ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১১ আগস্ট ২০১৭

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা হোক আজ। দেশের এটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু বেশকিছু দিন ধরে একটি অস্বস্তিকর অবস্থা সেখানে চলছে। আর কয়েকদিন পর ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণীর ভর্তি কার্যক্রম শুরু হবে। এর ঠিক আগে নতুন উপাচার্য নিয়োগ ইস্যুতে রীতিমতো অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। একটি দুটি ঘটনা নয়, ঘটনার ঘনঘটা এখন! বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহর ঢাকায় গত সপ্তাহের পুরোটাজুড়ে এই আলোচনা ছিল। এখনও আছে। আলোচনার কেন্দ্রে অবস্থান করছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। দীর্ঘ ৮ বছর ৭ মাস ধরে দায়িত্বে তিনি। নতুন উপাচার্য প্যানেলেও নাম চলে এসেছে। আবারও নিয়োগ পেলে টানা ১২ বছর উপাচার্যের চেয়ারে থাকার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন তিনি। কিন্তু সমস্যা হয়ে গেছে অন্য জায়গায়। আরেফিন সিদ্দিকের বিরুদ্ধে উঠেছে বিস্তর অভিযোগ। অভিযোগগুলো চলে এসেছে গণমাধ্যমেও। বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত বলছে, বর্তমান উপাচার্যের নেতৃত্বে প্রশাসনিক ক্ষমতায় থাকা অংশটি নিজেদের পছন্দ ও অনুগত শিক্ষকদের সংখ্যা বাড়াতে ব্যাপক অনিয়ম করেছে। মূলত উপাচার্যের পছন্দের এবং অনুগত ব্যক্তিদের শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এজন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করা হয়েছে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ করা দেয়া হয়েছে। কোন ধরনের বিজ্ঞপ্তি ছাড়াও দেয়া হয়েছে শিক্ষক নিয়োগ। এমনকি স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নেই এমন প্রার্থীরাও নিয়োগ পেয়েছেন। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংখ্যা ১ হাজার ৯৯২। উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সময় নিয়োগ দেয়া হয়েছে মোট ৯০৭ জনকে। শেষ তিন বছরে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন ৩৫০ জন। যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে, শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে অন্তত ৭৮ জনকে। ন্যূনতম যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও দুই বিভাগে নিয়োগ পেয়েছেন ১০ জন। অন্তত ৩ জন স্নাতকোত্তর ছাড়াই নিয়োগ পেয়েছেন। গত ২৯ জুলাই উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের জন্য সিনেট অধিবেশন ডাকা হলে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দেয়। রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচনসহ অন্য ক্যাটাগরির পদ শূন্য রেখেই ডাকা হয় অধিবেশন। আওয়ামী লীগ সমর্থক নীল দলের শিক্ষকদের বড় একটি অংশের অভিযোগ, দীর্ঘদিন দায়িত্বে থাকার সুবাধে স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছেন আরেফিন সিদ্দিক। ক্ষমতার অপব্যবহারসহ প্রচুর অনিয়ম দুর্নীতি করেছেন। বিভিন্ন ইস্যুতে তার সঙ্গে দ্বিমত করায় নীল দলের অনেক ত্যাগী শিক্ষকদের বছরের পর বছর ধরে হয়রানি করছেন। তাদের অভিযোগ, এই ধারা অব্যাহত রাখতেই সকল নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে নতুন ভিসি প্যানেলে নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করিয়েছেন আরেফিন। এ কারণে গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে রিট করা হয়। চলে আইনী লড়াই। আপাতত ভিসি নির্বাচন স্থগিত রয়েছে। এদিকে অভিযোগের বিপরীতে উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক স্পষ্ট করে কিছুই বলছেন না। তার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে অন্য কথা। গত মঙ্গলবার কথা হচ্ছিল বর্তমান উপাচার্যের সমর্থক এক শিক্ষক নেতার সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, সবই বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র। বর্তমান উপাচার্যের মতো মানুষ হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়কে স্থিতিশীল রেখেছেন তিনি। উপাচার্য পরিবর্তন করা হলে বিশ্ববিদ্যালয় অস্থিতিশীল হবে। আর তা হলে জাতীয় নির্বাচনের আগে আগে নাকি সরকারও বেকায়দায় পড়ে যাবে। একই প্রসঙ্গে পরদিন বুধবার কথা হয় আওয়ামী লীগ সমর্থিত নীল দলের একজন শিক্ষক নেতার সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সরকারে। সারা দেশ এখন স্থিতিশীল। সঙ্গত কারণেই বিশ্ববিদ্যালয় অস্থিতিশীল হওয়ার কোন কারণ নেই। তিনি বলছিলেন, আরেফিন সিদ্দিকের স্বৈরাচারী আচরণ ও অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতি বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু আমাদেরই তো লোক। আমরা কী করে বলি? তাছাড়া, কেউ সাহস করে মুখ খুললে তাকে নানা ভাবে হেনস্তা করা হয়। ‘বিএনপি জামায়াত’ বানিয়ে দেন তিনি। এ অবস্থা চলতে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও বড় ক্ষতি হবে। সরকারও বিব্রত হবে। এমন আশঙ্কায় সরকারের শীর্ষ মহলে এবং একইসঙ্গে আদালতের কাছে প্রতিকার চাওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। এদিকে সিনেটে শিক্ষার্থীদের কোন প্রতিনিধি না থাকার বিষয়টিও দীর্ঘ দিন ধরে আলোচনায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে শিক্ষার্থীরা। ধারাবাহিক কর্মসূচীর অংশ হিসেবে বুধবার তারা ক্যাম্পাসে সাইকেল র‌্যালি বের করে। দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য থেকে শুরু হয় র‌্যালি। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ, কলাভবন, শহীদ মিনার হয়ে কার্জন হলে গিয়ে শেষ হয়। সাইকেল র‌্যালিতে অংশ নেয়া এক শিক্ষার্থী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তো ডাকসুর পক্ষে মত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ডাকসু নির্বাচন ইজ আ মাস্ট। নির্বাচন না হলে ভবিষ্যত নেতৃত্বে শূন্যতার সৃষ্টি হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতির দেয়া বক্তব্য কি তাহলে ভুল ছিল? পাশ থেকে আন্দোলনকারীদের আরেকজন কৌতুক করার চেষ্টা করেন। বলেন, রাষ্ট্রপতিকেও বিএনপি জামায়াত বানিয়ে দিবে নাকি এখন? এর আগের দিন মঙ্গলবার বর্তমান উপাচার্যের সমর্থনে ক্যাম্পাসে একটি মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধন থেকে আরেফিন সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত খবরকে ‘অপসাংবাদিকতা’ দাবি করে গণমাধ্যমের সমালোচনাও করা হয়। অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বলেছেন, অনিয়ম দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে আরেফিন সিদ্দিক যাদেরকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন, যাদের স্ত্রীকে নিয়োগ দিয়েছেন, মানববন্ধনে তাদেরকে একসঙ্গে দেখা গেছে। সব মিলিয়ে বেশ উত্তপ্ত ক্যাম্পাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে এমন অবস্থা কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না বলে মনে করছেন রাজধানীর সচেতন নাগরিকেরা।
×