ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বরিশালের জেলেপল্লী

সুই-সুতোয় কাপড়ের পুতুল, স্বপ্ন বোনে নারী

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ৭ জুন ২০১৬

সুই-সুতোয় কাপড়ের পুতুল, স্বপ্ন বোনে নারী

খোকন আহম্মেদ হীরা ॥ পরিবারের ভরণপোষণ ও জীবিকার জন্য বরিশালের জেলেপাড়ার প্রায় সব পুরুষই উদয়-অস্ত মাছ শিকারে ব্যস্ত সময় পার করেন উত্তাল সমুদ্রে কিংবা নদীতে। মাসের অধিকাংশ সময়ই তাদের রাত কাটে খোলা নদী কিংবা সমুদ্রের বুকে মাছ ধরার নৌকা বা ট্রলারে। এমনও সময় যায়, টানা রাতের পর রাত তাদের ব্যস্ত সময় কাটাতে হয় মাছ শিকারে। সে সময়টাতে বরিশাল সদর উপজেলার চন্দ্রমোহন ইউনিয়নের আদর্শ গ্রামের জেলেপাড়ায় টানাপোড়েনে জর্জরিত প্রতিটি ঘরে আরও বেশি করে দেখা দেয় অর্থের টানাটানি। মাছ শিকার শেষে বাড়ির পুরুষ বা ছেলেরা ফিরে যান দাদন ব্যবসায়ী ও মহাজনদের কাছে। সেখানে দেনা শোধের পর যেটুকু অর্থ হাতে থাকে তা দিয়ে সংসারের চাহিদা মেটে না কোন পরিবারেরই। তার ওপর রয়েছে বছর-বছর নৌকা সংস্কার, দৈনন্দিন ধারদেনা পরিশোধ, চিকিৎসা খরচসহ উৎসব-পার্বণের ধাক্কা। এভাবেই বছরের পর বছর অলিখিত নিয়ম মেনে চলছে জেলার অধিকাংশ জেলেপল্লীর মানুষের জীবন-জীবিকা। কুবের কিংবা মালাদের মতোই হাসি-কান্নায় তারা জীবন পাড়ি দিয়ে আসছেন। সম্প্রতি বরিশালের এসব জেলেপল্লীতে নতুন দিনের স্বপ্ন ও অবলম্বন হয়ে এসেছে সুই-সুতোর ফোঁড়ে হাতে তৈরি কাপড়ের পুতুল। অবসর সময়ে জেলেপল্লীর ঘরে-ঘরে গৃহবধূ, তরুণী ও কিশোরীরা তৈরি করছেন হরেক নক্সার বাহারি রঙের পুতুল। কাপড়ের তৈরি এসব পুতুল বুনেই জেলেপাড়ার নারীরা পুরুষের পাশাপাশি সংসারকে এগিয়ে নেন। একই সঙ্গে তারা বুকের গহীনে বুনেন অনাগত দিনের স্বাবলম্বী পরিবারের স্বপ্ন। আদর্শ গ্রামসহ অন্যান্য জেলেপল্লীর নারীরা পুতুল তৈরির পাশাপাশি নক্সাদার পাটি বোনাসহ অন্যান্য হস্তশিল্পের কাজ করছেন। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা (জেলেরা) যখন নদীতে মাছ ধরতে যান কিংবা বছরের নির্ধারিত যে সময়গুলোতে মাছ ধরা বন্ধ থাকে, সে সময়গুলোতে তাদের পরিবারের নারী সদস্যরাই সংসার পরিচালনায় বড় ভূমিকা রাখেন। জীবনযুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার পথকে তারা আরও সুগম করে তোলেন। আদর্শ গ্রামের জেলেপাড়ায় ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই নারী সদস্যরা পুতুল তৈরির কাজ করছেন। এছাড়া কেউ সেলাই, কেউ পাটি বোনা, কেউবা আবার নক্সার কাজ করছেন। গৃহবধূরা জানান, তাদের গ্রামে সুতা দিয়ে পুতুল তৈরির কাজ করতে পারেন এমন অর্ধশতাধিক পরিবারে শতাধিক নারী রয়েছেন। বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডিএ’র মাধ্যমে তারা গত বছরের নবেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে হাতে পুতুল তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। মুন্নি আক্তার ও সমিতা রানী নামের দুই নারীর তত্ত্বাবধানে কাজ শেখার পর এখন তারা নিজেরাই পুতুল তৈরি করেন। তবে পুতুল তৈরির উপকরণ যেমন কুশিকাঁটা, সুতা, তুলা ও ঝুনঝুনি প্রাথমিকভাবে ওই এনজিও থেকেই সরবরাহ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ওই এনজিওর মাধ্যমে জেলেপাড়ার গৃহবধূরা বিদেশে রফতানি করার জন্য পুতুল তৈরির কাজ পেয়েছেন। গ্রামের বাসিন্দা জেলে মামুন মিয়া জানান, বেশিরভাগ পুরুষই নদী কিংবা সাগরে মাছ শিকার করেন। আদর্শ গ্রামের জেলেদের কার্ড রয়েছে। এখানে সরকারী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কেউ মাছ শিকার করেন না। যখন নিষেধাজ্ঞা থাকে, তখন তাদের সাময়িক বেকারত্ব দেখা দেয়। সরকারের পক্ষ থেকে যে চাল ও সহায়তা দেয়া হয়, তা দিয়ে কিছুটা উপশম হলেও তাদের অন্যত্র কাজের সন্ধান করতে হয়। তিনি আরও জানান, আবার অনেক জেলে পরিবারকেই দাদন ব্যবসায়ী ও মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে জাল ও নৌকা মেরামতের কাজ করতে হয়। এ কারণে তাদের ঋণের বোঝা বেড়ে যায়। মামুন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে পরিবারের নারীরা ছোটখাটো কাজ করে অর্থের যোগান দিচ্ছেন। এটা পরিমাণে অল্প হলেও অনেক সহায়ক। ফলে পুরুষরা পরিবারের নারী সদস্যদের হস্তশিল্প ও অন্যান্য কাজে উৎসাহ দিতে শুরু করেছেন। পাশাপাশি গ্রামের মেয়েরা এখন স্কুলেও যাচ্ছে। এরই মধ্যে পুতুল তৈরির কাজটি গ্রামে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। গ্রামের জেলে পরিবারের মেয়ে কিশোরী সুমী আক্তার জানায়, প্রশিক্ষণ শেষ হতে না হতেই তারা ৩শ’ পিস পুতুল তৈরির অর্ডার পেয়েছে। এগুলো তাদের ইউনিটে থাকা ৫০ নারী সদস্য মিলে করছে। ডেলিভারি দিতে পারলে আরও কাজ পাওয়া যাবে এবং তা পরিমাণে বাড়বে। সে জানায়, বর্তমানে গ্রামের প্রশিক্ষিত নারীরা অক্টোপাস, র‌্যাটেল বানি, ফ্রকগার্ল, ট্রয়টল, এ্যাঞ্জেল, রোবট, বুলেট ও শাপলা ফুলসহ বিভিন্ন ধরনের পুতুল বানাতে পারদর্শী। এসব পুতুল বানাতে সুতা, তুলা, আর ঝুনঝুনি ব্যবহার করা হয়। জেলেবধূ বিউটি বেগম জানান, অনেক পুতুল আছে যা বানাতে দীর্ঘসময় লাগে। তবে গ্রামের নারীরা বিকেলে অবসর সময়ে একত্রে বসে গল্পচ্ছলে এসব পুতুল বানানোর কাজ করছেন। বর্তমানে তারা ৩০ টাকা মূল্যের অক্টোপাস তৈরির কাজ করছেন। সূত্রমতে, পুতুল ছাড়াও গ্রামের নারীরা হাতেবোনা পাটি তৈরির কাজ করছেন। এজন্যও তারা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। ১৫০ টাকার হোগলা পাতার একটি আঁটি দিয়ে ৪-৫ হাত দীর্ঘ ৪ থেকে ৬টি পাটি বুনছেন তারা। এসব পাটি বোনার ক্ষেত্রে সময় লাগে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। জেলে পরিবারের বাসিন্দা আব্দুর জব্বার জানান, স্থানীয় বাজারে নেয়ার পর পাইকার ও খুচরা ক্রেতারা ভাল দামে এসব পাটি ক্রয় করে নিয়ে যান। এসব কাজের বাইরেও জেলে পরিবারের নারীরা ছাগল পালন ও মুড়ি ভাজার কাজ করেন। আর সব কাজেই তাদের সাধ্যমতো সহায়তা করেন পরিবারের পুরুষ সদস্যরা। গ্রামের জেলেরা মনে করেন, এভাবে একসময় জেলে পরিবারের কাঁধ থেকে ঋণের বোঝা নামবে, পরিবারে ফিরবে সচ্ছলতা। একই স্বপ্ন দেখেন জেলেপাড়ার নারীরা।
×