িয়ে দেয়। গত ৯ এপ্রিল অজ্ঞাতপরিচয় মুখোশধারী সন্ত্রাসী ও দুষ্কৃতকারীরা লোহার রড, পাইপ, হ্যামার ও লাঠি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের বাসভবনে হামলা চালায়। তারা সীমানা দেয়াল টপকে এবং ভবনের মূল ফটকের তালা ভেঙ্গে ভবনের ভেতরে ঢোকে। এ সময় বাসভবনে মূল্যবান জিনিসপত্র, আসবাব, ফ্রিজ, টিভি, লাইট, কমোড ও বেসিনসহ অনেক মালপত্র ভাংচুর করা হয়। লুটও করা হয়। এ ছাড়া ভবনে রাখা দুটি গাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং আরও দুটি গাড়ি ভাংচুর করে। হামলাকারীরা নিজেদের পরিচয় আড়াল করতে ভবনের সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো ভেঙ্গে ফেলে এবং আগুনে পুড়িয়ে নষ্ট করে ফেলে যায়। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেছেন, ভিসির বাসভবনে হামলার মাধ্যমে কোটা সংস্কারের দাবির আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল কিনা সেই বিষয়গুলো তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও সন্ত্রাসের তা-বলীলা চালানো এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মৃত্যু, রগকাটা, লন্ডন থেকে ঢাকায় টেলিফোনের মাধ্যমে উস্কানি দিয়ে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যে সহিংসতার সৃষ্টি করার অভিযোগে দায়ের করা পাঁচটি মামলার তদন্ত করতে এই ধরনের তথ্য পেয়েছে বলে পুলিশের দাবি। শাহবাগ থানা ও রমনা থানায় দায়ের করা পাঁচটি মামলার তদন্ত করছে পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
×