ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

এক কর্মজীবী মায়ের স্বস্তির উচ্চারণ

ডে কেয়ারে সন্তানকে রাখতে পারছি বলেই চাকরিটা করছি

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১১ মার্চ ২০১৭

ডে কেয়ারে সন্তানকে রাখতে পারছি বলেই চাকরিটা করছি

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ রাজধানীর আদাবরে অবস্থিত সরকারী শিশু দিবাযতœ কেন্দ্রে সন্তানকে রেখে চাকরিতে যান তাহমিনা খন্দকার। এই দিবাযতœ কেন্দ্রের মান নিয়ে বেশ সন্তুষ্ট তিনি। বৃহস্পতিবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেল, ৯টি শিশু দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এখানে সরকার থেকেই বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহ করা হয়। মাসিক খরচ শিশুপ্রতি মোটে ৫০০ টাকা। ধারণ ক্ষমতা ৫০ জন। একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে এইচআর পদে চাকরি করছেন তাহমিনা। তিনি জানালেন, ‘পরিবারের এমন কেউ নেই যে আমার সন্তানকে দেখভাল করবে। এছাড়া, চাকরিটা আমার জন্য খুবই দরকারি। আমার প্রতিষ্ঠানে কোন ডে-কেয়ার নেই। তাই কি আর করার! আমার চার বছরের ছেলেকে এখানে রেখে অফিসে যেতে বেশ স্বস্তি পাই। পরিবেশ ভাল এখানকার। ডে-কেয়ারে সন্তানকে রাখতে পারছি বলেই, চাকরিটা করছি।’ তাহমিনার মতো অনেক কর্মজীবী মায়ের শেষ ভরসা শিশু দিবাযতœ কেন্দ্রগুলো। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত এমনকি উচ্চবিত্তদের সন্তানদের জন্য এখন দিবাযতœ কেন্দ্র রয়েছে। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কর্মজীবী মায়েদের জন্য বাড্ডা, আদাবর, ডেমরা, গাবতলী, মিরপুর-১০, জিগাতলা, সাভার, রাজারবাগ, উত্তরা, নাখালপাড়া (মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সংলগ্ন) ও প্ল্যানিং কমিশন চত্বর, শের-ই-বাংলানগরসহ সরকারীভাবে মোট ৪৩টি শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। এসব ডে-কেয়ার সেন্টার শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে এসব কেন্দ্রে শিশুদের অংশগ্রহণে নানা ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। শিশুরা নাচ-গান, কবিতা আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায়। এছাড়া, ডে-কেয়ার সেন্টারসমূহে শিশুদের চিত্তবিনোদনের জন্য রয়েছে বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণীয় খেলার সামগ্রী, টিভি, ডিভিডি ইত্যাদি। সেইসঙ্গে বছরে একবার শিশুদের ও অভিভাবকদের অংশগ্রহণে বার্ষিক বনভোজনের ব্যবস্থা রয়েছে প্রকল্পে। ডে-কেয়ার সেন্টারের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে প্রতিমাসে মাদার্স মিটিং করা হয়। সেখানে খোলামেলাভাবে তাদের সন্তানদের যতœ নেয়ার বিষয়ে সেন্টারের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন এবং বিভিন্ন পরামর্শ প্রদান করেন। তাদের কোন অভিযোগ থাকলে সে বিষয়ে তারা কথা বলার সুযোগ পান। মাদার্স মিটিং-এ মায়েদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, শিক্ষা, স্যানিটেশন, পরিবার পরিকল্পনা, বাল্যবিবাহ, সামাজিক সচেতনতা ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান প্রদান করাও হয়ে থাকে। মহিলা ও শিশু অধিদফতরের তথ্যমতে, মহিলাবিষয়ক অধিদফতরের আওতায় সরকারী খাতে রাজস্ব বাজেটে সারাদেশে ৩২টি এবং উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় মোট ১১টি অর্থাৎ মোট ৪৩টি দিবাযতœ কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। এগুলোর মোট ধারণ ক্ষমতা প্রায় তিন হাজার শিশু। ইতিমধ্যেই, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ মহানগরীতে পর্যাপ্ত ও প্রতিটি জেলায় একটি করে দিবাযতœ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া, ঢাকা মেট্রোপলিটন সিটিতে ১০টি এবং ১০টি জেলা সদরে ১০টি অর্থাৎ মোট ২০টি শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে মোট ৫৯ কোটি ৮৮ লাখ ৪৯৮ হাজার টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরেছে। ২০১৬ সালের মার্চ মাস হতে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য এই প্রকল্পটি অনুমোদন করেছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জন্য দুধরনের শিশুদিবাযতœ কেন্দ্র থাকলেও সরকারী প্রকল্পের আওতাধীন উচ্চবিত্তদের জন্য নেই কোন ডে-কেয়ার সেন্টার। এ প্রসঙ্গে মহিলা অধিদফতরের মহা-পরিচালক সাহিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘এতদিন পর্যন্ত সরকারী ডে কেয়ার সেন্টারগুলো শুধুমাত্র মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের জন্য ছিল। এখন উচ্চবিত্তদের জন্য ব্যয়বহুল ডে-কেয়ার সেন্টার নির্মাণের দিকেও মনযোগী হয়েছি আমরা।’ রাজধানীতে সরকারী শিশু দিবাযতœ কেন্দ্রের পাশাপাশি বেসরকারী উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত শিশু দিবাযতœ কেন্দ্রের মধ্যে মধ্যবিত্তদের জন্য ঢাকার বনশ্রী এলাকায় আছে ‘চাইল্ড চিয়ার’, শ্যামলীতে ‘এসওএস চিলড্রেন ভিলেজ’, আজিমপুরে ‘বেবি হোম’, মণিপুরীপাড়ায় ‘দি ডে-কেয়ার সেন্টার’, দরিদ্র শিশুদের জন্য ‘মারিয়া ক্রিস্টিনা ফাউন্ডেশন’, তৈরি পোশাক কারখানায় কর্মরত মায়েদের শিশুদের জন্য ‘ফুলকি’, আসাদ এভিনিউয়ে ‘রেডসান’ প্রভৃতি। এ ছাড়া বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব শিশু দিবাযতœ কেন্দ্রও রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, আইসিডিডিআরবি, গ্রামীণফোন প্রতিষ্ঠানে শিশুর দিবযতœ কেন্দ্র আছে। শ্যামলীর ‘এসওএস চিলড্রেন ভিলেজ’ সেন্টারে গিয়ে দেখা গেল, প্রায় ৩৫ জন শিশু আছে। যাদের বয়স ৬মাস থেকে ৯ বছর পর্যন্ত। নিজের তিন বছরের শিশুকে নিতে এসে একজন কর্মজীবী মা বলেন, কর্মস্থল বা তার আশপাশে যদি ডে- কেয়ার সেন্টার থাকে তাহলে চিন্তামুক্ত থাকা যায়। আমাদের মতো কর্মজীবী মায়েদের এখন শেষ ভরসা ডে-কেয়ার সেন্টারগুলো। সরকারী ডে-কেয়ারের চেয়ে অবশ্য বেসরকারীগুলোতে ফি একটু বেশি। কিন্তু আমার কর্মস্থলের আশপাশে সরকারী কোন ডে-কেয়ার নেই। তাই এখানেই বাচ্চাকে রেখে যায়। এখানকার পরিবেশ ভাল।’ সরকারী ও বেসরকারীভাবে শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র স্থাপনের ফলে অনেক সুফল রয়েছে বলে মনে করেন ডে-কেয়ার সেন্টারের পরিচালক এবং মায়েরা। তাদের মতে, ডে- কেয়ার সেন্টারে অবস্থান করায় শিশুর সামাজিক দক্ষতা বাড়ে। পরিবারের বাইরের অন্যান্য শিশু ও অভিভাবকদের সঙ্গে মেলামেশার মাধ্যমে শিশু অনেক কিছু শিখতে পারে। এ ছাড়া, একই সঙ্গে খাওয়ার টেবিলে বসে খাওয়া, খেলার মাঠে বা বিছানায় যাওয়া, যতœকারীর নির্দেশ মান্য করার অভ্যাস, শিক্ষকের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করা ইত্যাদির ফলে শিশুদের মধ্যে খুব ছোট বয়স হতেই শৃঙ্খলাবোধ গড়ে ওঠে। যেসব শিশু বাড়িতে খাওয়া নিয়ে বিরক্ত করে, তারাও অন্যান্য শিশুর দেখাদেখি ঠিকমতো খায়। একটা শিশুর সঙ্গে আরেকটি শিশুর মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে। এতে শিশুর সামাজিকীকরণ ত্বরান্বিত হয়।
×