ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ফ্যাশনে ইতিহাস ঐতিহ্য

এবার ঈদে ঘরে ঘরে মুঘল নক্সায় ইমিটেশন গহনা

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ১৭ জুন ২০১৭

এবার ঈদে ঘরে ঘরে মুঘল নক্সায় ইমিটেশন গহনা

সমুদ্র হক ॥ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। মুঘলদের নক্সার গহনা প্রায় প্রতিটি ঘরে। জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রজন্মের তারুণ্যের ক্রেজে নতুন মাত্রা। আধুনিক নক্সার গহনা এখন আকর্ষণে ব্যর্থ। ফ্যাশনে যুক্ত ভারি বড় গহনা। সঙ্গে পাথর থাকতে হবে। এ্যান্টিক্স হলেও চলবে। তবে চুমকি হলে চলবে না। গহনার এই ফ্যাশনটি মোটেও ‘হুজুগ’ নয়। যুগের ও কালের দাবি এই গহনা নিয়ে এসেছে। এভাবেই এগিয়ে চলেছে মহাকালের প্রান্তরে। এবারের ঈদে গয়না নিজেই সেজেছে নতুন সাজে। তরুণীদের হাতে চুড়ি, বালা, ব্রেসলেট, রতনচুর (পাঁচ আঙুলে আংটি চেনে রেখে ব্রেসলেটের সঙ্গে এঁটে দেয়া), বাহুতে বাজু, আঙুলে আংটি, গলায় মণিহার ও গোলাকৃতির হয়ে এঁটে থাকা চিক। কানে ঝুমকা। কোনটি জড়োয়ার। নাকে নোলক, সিঁথির টিকলি, পায়ের নূপুর ও মল। কোমরের বিছা। গয়নার মেলা বসেছে যেন। গলা থেকে ডিম্বাকৃতির লম্বা সীতাহার। সাতনরী হারও এবার নানাভাবে এসেছে। নেকলেসেরই কত বাহার। সবই মোগল আমলের নক্সার আদলে গড়া। এমন নক্সার ভারি গহনা মোগলদের স্ত্রীরা গা ভরে পরত। নানা নক্সায় এসব গহনা সোনা-রুপার তো আছেই। কম যায় না ইমিটেশন। ইংরেজী ইমিটেশন অর্থ নকল। এবার ঈদে যে নকল গহনা এসেছে তাকে নকল মনে হওয়া খুব কঠিন। গানের কথার মতো ‘আসল সোনা ছাড়িয়ে যে নেয় নকল সোনা সে জন সোনা চেনে না...’। মণিহারও এসেছে কয়েক ধরনের। সেদিনের সীতাহার, সাতনরী হারও মেলে ইমিটেশনে। পাথর এঁটে আরও সুন্দর করা হয়েছে। এসব পাথর দেখে চোখ ঝলসে যায়। রাতে দেখলে মনে হবে আকাশের তারা মিটিমিটি জ্বলছে। ইমিটেশনের বড় গহনাগুলো গা ভরে পরা যায়। প্রাচীন গহনাগুলোও ফিরে এসেছে। একটা সময় বিছা ছিল নারীর ভূষণ। বনেদী ঘরের নারী কোমরে সোনার বিছা না পরলে আভিজাত্য দেখানো যেত না। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে রুপার তৈরি বিছা গ্রামের গৃহস্থ ও কিষাণ ঘরে প্রবেশ করে। ওই সময় গ্রামের বিয়েতে বিছাকে নিয়ে গীত গাওয়া হতো। বগুড়ার সোনাতলা এলাকার একটি গীত ছিল এমন ‘বাউলা হাটোতি বিছার দোকান বসাইছে দামান্দ গো বিছা কিনা দিলা না...’(বাউলা হাটে বিছার দোকান বসিয়েছে জামাই গো বিছা কিনে দিলে না)। ভাবার্থ এ রকম- গ্রামের বিয়েতে বধূকে সাজানো হচ্ছে। এ সময় শ্যালিকারা এই গীত গেয়ে বিছার দাবি জানাত। বগুড়া এলাকায় গ্রামে জামাইকে বলা হয় ‘দামান্দ’। অনেক গ্রামে তা এখনও প্রচলন আছে। একটা সময় সোনার গহনার পাশাপশি রুপার গহনাও জনপ্রিয় ছিল। বিশেষ করে পায়ের নূপুর, বিছা ও বাজু রুপার ছিল বেশি। বেশি ঘনত্বের মোটা নূপুরে নক্সা করা থাকত। এই নূপুর ছোট হয়ে আসে। নূপুরের মতো দেখতে এমন গহনার নাম হয় মল। একটা সময় নারী ব্লাউজের স্যান্ডো হাতা বানিয়ে বাহুতে বাজু পরত। বর্তমানে এই বাহুবন্ধনী ফিরে এসেছে। একদার ঘোমটা পরা নোলকবধূর নোলকও বড় হয়ে কান পর্যন্ত ঠেকেছে। কানের দুল বা ঝুমকা এখন এতটাই বড় যে মনে হবে এই বুঝি কানের লতি ছিঁড়ে পড়ে। ইমিটেশনের প্রায় প্রতিটি গহনার সঙ্গে বাহারি পাথর সেট করা। দোকানিরা বলেন, এসব পাথরের নাম রুবি, পান্না, হীরা, পোখরাজ, ফিরোজা। কোন পাথরকে নীলাও বলা হয়। তবে পাথর কতটা আসল এ নিয়েও প্রশ্ন আছে। নীলা পাথর নকল হলেও তা নিতে কিছুটা ভীতির সঞ্চার আজও হয়। কথায় আছে- নীলা পাথর কারও সয় কারও সয় না। ইমিটেশনের বেশিরভাগ গহনা গোল্ড ইলেক্ট্রোপ্লেটিং ও পার্ল করা। কোন গহনা দক্ষ মনিকার হাতের মিনার (বিশেষ ধরনের নক্সা) এমন কারুকাজ যা দেখেই মন ভরে যায়। দোকানিরা বলেন, এবার বেশিরভাগ গহনা এসেছে ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর থেকে। পিতল ও এ্যান্টিক্সের কিছু গহনা গোল্ড ইলেক্ট্রোপ্লেটিং করা। এর মধ্যে নতুনত্ব আছে। ইমিটেশনের বড় আকর্ষণ মোগলদের নক্সা। লেসের সঙ্গে কিছু পাথর ও পুঁতি এসেছে। লাল কালো রেশমি সুতার মধ্যে গাঁথা এসব পুঁতি দেখতে সুন্দর। ইমিটেশনের গহনার দাম সাধ্যের মধ্যে। ৫শ’ টাকা থেকে শুরু করে ৩১ হাজার টাকা পর্যন্ত আছে। প্রজন্মের তরুণী সঞ্চারী, নওরীন, জোশিতা, তৌষি, নওশীন, তাসমিম, পৃথ্বা, অরিত্রী, ইয়াসনা বলল গহনার নক্সার রুপান্তরে ঐতিহ্যও ফিরে এসেছে। আমাদের পূর্বসূরি নানি-দাদিরা যে গহনা পরতেন তা এখন তাদের নাতনিরা পরছে। এভাবেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। আর ইমিটেশনের গহনা দেখতে সুন্দর। আধুনিক গৃহবধূর কেউ কেউ বললেন : সোনার গহনার মূল্য তো আছেই। তা থাকবে। বর্তমান সময়ের ইমিটেশনের গহনা ঐতিহ্যের পরিচিতিও তুলে ধরছে। তাইবা কম কিসে।
×