ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

কিশোরগঞ্জের দুই রাজাকারের ফাঁসি

ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষণ ॥ মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষণ গণহত্যার শামিল

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২০ এপ্রিল ২০১৭

ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষণ ॥ মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষণ গণহত্যার শামিল

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে কিশোরগঞ্জের দুই রাজাকার মোঃ মোসলেম প্রধান ও পলাতক সৈয়দ মোঃ হাসান ওরফে হুসাইনকে মুত্যুদ- প্রদান করেছেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ে বলা হয়, আসামিদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণের মতো ৬টি অভিযোগই সন্দেহাতিতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আসামিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অথবা গুলি করে তাদের মৃত্যুদ- কার্যকর করা যাবে। একই সঙ্গে পলাতক মোঃ হাসান ওরফে হুসাইনকে গ্রেফতার করে সাজা কার্যকর করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের আইজিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। এ বিষয়ে প্রয়োজনে ইন্টারপোলের সহযোগিতা নিতে বলা হয়েছে। এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনারের ২৮তম রায়। এর আগে ৭ মার্চ এ মামলার উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষণার জন্য সিএভি ঘোষণা করা হয়। অন্যদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের সাত ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে নেত্রকোনার পূর্বধলার আব্দুর রহমানসহ ছয় রাজাকারের বিচার শুরু করেছে ট্রাইব্যুনাল। মুক্তিযুদ্ধের সময় অপহরণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও হত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের মধ্যে। চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বুধবার এ আদেশ প্রদান করেছেন। অন্য দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলাম ও বিচারপতি মোঃ সোহরাওয়ারদী। রায় ঘোষণার সময় ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী, প্রসিকিউটর হৃষিবেশ সাহা, প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সিমন, প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম, প্রসিকিউটর মোঃ মোখলেসুর রহমান বাদল, প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল, প্রসিকিউটর আবুল কালাম ও প্রসিকিউটর সাবিনা ইয়াসমিন খান, তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান। এ সময় আসামি মোসলেম প্রধানের স্ত্রী ও দুই মেয়ে উপস্থিত ছিলেন। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এ পর্যন্ত ২৮টি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এই সব মামলায় ৫৫ জন আসামি ছিলেন। দ- দেয়া হয়েছে ৫৩ জনকে। দুইজন আসামি সোলায়মান মোল্লা ও আব্দুল লতিফ রায় ঘোষণার আগেই মারা যান। এই ৫৩ জনের মধ্যে ৩০ জনকে মৃত্যুদ-, ২০ জনকে আমৃত্যু কারাদ-, একজনকে যাবজ্জীবন করাদ- প্রদান ও একজনকে ৯০ বছরের দ- প্রদান করা হয়। দ-প্রাপ্ত ও তদন্তাধীন মোট ৭৬ আসামি পলাতক রয়েছে। বুধবার সকাল ৯টার দিকে আসামি মোঃ মোসলেম প্রধানকে কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। এরপর রায় ঘোষণার আগে তাকে এজলাস কক্ষে তোলা হয়। অপর আসামি সৈয়দ মোঃ হাসান ওরফে হুসাইন পলাতক। তার কোন আত্মীয়স্বজনও উপস্থিত ছিলেন না। প্রসিকিউশনের তথ্য অনুযায়ী, তিনি বর্তমানে মালয়েশিয়া অবস্থান করছেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আদালত বসার পর ১১টার কিছুক্ষণ আগে কিশোরগঞ্জের দুই আসামির রায়ের কার্যক্রম শুরু হয়। তিন সদস্যের এ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হক প্রারম্ভিক বক্তব্যে জানান, তারা যে রায় দিতে যাচ্ছেন, তা এসেছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। পরে বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলাম রায়ের সার সংক্ষেপ পড়া শুরু করেন। অপর বিচারপতি মোঃ সোহরাওয়ারদীও রায়ের দ্বিতীয় অংশ পড়েন। সবশেষে বিচারপতি আনোয়ারুল হক সাজা ও দ- ঘোষণা করেন। ছয় অভিযোগের মধ্যে তৃতীয় অভিযোগে নিকলীর গুরুই গ্রামে নির্বিচারে ২৬ জনকে হত্যার দায়ে সর্বসম্মতভাবে দুই আসামিকে মৃত্যুদ- দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। চতুর্থ অভিযোগে নিকলীর নানশ্রী গ্রামে হিন্দু নারীদের ধর্ষণ ও হিন্দুদের আটকে রেখে নির্যাতনের পর ৩৪ জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় আসামি হুসাইনের সর্বোচ্চ সাজার রায় এসেছে। একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নারীদের টার্গেট করে ব্যাপক হারে ধর্ষণের ঘটনাকে আদালত বিবেচনা করেছে গণহত্যার সমতুল্য অপরাধ হিসেবে। পঞ্চম অভিযোগে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুল মালেককে ধরে নিয়ে হত্যার ঘটনায় আসামি সৈয়দ মোঃ হাসান ওরফে হুসাইন ও মোঃ মোসলেম প্রধানকে সর্বসম্মতভাবে আমত্যুকারাদ- দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া আরও তিন অভিযোগে আসামি হুসাইনের মোট ২২ বছরের কারাদ-ের রায় এসেছে ট্রাইব্যুনালে। মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, দুই আসামি একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তাদের মধ্যে হুসাইন নিকলী থানা এলাকায় ‘রাজাকার দারোগা’ হিসেবে এবং মোসলেম প্রধান নিকলী ইউনিয়নে রাজাকার কমান্ডার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তারা তখনকার কিশোরগঞ্জ মহকুমার বিভিন্ন স্থানে ব্যক্তিগত ও যৌথভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন বলে এ মামলার বিচারে উঠে এসেছে। হুসাইনের বড় ভাই সৈয়দ মোঃ হাসান ওরফে হাছেন আলীকেও যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃতুদ- দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। ভাইয়ের মতো হাছেন আলীও পলাতক। ধর্ষণ গণহত্যার শামিল একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হওয়া ধর্ষণ গণহত্যার শামিল। বুধবারের কিশোরগঞ্জের দুই রাজাকারের রায়ের মধ্য দিয়ে এ বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে বলে দাবি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন। দুই রাজাকার সৈয়দ মোঃ হোসেন ওরফে হুসাইন ও মোঃ মোসলেম প্রধানের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণার সময় ট্রাইব্যুনাল এ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। রায়ের পর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বলেন, প্রথমবারের মতো এ স্বীকৃতি মিলেছে। যুদ্ধকালীন সময়ে গণধর্ষণ গণহত্যার শামিল। যেটাকে জেনোসাইডাইল রেপ বলা হয়েছে। যার শাস্তিুও মৃত্যুদ-। এছাড়াও আন্তর্জাতিক প্রথাগত আইনের মধ্যে যুদ্ধ আইনের বিষয়গুলো এ মামলায় স্থান পেয়েছে। এটিও আমাদের একটি সাফল্য। এমনকি এ মামলায় আমরা ছয়টি অভিযোগই প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। ‘আমরা অনেক চেষ্টা করেছি মুক্তিযুদ্ধের সময় হওয়া ধর্ষণকে জেনোসাইড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। দালিলিক সাক্ষ্য প্রমাণেও কোন ঘাটতি না থাকে সেদিকে সচেষ্ট ছিলাম। অবশেষে ট্রাইব্যুনাল বুধবার এই রায়ের মধ্য দিয়ে যুদ্ধকালীন ধর্ষণকে জেনোসাইড ঘোষণা দিলেন।’ তিনি আরও বলেন, দুই রাজাকারের বিরুদ্ধে আনা চতুর্থ অভিযোগে তারা ধর্ষণকে জেনোসাইড হিসেবে হাজির করেছিলেন এবং ট্রাইব্যুনাল এই অভিযোগে আসামিদের মৃত্যুদ-ের আদেশ দিয়েছেন। দ-প্রাপ্তদের বিরুদ্ধে থাকা ছয় অভিযোগের মধ্যে চতুর্থ অভিযোগ অনুযায়ী, নিকলীর নানশ্রী গ্রামে হিন্দু নারীদের ধর্ষণ ও হিন্দুদের আটকে রেখে নির্যাতনের পর ৩৪ জনকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আসামি হোসেনের মৃত্যুদ-ের রায় এসেছে। একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নারীদের চিহ্নিত করে ধর্ষণের ঘটনাকে আদালত বিবেচনা করেছে জেনোসাইডের সমতুল্য বলে বিবেচনায় নিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
×