ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২

বৃষ্টিবিলাস, ধরিত্রীকে সবুজ রাখার প্রত্যয়

ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন, প্রেসিডেন্ট, আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল

প্রকাশিত: ২১:৩৫, ১৮ জুন ২০২৫

বৃষ্টিবিলাস, ধরিত্রীকে সবুজ রাখার প্রত্যয়

ঊ তুমি বৃষ্টি দিনে আসবে বুঝি আজ.
তোমার মাথায় গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির কারুকাজ,
তোমার জন্য থাকব বসে দুহাত মেলে আজ,
তোমার ছোয়ায় পাবে প্রাণ নতুন সাজ।

বাংলা বর্ষপঞ্জির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঋতু বর্ষা। বর্ষা আমাদের জন্য অপরিহার্য্য এক ঋতু। আষাঢ় ও শ্রাবণ—দুই মাস বর্ষাকাল। ষড়ঋতুর দেশের দ্বিতীয় ঋতু বর্ষার দিন। প্রকৃতিকে অঝোর ধারায় ভেজানোর প্রত্যয়ে ধরণিতে আগমন ঘটে বর্ষার। মেঘের গর্জনের সঙ্গে আকাশের কান্নায় ভিন্ন এক রূপে সাজে ঋতুবৈচিত্রের ষড়ঋতুর বাংলাদেশ। আষাঢ় বাদলা দিনে কদম ফোটার দিন। বর্ষার আগমনে গাছে শোভাবর্ধন করে কদম ফুল। মেঘের গুড়ুম গুড়ুম গর্জনে ময়ূর নাচে পেখম তুলে। বর্ষার প্রথম কদম ফোটা ও মেঘের গর্জনের মধ্য দিয়ে ফিরে এসেছে বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য। শুধু বর্ষার শুভ সূচনা নয়, বরং আমাদের সংস্কৃতি, শিল্প ও আবেগ—অনুভূতির অভিব্যক্তি। প্রকৃতিকে স্নিগ্ধতা ও প্রাণচাঞ্চল্যে ভরিয়ে দিয়ে ধরণিতে পা রাখল বর্ষা আষাঢ় ঘিরে আমাদের দেশে নানা আয়োজনও লক্ষ্য করা যায়। ষড়ঋতুর বাংলাদেশের দ্বিতীয় ঋতু বর্ষার দিনে ঢাকার বকুলতলায় যেন নেমে আসে ছায়ামাখা সংগীত, নৃত্য আর কবিতার মিষ্টি ধারায় সাজানো উৎসব। বিশেষ করে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বর্ষাবরণ উৎসবের আয়োজন করে গান, কবিতা, নৃত্য আর আবৃত্তির মাধ্যমে। আবেগে ভরা বর্ষা আমাদের মনকে স্নিগ্ধ করে তোলে। পুরোনো জঞ্জাল ধুয়েমুছে আমরাও জেগে উঠি প্রাণচাঞ্চল্যে। 

তাপমাত্রা কিছুটা বৈরী হলেও তবু আষাঢ়ের সূচনায় শুরু হয়েছে গতির পরিবর্তন। আকাশে ব্যাপক মেঘলা আভা আবহাওয়াকে দিয়েছে ছবির মতো সৌন্দর্য্য।

বাঙালির জীবনধারায় বর্ষাকাল এক অনন্য মাত্রা যোগ করে। গ্রামীণ জনপদে আষাঢ় মানেই মাঠে—ঘাটে নতুন জীবনের আভাস, কৃষকের মুখে হাসি, ধানের চারা রোপণের প্রস্তুতি আর শিশির ভেজা সবুজ প্রকৃতির বিস্তার। শহরজীবনের এই দিনের বিশেষ আবেদন আছে—কেউ কেউ স্মৃতির খাতা উল্টে বৃষ্টিভেজা স্কুলজীবনের কথা মনে করেন, কেউ বা জানালার পাশে বসে এক কাপ চায়ের সঙ্গে উপভোগ করেন বর্ষার ছোঁয়া। অন্যদিকে, বাংলা সাহিত্যে বর্ষা বারবার ফিরে এসেছে প্রেম, বিরহ, প্রকৃতি ও সংগ্রামের রূপক হয়ে। কবিতা, গান কিংবা গল্পের বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বর্ষা।   

সাপ যেমন সাপুড়ের বিনে মোহাবিষ্ট হয়ে যায়, ঠিক তেমন করে বাঙালিও বৃষ্টি ও বর্ষার মোহাবিষ্ট হয়ে আছে অনন্তকাল ধরে। বাঙালির শিল্প—সাহিত্য, গান—কবিতায় বর্ষা তাই অনিবার্য্য অনুষঙ্গ। বাঙালির এই বর্ষা বন্দনা সাম্প্রতিক কোনো প্রবণতা নয়। খ্রিস্টপূর্ব ত্রিশ, মতান্তরে চল্লিশ দশকে সংস্কৃত কবি কালীদাস তার ‘মেঘদূত’ কাব্যে প্রথম উন্মাদনা এনেছিলেন বর্ষা বন্দনার। আর রবীন্দ্রনাথে বর্ষা পেয়েছে পূর্ণতা। 
‘বাদল—দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান,আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান।’
রবীন্দ্রনাথ আমাদের শ্রাবণের গান দিতে এসেছিলেন এবং দিয়েছেনও উজাড় করে। বৃষ্টি ও বর্ষা নিয়ে পৃথিবীর আর কোথাও এমন উৎসব নেই, এমন নিবেদন নেই। পৃথিবীর অন্য কোনো অঞ্চলে বর্ষা ঋতু স্বাতন্ত্র্য মর্য্যাদা পায়নি, যেমনটা এই বঙ্গভূমিতে পেয়েছে। আর বর্ষাকে এমন মোহনীয় ভঙ্গিমায়, এমন রূপ—রস—মাধুর্যে্ কে সাজাতে পেরেছেন রবীন্দ্রনাথ ছাড়া ? রবীন্দ্রনাথের নীপবনে ছায়াবীথি তলে বারবার বাঙালিকে ছুটতে হয় স্নান করতে হয় নবধারা জলে।

অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা তার ডারউইনবাদ ও রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিভাবনা প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রকৃতি—সাহিত্যের রাজাধিরাজ।’ রবীন্দ্রনাথের গান কবিতা ছড়ায় প্রতিটি ঋতু পায় আলাদা বৈভব। কিন্তু বর্ষার প্রতি যেন রবীন্দ্রনাথের এক ধরনের স্পষ্ট পক্ষপাতিত্ব। রবীন্দ্র কাব্যে বর্ষা তাই অনেক বেশি সজীব, অনেক বেশি প্রাণবন্ত। 
বৃষ্টি সব উষ্ণতা নিমেষেই কমিয়ে এনে দিল শান্তির ধারা। আকাশে গুড়ুম গুড়ুম ডাক, বৃষ্টি পড়তে পড়তে আবার কমে আসা। ততক্ষণে ভেসে গেছে সব; বৃষ্টির শব্দ ভেদ করেই এল আজানের ধ্বনি। প্রকৃতির এ সৌন্দর্য্য দেখার ঘোর কাটাল স্রষ্টার অমৃত বাণী। এমন একটা বৃষ্টি দেখার পিপাসা কতকালের! মাটির ঘরের বারান্দা; টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ। মুরগির ছানাদের মায়ের ডানার ভেতর লেপ্টে যাওয়া। আবার কোনোক্রমে মাথা বের করে থাকা। নতুন প্রাণেরাও দেখছে প্রকৃতির লীলাখেলা। বৃষ্টি থামার পর তাকিয়ে দেখি, রক্তরঙা রঙ্গন তাকিয়ে আছে ডাগর ডাগর চোখে। পেঁপে গাছের পাতা থেকে স্বচ্ছ জল ফোঁটায় ফোঁটায় ঝড়ছে। পিচঢালা পথ ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছে। যেদিকে তাকাই দৃষ্টি জুড়ায়। দিনভর—রাতভর হয়তো তারা ঝড়বে; কারও মন খারাপের দিনে সঙ্গ দেবে, আবার আনন্দলোকে নিয়ে যাবে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়—
‘ব্যাকুল বেগে আজি বহে বায়,
বিজলি থেকে থেকে চমকায়।
যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে
সে কথা আজি যেন বলা যায়
এমন ঘনঘোর বর্ষায়।

আষাঢ় মাসের ভাসা পানির সাথে হাহাকার করে উঠেছিল শাহ আবদুল করিমের তৃষিত হৃদয়। লিলুয়া বাতাসে আসা পানিতে তার লাঘব হয়েছে বিরহ। হাওরের বর্ষা যারা দেখেনি আষাঢ় মাসের সর্বাঙ্গীণ সৌন্দর্য্য তাদের বোধগম্য হবার কথা নয়। 
এইতো, বর্ষা এলেই মনে পড়ে স্কুলপাঠ্য ছড়া—
বৃষ্টি পড়ে/ রিমঝিমিয়ে রিমঝিমিয়ে/ 
টিনের চালে গাছের ডালে/ 
বৃষ্টি পড়ে তালে তালে..
কিংবা রেকর্ডে শোনা গান—
আষাঢ় শ্রাবণ মানে নাতো মন/ 
ঝর ঝর ঝর ঝর ঝরেছে/  
তোমাকে আমার মনে পড়েছে।

আষাঢ় মাস। সকাল থেকেই 'বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, পায়ে দিয়ে সোনার নুপুর' অবস্থা। কখনো জোরে, কখনো ধীরে। পড়ছে তো পড়ছেই। গ্রামে আছি বলেই হয়তো বৃষ্টিবিলাস দুলছে মনের মাঝে। এসব দেখে আমাদের কালের কেউ হয়তো জানালার শিকে গাল লাগিয়ে ভরাট গলায় গেয়ে উঠতো— 
আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি/
আমায় আর কান্নার ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই।
অন্য কেউ রুণা লায়লার ব্যর্থ অনুকরণে গাইতে থাকবে—
এই বৃষ্টি ভেজা রাতে চলে যেও না/ 
বৃষ্টির গন্ধে বকুল আনন্দে/ 
আমায় ফেলে চলে যেও না।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন— এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়। এখন পাল্টে গেছে কাল। রাবীন্দ্রিক ঢং একালের তরুণদের পোষায় না। প্যানপ্যানানি ভেবে বিরক্ত হয় তারা। 

আমরা যখন শুনি—
ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না/
আমার এতো সাধের কান্নার দাগ ধুয়ো না।
তখন প্রেমাকাংঙ্খী বিরহতাপিত সলাজ প্রেয়সীর যে অবয়ব আমাদের চোখে ভেসে ওঠে তার সৌন্দর্য্য বিভা এড়িয়ে যাই কী করে?
আষাঢ়ষ্য প্রথমা দিবসে কামনা
ঘুচে যাক দাহকাল
আসুক সুবর্ণ সকাল।

বর্ষা উৎসব শুধু শিল্প নয়, আছে পরিবেশের কথাও। এ ধরিত্রীকে সবুজ রাখার প্রত্যয়ে আমরা সবাই বনজ, ফলজ ও ঔষধি গাছের চারা বিতরণ করতে পারি।

নুসরাত

×