ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

গুলশানে জঙ্গী হামলায় দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়নি ॥ পররাষ্ট্রমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৪ জুলাই ২০১৬

গুলশানে জঙ্গী হামলায় দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়নি ॥ পররাষ্ট্রমন্ত্রী

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রেখেই বিদেশীদের সহায়তা নেয়া হবে। জঙ্গী হামলা এখন বৈশ্বিক হওয়ায় গুলশান হামলার প্রেক্ষিতে বিদেশে বাংলাদেশের কোন ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়নি। বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এসব কথা বলেন। এদিকে এশিয়া-ইউরোপ মিটিংয়ের (আসেম) ১১তম শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বৃহস্পতিবার মঙ্গোলিয়া যাচ্ছেন। আগামী ১৫-১৬ জুলাই মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাটোরে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এশিয়া-ইউরোপ মিটিংয়ের (আসেম) ১১তম শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণের বিষয়ে অবহিত করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে বক্তব্য রাখেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হকও উপস্থিত ছিলেন। এ সময় বাংলাদেশের চলমান ঘটনার বিষয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নেরও উত্তর দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী। গুলশানে হামলার প্রেক্ষিতে বিদেশী বিশেষ করে মার্কিন সহায়তা নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জানান, বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রেখেই জঙ্গী ও সন্ত্রাস দমনে সব দেশের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় কারিগরি ও প্রশিক্ষণ সহযোগিতা নেয়া হবে। রাজধানীর গুলশান ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় হামলার পর বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে কি-না, জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, ওই ঘটনায় কোনভাবেই বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। কেননা জঙ্গীবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যায় রূপ নিয়েছে। এটি সেই সমস্যারই অংশ। যেভাবে হামলা হয়েছে, বিশেষ কোন দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হওয়ার সুযোগ নেই। তবে এ অপশক্তিকে প্রতিহত ও পরাজিত করতে হবে। এজন্য একবাক্যে সব বন্ধুপ্রতিম দেশ বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়েছে। এ সময় তিনি বিভিন্ন দেশের সমর্থন ও সহযোগিতার বিষয়ে উল্লেখ করেন। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া আর কোন কোন দেশ জঙ্গী হামলা প্রতিরোধে বাংলাদেশকে কী ধরনের সহায়তা দিতে চাইছেÑ জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, চোখ-কান খোলা রাখুন জানতে পারবেন। বাংলাদেশে সম্প্রতি জঙ্গী হামলার ঘটনা নিন্দনীয় ও দুঃখজনক উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এ শোককে আমরা শক্তিতে পরিণত করেছি। পৃথিবীর যেখানে এ নিয়ে সম্মিলিতভাবে কাজ করার সুযোগ রয়েছে, সেখানেই বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করছে। গুলশান হামলার প্রেক্ষিতে জাপানের সাহায্য সংস্থা জাইকার সঙ্গে বাংলাদেশের নেতিবাচক কোন প্রভাব পড়বে কি-না, জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, গুলশানে হামলার পর জাইকাপ্রধান বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, তারা বাংলাদেশে সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত রাখবেন। এছাড়া গুলশান হামলার পর এক জাপানী দেশে ফিরে গিয়ে জানিয়েছেন, তিনি আবারও বাংলাদেশে আসবেন। এসব ঘটনা থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, জাপানের সঙ্গে সম্পর্কের কোন প্রভাব পড়বে না। জঙ্গী ও সন্ত্রাসী হামলা কিভাবে সরকার মোকাবেলা করবেÑ এমন প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, বাংলাদেশের মানুষ জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ পছন্দ করে না। সাধারণ মানুষ নিজেরাই জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে। ঈদের দিন শোলাকিয়ায় এমন হামলার পরও সাধারণ মানুষ সিলেট ও কক্সবাজারে বেড়াতে গেছেন। মানুষ এসব হামলাকে জঙ্গী হামলা হিসেবেই দেখছেন, তবে তারা ভয় পাননি। প্রধানমন্ত্রী আসেম শীর্ষ সম্মেলনে যাচ্ছেন ॥ এশিয়া-ইউরোপ মিটিংয়ের (আসেম) একাদশ শীর্ষ সম্মেলন ১৫-১৬ জুলাই মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাটোরে অনুষ্ঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তাবৃন্দ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে বিশেষ ফ্লাইটে উলানবাটোরের উদ্দেশে রওনা দেবেন। আগামীকাল শুক্রবার উলানবাটোরের সাংরি লা হোটেলে আসেম শীর্ষ সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হবে। যেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীসহ ইউরোপ ও এশিয়ার ৩৩ দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানগণ, আসিয়ানের মহাসচিব, ইউরোপিয়ান কাউন্সিল এবং ইউরোপিয়ান কমিশনের সভাপতি ছাড়াও ১৭ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা উপস্থিত থাকবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, আসেম সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্লেনারি সেশনে অংশগ্রহণ করবেন। সেখানে তিনি ‘আসেমের বিশ বছর : ভবিষ্যতের আন্তঃযোগাযোগের জন্য অংশীদারিত্ব’ বিষয়ে বক্তব্য প্রদান করবেন। প্রধানমন্ত্রী সামিটের পাশাপাশি সাইডলাইনে কয়েকটি দেশের সরকারপ্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হবেন। এক প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আসেম সম্মেলনের সাইডলাইনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের উপ-রাষ্ট্রপতি ড. হামিদ আনসারি, জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে, রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভ, জার্মান চ্যান্সেলর এ্যাঙ্গেলা মেরকেল, নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট, ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাওলো গেন্টিলোনি, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট জাঁ ক্লদ ইয়োঙ্কা বৈঠক করবেন। বিশ্বের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের বিষয়েও আলোচনা করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আসেম শীর্ষ সম্মেলনের সাইডলাইনে বাংলাদেশ ও জাপান যৌথভাবে একটি সন্ত্রাস ও জঙ্গীবিরোধী সেমিনারের আয়োজন করবে। সেখানে দুই দেশই জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তাদের দৃঢ় অবস্থান জানাবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এশিয়া ইউরোপ মিটিং (আসেম) এশিয়া ও ইউরোপের সদস্য দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংগঠন, যার উদ্দেশ্য হলো এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও উন্নয়ন সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ করা। ১৯৯৬ সালে আসেম ১৫ ইইউ সদস্য দেশ, ৭ আসিয়ান সদস্য দেশসহ চীন, জাপান, কোরিয়া এবং ইউরোপীয় কমিশনের অংশীদারিত্বের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। আসেম শীর্ষ সম্মেলন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান, ইউরোপীয় কাউন্সিলের সভাপতি, ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সংস্থার (আসিয়ান) মহাসচিবের সমন্বয়ে প্রতি দুই বছর পর অনুষ্ঠিত হয়। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত ২৮ দেশসহ ইউরোপের ৩০, এশিয়ার ২১ এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও আসিয়ান সচিবালয়সহ সর্বমোট ৫৩ সদস্যের সংগঠন আসেম। আসেম বিশ্ব জনসংখ্যার ৬২ দশমিক ৩ শতাংশ, বৈশ্বিক জিডিপির ৫৭ দশমিক ২ শতাংশ এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যের ৬০ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে। আসেম ১৯৯৩ সালে ইইউভুক্ত ১৫ দেশ ও আশিয়ান সাতটি দেশ ছাড়াও চীন, জাপান, কোরিয়া ও ইউরোপিয়ান কমিশন নিয়ে যাত্রা করে। প্রথম সম্মেলন ১৯৯৬ সালে ব্যাঙ্ককে অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ২০১২ সালে আসেমের ৯ম সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক সদস্য পদ লাভ করে। ১১তম আসেম শীর্ষ সম্মেলন বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এ সম্মেলনে এশিয়া ও ইউরোপের উন্নয়ন, সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযান, অভিবাসন সঙ্কট মোকাবেলা, কানেক্টিভিটিসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়সমূহ আলোচিত হবে। এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে সংযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে আসেমের ভবিষ্যত কাজের পদ্ধতি নির্ধারণসহ জলবায়ু পরিবর্তন, টেকসই উন্নয়ন ও বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থা, দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস ও ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হবে। বাংলাদেশের জন্য আসেম সম্মেলন অত্যন্ত কার্যকর একটি ফোরাম। এ সম্মেলনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বহুবিধ সুবিধা অর্জন করতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের রফতানির একক বৃহত্তম বাজার এবং অন্যতম প্রধান উন্নয়ন অংশীদার। আসেম প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে এশিয়ার দেশসমূহের সম্মিলিত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ ইউরোপীয় দেশসমূহের সঙ্গে তার স্বার্থ সমুন্নত রাখার কাজটি করতে পারে। আসেম অন্যান্য দেশের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক মতবিনিময় করার পর্যাপ্ত সুযোগ প্রদান করে, যা বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
×