ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

নদী তীরে ১০ কিমি রাস্তা তৈরি হচ্ছে ;###;বৃহস্পতিবার থেকে ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট প্রকল্প এলাকায় অবস্থান নিয়ে কাজ শুরু করেছে

জাজিরা প্রান্তে মূল পাইলের কাজ শুরুর প্রস্তুতি ॥ পদ্মা সেতুর বিশাল নির্মাণযজ্ঞ

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ১২ মার্চ ২০১৬

জাজিরা প্রান্তে মূল পাইলের কাজ শুরুর প্রস্তুতি ॥ পদ্মা সেতুর বিশাল নির্মাণযজ্ঞ

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মুন্সীগঞ্জ ॥ পদ্মা সেতুর কাজ আরও সম্প্রসারণ হচ্ছে। জাজিরা প্রান্তে মূল পাইলের কাজ শুরুর চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছে। এক সপ্তাহের মধ্যে এখানে কাজ শুরুর কথা রয়েছে। একই সঙ্গে শুরু হচ্ছে সেতুটির ৩৭, ৩৮ ও ৩৯ নম্বর পিলারে পাইল স্থাপনের কাজ। এদিকে মাওয়া প্রান্তে ৬ ও ৭ নম্বর পিলারের কাজও দ্রুত এগিয়ে চলেছে। নদী শাসনের জন্য জাজিরা পয়েন্টে ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তা তৈরি হচ্ছে। আরও নতুন খবর হচ্ছে- ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট বৃহস্পতিবার থেকে প্রকল্প এলাকায় অবস্থান নিয়ে দায়িত্ব পালন শুরু করেছে। যুক্তরাজ্যের হাই পয়েন্ট রেন্ডেল নামে প্রতিষ্ঠানটি এই দায়িত্ব পেয়েছে। এই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন যুক্তরাজ্যের ভাড্রামান জোনস। যুক্তরাজ্য, জাপান, ভারত ও বাংলাদেশের ১০ সদস্য বর্তমানে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে কাজ করছেন। এদিকে আসন্ন বর্ষায় আগের কাজগুলো এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি বর্ষায় কাজ সঠিকভাবে চলমান রাখতেও নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। এসব কাজের অগ্রগতি সরেজমিন দেখতে আজ শনিবার পদ্মা সেতু সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম প্রকল্প এলাকায় আসছেন। তিনি পরের শনিবার পাক্ষিক সভায়ও যোগ দিতে ফের মাওয়ায় আসবেন। বিশাল এই প্রকল্পের কাজ নানাভাবে তদারকি করা হচ্ছে। এর আগে গত শুক্রবার প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব সাজ্জাদুল হাসান প্রকল্প এলাকা ঘুরে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর দফতরে সভা করে পর্যবেক্ষণের বিষয়টি অবহিত করেছেন। সমস্যা ও সম্ভাবনা সব কিছুই তুলে ধরা হয়েছে সেখানে। মূল সেতুর ২৩ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আর গড়ে সেতুর কাজ হয়েছে ৩১ শতাংশের বেশি। করলী চরে সাপ্লিমেন্টারি কনন্সট্রাকশন ইয়ার্ড (চরল্যান্ড) স্থাপনের কাজও এগিয়ে চলেছে। মাওয়ার পাশের কুমারভোগের মূল কন্সট্রাকশন ইয়ার্ড থেকে এটির দূরত্ব প্রায় চার কিলোমিটার। এটির অবস্থান সেতুর ৩৫ নম্বর পিলারের কাছে। এছাড়া পদ্মা সেতুর কাজে আরও গতি আনতে এই বছরের মধ্যে ১৬শ’ কিলোজুল ক্ষমতাস¤পন্ন একটি হ্যামার এবং ১ হাজার টন ওজনের আরও একটি ভাসমান ক্রেন যোগ করা হচ্ছে শীঘ্রই। সেতু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে- সর্বশেষে অগ্রগতিতে প্রধানমন্ত্রীর দফতর সন্তোষ প্রকাশ করেছে। মূল সেতু ২১ শতাংশ ছাড়াও নদী শাসন ১৭ দশমিক ১১ শতাংশ, মাওয়া প্রান্তের এ্যাপ্রোচ ৬৫ শতাংশ, জাজিরা প্রান্তের এ্যাপ্রোচ ৬০ ও সার্ভিস এরিয়ায় কাজ প্রায় প্রায় ৭২ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। তবে জাজিরা প্রান্তের এ্যাপ্রোচ কাজে আরও গতি আনার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বর্ষার আগেই মূল সেতুর কাজ ৩০ শতাংশে উন্নীত করার জন্য প্রচেষ্টা চলছে। পদ্মা সেতুর সংশ্লিষ্ট প্রকৌশরীরা জানিয়েছেন, পদ্মায় মূল নদীতে প্রতি সেকেন্ড প্রবাহিত হয় এক লাখ ৪০ হাজার ঘন মিটার পানি। তবে বর্ষায় মূল সেতুর কাজ অব্যাহত রাখবার জন্য আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার করলী গ্রামে নতুন কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড তৈরি হচ্ছে পুরোদমে। বর্ষায় এখান থেকেই চলবে মূল সেতুর কাজ। চর কেটে এখানে পদ্মা সেতুর জন্য জন্য নদী করা হয়েছে। তাই এখানে অপেক্ষাকৃত নদীর স্র্রোত কম থাকবে। আশপাশের পিলারগুলোর কাজ এগিয়ে নেয়া সহজ হবে। এখন এই করলী চরে নদীতীর ঘেঁষে শেড তৈরিতে স্থানীয় শ্রমিক ও চীনারা হরদম কাজ করছে। এই শেডের পাশেই বড় বড় পাইল স্তূপ করে রাখা হচ্ছে। এগুলো আনা হচ্ছে মাওয়া ওয়ার্কশপ থেকে। ক্রেন ছাড়াও ভারি ভারি নানা যন্ত্রপাতি ব্যবহারের সকল আয়োজন চলছে এখানে। একদিকে সেতুর বিশাল নির্মাণযজ্ঞ আরেকদিকে বর্ষায় কাজ চালিয়ে নেয়ার আগাম প্রস্তুতি। আর নদী শাসনের কাজের গতি আরও বেশি। মাঝের চর থেকে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে হাজার হাজার জিওব্যাগ তৈরি করা হচ্ছে প্রতিদিন। এগুলো নিয়ে ফেলা হচ্ছে মাওয়ার কাছে। বর্ষার আগেই প্রমত্তা এই পদ্মকে বশ মানিয়ে নিতে ধুম কাজ চলছে। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, মূল সেতুর পিলারের জন্য অনবরত পাইল স্থাপনের কাজ চলছে। নদীর তলদেশে প্রবেশ করানো পাইলগুলোর দৈর্ঘ্য ৭০ মিটার করে। তবে বর্ষায় পদ্মা নদীতে সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৪৫ মিটার পর্যন্ত মাটি সরে যাওয়ার রেকর্ড আছে। সেক্ষেত্রে পাইলগুলো পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা বিবেচনায় রেখে সব পাইলের সঙ্গে জোড়া দেয়া হবে আরও ৫০ মিটার করে। এভাবে ছয়টি পাইল বসে যাওয়ার পর সেগুলো রড, কংক্রিট ও বালু দিয়ে ভরাট করে ক্যাপ বসিয়ে দেয়া হবে। আর তার ওপর স্ট্রাকচার নির্মাণ করা হলেই পূর্ণতা পাবে এক একটি পিলার। বর্ষার প্রচ- স্র্রোতে যাতে সেতু নির্মাণ ব্যাহত না হয় সেলক্ষ্যে নদী শাসনের কাজকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত নদী শাসনের কাজ শেষ হয়েছে ১৭ দশমিক ১১ শতাংশ। ১২৫ কেজি ওজনের ৩ লাখ জিওব্যাগ ফেলা হয়েছে। একই সাথে ৮শ’ কেজি ওজনের ৩ লাখ ৭২ হাজার জিও ব্যাগও ফেলা হয়েছে। মাওয়া প্রান্তে থে ৮শ’ কেজি ওজনের আরও তিন লাখ জিও ব্যাগ ফেলা হবে এই শুষ্ক মৌসুমে। ২৪ লাখ সিসি ব্লক ফেলার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ৮শ’ কেজির বাকি জিও ব্যাগ ফেলা সম্পন্ন হলেই এগুলো স্থাপন করা হবে। মাওয়া প্রান্তে ৪ লাখ কিউবিক মিটার বালু ড্রেজিং করা হয়েছে। মাওয়া প্রান্তে নদী শাসনে আর ড্রেজিং প্রয়োজন হচ্ছে না। এছাড়া ৩৫ লাখ বালুর প্লাস্টিক বস্তা মাওয়া প্রান্তে ফেলে নদীর তলদেশের বড় বড় গর্ত পূরণ করা হয়েছে। জাজিরা প্রান্তে কাওড়াকান্দি থেকে মাঝিকান্দি পর্যন্ত কাজের সুবিধার্থে একটি সড়ক তৈরি করা হচ্ছে। পুরো এলাকাটিতে নদী শাসন হবে। তাই কাজের সুবিধার্থে এটি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই সড়কটির দুই দশমিক দুই কিলোমিটার সম্পন্ন হয়েছে। ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রাস্তার বাকি প্রায় ৮ কিলোমিটারের কাজ এগিয়ে চলছে। জাজিরা প্রান্তে ইতোমধ্যেই ড্রেজিংয়ে ৭ লাখ কিউবিক মিটার বালু অপসারণ করা হয়েছে। সিসি ব্লক তৈরির মেশিনগুলো আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে ম্যানুয়েল ব্লকের কাজ চলছে। কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে জায়গা স্বল্পতায় ব্লক তৈরির মেশিনগুলো চালানো যাচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। পুরো প্রকল্পে নদী শাসনে প্রায় সাড়ে ৭ কোটি ব্লক ব্যবহার করা হবে। তবে এবারের শুষ্ক মৌসুমে ৩০ লাখ ব্লক তৈরি করা হচ্ছে। যার ২৪ লাখ ইতোমধ্যেই তৈরি করা হয়েছে। ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ের সেতুটি চার লেনবিশিষ্ট মূল সেতুটি দৈর্ঘ্যে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার এবং চওড়ায় ২২ মিটার। সেতুটিতে মোট ৪১ ¯প্যান (অংশ) থাকছে, যার প্রতিটির দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। ¯প্যান বড় হওয়ার কারণে রি-ইনফোর্সড কংক্রিট দিয়ে তৈরি না করে ওজন কমাতে এই সেতুটির মূল অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে স্টিল দিয়ে। তীব্র বায়ুপ্রবাহ ও ভূমিক¤পজনিত ধাক্কা মোকাবেলায় বেছে নেয়া হয়েছে ওয়ারেন ট্রাস ফর্ম। পুরো সেতুটির ভার বহন করার জন্য থাকছে ৪২চি পিলার। যার প্রতিটির নিচে থাকছে গড়ে ছয়টি পাইল। স্থানীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমিন শুক্রবার মাওয়ায় প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে বলেছেন, বর্ষা সামনে রেখেই সেতুর কাজ এগিয়ে চলছে পুরোদমে। আর বর্ষায়ও সেতুর কাজ চলবে যথাযথভাবে সেভাইে এগোচ্ছে সব কিছু। তিনি বলেন, ‘আমার নির্বাচনী এলাকায় এত বড় কর্মযঞ্জ চলছে ভাবতেও গর্ব হয়। যে সেতু পুরো দেশের চেহারা বদলে দিতে যাচ্ছে, সেটির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকতে পেরে। সেতুর নির্মাণযজ্ঞ উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর আগমনের পরই প্রকল্প এলাকায় বিশেষ এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সম্ভাবনার তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। পদ্মায় নতুন ঝিলিক দেখা দিয়েছে। পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী (মূল সেতু) আব্দুল কাদের জানান, হাই পয়েন্ট রেন্ডেল (ইউকে) সেতুটির ম্যানেজমেন্ট কন্সালট্যান্টের দায়িত্ব পালন শুরু করেছে। এছাড়াও সব কিছু যথযথভাবেই এগিয়ে চলছে।
×