ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

গারো পাহাড়ের ২৫ গ্রামবাসী আতঙ্কে ॥ বুনোহাতির তাণ্ডব

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ১৩ অক্টোবর ২০১৫

গারো পাহাড়ের ২৫ গ্রামবাসী আতঙ্কে ॥ বুনোহাতির তাণ্ডব

নিজস্ব সংবাদদাতা, জামালপুর, ১২ অক্টোবর ॥ বুনোহাতির তা-বে বকশীগঞ্জ ও প্রতিবেশী শ্রীবরদী উপজেলার ভারতীয় সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ের ২৫টি গ্রামের মানুষ সব সময় আতঙ্কে থাকে। বন্যহাতির আক্রমণে প্রতিদিন হাজার মানুষের দিন কাটে শঙ্কায়, রাত কাটে নির্ঘুম। জানা গেছে, দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর ধরে মাঝে মধ্যেই বকশীগঞ্জ ও শ্রীবরদী সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ে শতাধিক হাতির পাল কয়েক দলে বিভক্ত হয়ে লোকালয়ে হামলা চালায়। এতে করে বন্যহাতির তা-বে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবছর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শত শত একর জমির মৌসুমী ফসল। লণ্ড ভণ্ড হয়ে যায় ঘরবাড়ি। হাতি এসে তছনছ করে বন বাগানের বিপুল পরিমাণ গাছপালা। অব্যাহত হাতির হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে পাহাড়ের গ্রামীণ জীবন। তাদের জীবন এখন হুমকির মুখে। সরেজমিন এলাকাবাসীদের সঙ্গে কথা বলে এসব চিত্র পাওয়া গেছে। গ্রামবাসী জানায়, বন্যহাতির আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে রাতে আগুন জালিয়ে হৈ হুল্লোড় করে বাঁশ দিয়ে পটকা বানিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে হাতি তাড়ানোর চেষ্টা করে। সব সময় বন্যহাতির ভয়ে সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ে ২৫ গ্রামের মানুষ আতঙ্কে দিন কাটায়। বিশেষ করে দুর্গম পাহাড়ী এলাকার সাতানিপাড়া, গারোপাড়া, বালুঝরি, দিঘলাকোনা, লাউচাপড়া, হাতিবেড়কোনা, শোমনাথপাড়া, চন্দ্রপাড়া, প্রতিবেশী শ্রীবরদীর কর্ণজোড়া, বাবলাকোনা, রাজারপাহাড়, ঝোলগাও, বালিজুড়ি, কোচপাড়া, রাঙ্গাজল, কাড়ামারা, হারিয়েকোনা, পাঁচমেঘাদল পাহাড়ী এলাকার বাসিন্দা বন্যহাতির উপদ্রবে ভয়ে তটস্থ থাকে। এছাড়া ভারতের মেলালয় প্রদেশের সীমান্ত ঘেষে বকশীগঞ্জ ও শ্রীবরদীর সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ের সাতানিপাড়া, গারোপাড়া বালুঝরি, টিলাপাড়া, লাউচপড়া, দিগলকোনা, হাতিবেড়াকোনা পাঁচমেঘাদলসহ ১৩টি গ্রামে বাঙালী ও হিন্দু গারো কোচ হাজংসহ বিভিন্ন গোত্র মিলে অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করছে। উল্লিখিত এলাকায় বাংলাদেশে ও ভারতের ভূখ-ে রয়েছে বিশাল বনভূমি। বাংলাদেশর বনাঞ্জল অপেক্ষকৃত সমতল। ভারতের গহীন বনাঞ্চল রয়েছে অগণিত বুনোহাতি। হাতি দল বেঁধে সমতল ভূমিতে চলাফেরা ও আহার করতে সহজ মনে করে থাকে। তাই সময় অসময়ে বুনোহাতির পাল সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ওইসব সমতল বনাঞ্চলের আবাসিক ও কৃষিপ্রধান এলাকায় চলে আসে। পাহাড়ে বসবাসরত বাড়িঘর ফসলাদি জমি ও বিভিন্ন বাগানে প্রবেশ করে ধ্বংসলীলা চালায়। আবার ফিরে যায় হাতিরপাল। ২০ বছর ধরে এসব বন্যহাতির তা-বলীলায় সীমান্তবর্তী উল্লিখিত পাহাড়ী গ্রামগুলোতে অসংখ্য ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। হাজার হাজার একর জমির ধান শাকসবজি ফসল খেয়ে এবং বাগানের গাছপালা দুমড়ে মুচড়ে সাবাড় করে চলেছে। বুনোহাতির আক্রমণে এ পাহাড়ী গ্রামগুলোতে কম পক্ষে বালিজুড়ি গ্রামের হামির উদ্দিন, বাবুল মিয়া, খ্রিস্টানপাড়া গ্রামের স্টারমন, শোমনাথপাড়া গ্রামের মজিবর, সিরাজ, হাতিবর গ্রামের আবু তালেবসহ অর্ধশতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। কয়েকশত মানুষ আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে কমপক্ষে ৩০ জন পঙ্গু হয়ে দুর্বিসহ জীবনযাপন করছে। গৃহহীন হয়ে পড়েছে কয়েকশ’ পরিবার। বালুঝরি গ্রামে ফতেহ সাংমা, শাহজাহান, ফিলিপ মারাকসহ অনেক গ্রামবাসী জানায় বুনোহাতি ঢাকঢোল পটকা ও আগুনকে ভয় করে থাকে। তাই এলাকাবাসী মশাল জ্বালিয়ে হৈ হুল্লোড় করে বাঁশ দিয়ে ফটকা বানিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে হাতি তাড়ানোর চেষ্টা করে। অনেক সময় বাধা না পেয়ে হাতির দল গ্রামে প্রবেশ করে থাকে। লাউচাপড়া গ্রামের মুক্তার আলী বলেন, বন্যহাতির বিচরণ এলাকায় পর্যাপ্ত খাবার নেই। ক্ষুধার্ত হলেই লোকালয়ে চলে আসে হাতির দল। আর তখনই কেউ না কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দিঘলাকোনা গ্রামের পিটিংসংমা বলেন, আমাদের জীবন জীবিকার জন্য পাহাড়ে কলা, হলুদ, আদা এবং পাদদেশের ফাঁকে ফাঁকে ধান চাষ করি। এসব ফসল খাওয়ার জন্য হাতির দল লোকালয়ে চলে আসে। স্থানীরা এ সময় প্রতিরোধ করতে গেলেই হাতির দল তাদের ওপর চড়াও হয়। এমনকি বাড়িঘরে হামলা চালায়। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে সীমান্তবর্তী পাহাড়ী এলাকার মানুষ পাহাড় থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করে এবং পাহাড়ের পাদদেশের চাষাবাদ করে কোনরকম জীবিকা নির্বাহ করে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য, বঞ্চনা তাদের নিত্যসঙ্গী। এর ওপর প্রায় বন্যহাতির আক্রমণে দিশেহারা করে দিয়েছে তাদের। হাতির আতঙ্কে এমনিতে অনেক জমি পতিত থাকছে। ঝুঁকি নিয়ে আবাদ করলেও সে ফসল তারা ঘরে তুলতে পারছে না। ফলে পাহাড়ী জনপদের মানুষগুলো হাতির সঙ্গে যুদ্ধ করে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। তাই বন্যহাতির সমস্যা স্থায়ী সমাধানের জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন সীমান্তবাসী।
×