ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

সেনাবাহিনীর একাংশের ক্ষমতা দখলের চেষ্টা ;###;গোলাগুলিতে নিহত ২৬৫, আহত দুই হাজার ;###;২৮৩৯ সেনাসদস্য আটক ;###;পাঁচ জেনারেল ও ২৯ কর্নেল বরখাস্ত ;###;পার্লামেন্ট ভবন, প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ, প্রধান প্রধান বিমানবন্দরসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা;###;ভাগ্যক্রমে

তুরস্কে রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থান ব্যর্থ

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১৭ জুলাই ২০১৬

তুরস্কে রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থান ব্যর্থ

নাজিম মাহমুদ ॥ ফ্রান্সে নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ধাক্কা কাটতে না কাটতেই এবার রক্ত ঝরল তুরস্কে। শুক্রবার গভীর রাতে ন্যাটো জোটভুক্ত তুর্কি সেনাবাহিনীর একাংশ সে দেশের ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানকে উৎখাতে অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালায়। ট্যাঙ্ক ও অন্যান্য সাঁজোয়াযানসহ রাস্তায় নামে সেনা সদস্যরা। তুরস্কের পার্লামেন্ট ভবন, প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ, প্রধান প্রধান বিমানবন্দর, সেতু, পুলিশ সদর দফতরসহ অন্যান্য স্থাপনায় হামলা চালিয়ে বিদ্রোহী সেনা সদস্যরা এরদোগানের ১৩ বছরের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবসান দাবি করে। আকাশে বিদ্রোহীদের বিমান চক্কর দিতে দেখা যায়। রাস্তায় রাস্তায় পাহারা বসায় সেনা সদস্যরা। অল্প সময়ের মধ্যেই গণমাধ্যমসহ কয়েকটি সরকারী ভবনের নিয়ন্ত্রণ নেয় তারা। তবে এরদোগান সরকার এ অভ্যুত্থান চেষ্টা ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হয়। আঙ্কারা ও ইস্তানবুলে সারারাত গোলাগুলি চলে। দেশটির অন্যান্য শহর থেকেও সহিংসতার খবর এসেছে। তুর্কি সেনাবাহিনীর একাংশের পক্ষ থেকে পাঠানো এক ই-মেল বার্তায় বলা হয়েছে, সরকারের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই চলবে। এ বিদ্রোহী সেনারা নিজেদের পিস অব হোম মুভমেন্টের সমর্থক বলে দাবি করে। তবে এ ঘটনার পেছনে ঠিক কে কলকাঠি নেড়েছে তা আপাতত স্পষ্ট না হলেও মনে করা হচ্ছে এরদোগানের এক সময়ের মিত্র ফেতুল্লাহ গুলেনের সমর্থক সেনা সদস্যরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। বিশ্ব নেতারা এরদোগানের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন। খবর বিবিসি, এএফপি ও আলজাজিরা অনলাইনের। খবরে বলা হয়েছে, এ ঘটনার সময় প্রেসিডেন্ট রাজধানীতে ছিলেন না। তিনি মারমারিস শহরে অবকাশযাপনে ছিলেন। এ সময় এরদোগান যে হোটেলে অবস্থান করছিলেন সে হোটেলও হামলার শিকার হয়। তবে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি। পরে শুক্রবার রাতের এ অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে ক্ষমতাসীন একে পার্টির সমর্থকরা। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এ অভ্যুত্থান চেষ্টার ঘটনায় অন্তত ২৬৫ জন নিহত ও দুই হাজার লোক আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে দেড় শতাধিক সেনা সদস্য রয়েছেন। এ অভ্যুত্থান চেষ্টার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে উচ্চপর্যায়ের সেনা সদস্যসহ অন্তত দুই হাজার ৮৩৯ জনকে আটক করা হয়েছে। গ্রীসে আশ্রয় নিয়েছে অন্তত আট সেনা সদস্য। সামরিক বাহিনীর সব অংশের সমর্থন না থাকা এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের তৎপরতায় জনগণ রাস্তায় নেমে এলে বিদ্রোহী সেনাদের অভ্যুত্থান চেষ্টা ভেস্তে যায়। পরে পুলিশ বিদ্রোহী সেনাদের আটক করে। প্রথমে এরদোগান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা দখলের দাবি করে বিবৃতি দেয় বিদ্রোহী সেনারা। এতে বলা হয়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও মানবাধিকার রক্ষার স্বার্থে সশস্ত্র বাহিনী তুরস্কের ক্ষমতা দখল করেছে। টেলিভিশনের পর্দায় পড়ে শোনানো ওই বিবৃতিতে বলা হয়, এখন ‘শান্তি পরিষদ’ দেশ চালাবে এবং সান্ধ্য আইন ও সামরিক আইন জারি থাকবে। একই সঙ্গে তুরস্কের বিদ্যমান বৈদেশিক সব সম্পর্ক বহাল থাকবে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা প্রাধান্য পাবে। পরে রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান তড়িঘড়ি করে শনিবার প্রথম প্রহরে ইস্তানবুল পৌঁছে বিমানবন্দরে এক ভাষণে বলেন, অভ্যুত্থানকারীরা রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ করেছে, তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হচ্ছে। ভাষণে এরদোগান আরও বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তিনি বলেন, আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি এবং শেষ পর্যন্ত কাজ করে যাব। আর এ প্রচেষ্টায় জড়িতদের চড়া মূল্য দিতে হবে। তুরস্ককে কোন দখলদারের কাছে দেয়া হবে না। তুরস্কের কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলেছেন, অভ্যুত্থান হোঁচট খেয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম বলেছেন, পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে। বিদ্রোহীদের আইনের মুখোমুখি করা হবে। এ অভ্যুত্থান চেষ্টাকে তুর্কি গণতন্ত্রের জন্য কালো দিন বলে আখ্যা দেন তিনি। বিশ্ব নেতারা এ ঘটনায় এরদোগানের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তার পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেনÑ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন, জাতিসংঘ, ন্যাটো প্রধান, চীন, ইরান ও ইসরাইলসহ অন্যান্য দেশ। এ অভ্যুত্থান চেষ্টার একদিন পার না হতেই ভারপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান নিয়োগ করেছে তুরস্ক। দেশটির সিনিয়র এক কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন। ওই কর্মকর্তা জানান, তুরস্কের স্থলবাহিনীর প্রধান উমিত দুন্দারকে ভারপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাঁকে উদ্ধৃত করে আলজাজিরার রিপোর্টে বলা হয় পাঁচ জেনারেল ও ২৯ কর্নেলকে বরখাস্ত করা হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির মধ্যকার টেলিফোনালাপের বিস্তারিত উল্লেখ করে হোয়াইট হাউস থেকে বলা হয়েছে, তুরস্কের সকল পক্ষের উচিত গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে সমর্থন, সংযম প্রদর্শন এবং সহিংসতা পরিহার করা। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সমালোচনা করেন এবং দেশটিতে বেসামরিক সরকারের শাসন জারি রাখার আহ্বান জানান। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, যে কোন রাষ্ট্রে সামরিক হস্তক্ষেপ অগ্রহণযোগ্য। ইইউ প্রধান ডোনাল্ড টাস্ক ও জ্যাঁ ক্লদ জাংকার এরদোগান সরকারকে সমর্থন দিয়ে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার আহ্বান জানান। ক্রেমলিন মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ সাংবাদিকদের বলেন, তুরস্কের পরিস্থিতি নিয়ে রাশিয়া গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এর আগে রক্তপাত পরিহার করে সংবিধান অনুযায়ী সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন। সোমবার অনুষ্ঠেয় ইইউর পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে সম্ভবত তুরস্কের বিষয়টিই প্রাধান্য পাবে। বৈঠকে কেরিও অংশ নিচ্ছেন। ন্যাটো প্রধান জ্যাঁ স্টোলেনবার্গ তুরস্কে সকলকে শান্ত ও সংযত থাকার আহ্বান এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও সংবিধানের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, তুরস্ক ন্যাটোর গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক দলের মনোনীত প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন সংযত থাকতে এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সহিংসতা এড়িয়ে গণতান্ত্রিক শৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। একই সুরে কথা বলেছেন জার্মান চ্যান্সেলর এ্যাঙ্গেলা মের্কেল। প্রতিবেশী দেশ ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ বলেছেন, তারা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। কে এই ফেতুল্লাহ গুলেন ॥ অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত বলে যার দিকে ইঙ্গিত করা হচ্ছে, তিনি হচ্ছেন ফেতুল্লাহ গুলেন। প্রেসিডেন্ট এরদোগানের এক সময়কার ঘনিষ্ঠ মিত্র গুলেন যুক্তরাষ্ট্র থাকেন। তিনি একজন ধর্মীয় নেতা। তার হিজমেত আন্দোলনের বিরাট সমর্থন আছে তুরস্কে। এরা নানা ধরনের স্কুল, কলেজ, এনজিও এবং ব্যবসা পরিচালনা করে। তাদের আছে অনেক মিডিয়া প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ফেতুল্লাহ গুলেনের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে কয়েক বছর আগে। প্রেসিডেন্ট এরদোগান কঠোর সব ব্যবস্থা নেন হিজমেত আন্দোলনের বিরুদ্ধে। অভ্যুত্থানের পেছনে এদের হাত আছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান এবং তার দলের নেতারা। তবে ফেতুল্লাহ গুলেন জোর গলায় তা অস্বীকার করেছেন। লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার ॥ বিদ্রোহী সেনা সদস্যদের আত্মসমর্পণ এবং স্থাপনাগুলোর নিয়ন্ত্রণ সরকার নিলেও অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষ থেকে এক ই-মেল বার্তায় লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা এসেছে। নিজেদের ‘পিস অব হোম মুভমেন্ট’ পরিচয় দিয়ে ই-মেলে লড়াইয়ের এ সময়ে জনসাধারণকে ঘরে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
×