ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

যে তুমি হরণ করো

বাবুল আনোয়ার

প্রকাশিত: ২১:৩৪, ৮ ডিসেম্বর ২০২২

যে তুমি হরণ করো

আবুল হাসানের কবিতা বিষাদমগ্ন এক অনন্ত আঁধার

আবুল হাসানের কবিতা বিষাদমগ্ন এক অনন্ত আঁধার। কবিতা ও জীবনে হরণকে তিনি বরণ করেছেন সর্বতোভাবে। যে কবিতার নিগড়ে নিজেকে জড়িয়েছেন গভীরভাবে, সে কবিতাই শেষ পর্যন্ত তাকে হরণ করেছে। পাঠককে তিনি আপ্লুত করেছেন, জয় করেছেন হৃদয়। এ হরণ সৃষ্টির, সৃজনশীলতার, এ হরণ শিল্পময়তার। এর আরেক নাম বিষাদ-বেদনা । সবটাই কবিতার জন্য। কবিতার জন্য হেঁটেছেন অনেক দীর্ঘ পথ। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে তিনি বর্ষার জলের ছোঁয়া, বসন্তের উষ্ণতাকে অনুভব করেছেন।

কবিতাই হয়ে ওঠেছে তার একান্ত আগ্রহ ও আশ্রয়ের বিষয়। এখানে তিনি নিবিড়, নিরবচ্ছিন্ন। অব্যাহত পরিচর্যায় নিবেদিত। তাই তার কবিতাগ্রন্থের নামকরণের মধ্য দিয়ে হরণ শব্দটি সমূলে সমার্থক হয়ে ওঠেছে। তার কবিতা বিষাদের মর্মগাথা। যেন কষ্টের প্রতিরূপ। কবি যেন বেদনার বাহক, মায়াবী আঁধারে উজ্জ্বল এক জোড়া চোখ। রাত জাগা নিঃসঙ্গ ব্যথিত প্রাণ। অসুখ ও অপ্রাপ্তির বিবর্ণ প্রান্তরে ক্লান্ত এক পথিক।
আবুল হাসানের কবিতা বিষাদ, বিপন্নতা ও কষ্টের নিগড়ে বাঁধা। মানবীয় আর্তির সরব প্রকাশ। পাঠককে তা সহজে আপ্লুত করে। স্পর্শ করে বেদনাবোধে। তার প্রথম কবিতা গ্রন্থের প্রথম কবিতায় সে বোধের বিষাদিত উচ্চারণ,- সে এক পাথর আছে, কেবলি লাবণ্য ধরে, উজ্জ্বলতা ধরে আর্দ্র,/মায়াবী করুণ/এটা সেই পাথরের নাম নাকি? এটা তাই?/এটা কি পাথর নাকি কোনো নদী? উপগ্রহ? কোনো রাজা?/ পৃথিবীর তিন ভাগ জলের সমান কারও কান্না ভেজা চোখ?  (আবুল হাসান, রাজা যায় রাজা আসে)।
এ আর্দ্র, করুণ পাথরের প্রতিরূপ যেন কবি ও তার জীবন। এ জীবনে রক্ত ও সম্পর্কের স্বাভাবিক ধারা বহমান। তা তো ‘জন্মদাতা জনকের জীবনের রুগ্ন রূপান্তর।’ তাই তার দৃষ্টি ও বোধের জমিনে জমাট বাঁধে কুয়াশা। দাঁড়িয়ে থাকে সারি সারি দুঃখ। শুধু নিজের নয়, অন্যের কষ্টকেও তিনি ধারণ করেন। সহমর্মিতার সকরুণ বীণায় তা ধ্বনিত হয়।
দুর্নিবার জীবন যেন কোথাও থেমে থাকে না। সে কথা ভেবে কখনো কেঁদে ওঠে মানব হৃদয়। আর তা যদি হয় কবির হৃদয়, সেখানে কষ্টের আনাগোনা আরও বেশি। উপলদ্ধির গভীরতায় তা রূপ নেয় প্রগাঢ় বেদনায়।- প্রিয়তম পাতাগুলো ঝরে যাবে মনেও রাখবে না / আমি কে ছিলাম, কী ছিলাম- কেন আমি/সংসারী না হয়ে খুব রাগ করে হয়েছি সন্ন্যাসী/হয়েছি হিরণ দাহ, হয়েছি বিজন ব্যথা, হয়েছি আগুন!/(সেই মানবীয় কণ্ঠস্বর, যে তুমি হরণ করো)। দুঃখকে লালন করেন তিনি। বল্লেঠিক বলা হবে না।

দুঃখই তাকে তাড়া করে, আবার জড়িয়ে ধরে। দুঃখের চাষাবাসে তিনি ব্যস্ত থেকেছেন দিনরাত। এ বিরূপ বেষ্টনী থেকে তিনি বেরুতে চেয়েছেন। মুক্ত আলো বাতাসের হিরন্ময় আঁধারে থাকতে চেয়েছেন। খণ্ড খণ্ড আলোর বিভা তার জীবনকে প্লাবিত করুক চেয়েছেন। কিন্তু কোনো কিছুই মুখ তুলে চায়নি। এ বিরূপতা তার কবিতায় দহনে বিস্ফোরিত হয়েছে। তিনি যখনই কবিতায় মগ্ন হয়েছেন, তখনই এ বৃত্ত তাকে জাপটে ধরেছে।

এর মধ্য দিয়েই বাংলা কবিতায় তার নিজস্ব অবস্থান নির্ণীত হয়েছে। প্রথম থেকে শেষ কাব্য পর্যন্ত আবুল হাসান এ বিষাদময়তায় অবগাহন করেছেন। অবাক কুশলতায় লিখেছেন কবিতা। মানবিক বোধ ও তৃষ্ণায় কথা বলেছেন।
শেষ গ্রন্থ ‘পৃথক পালঙ্ক ‘তে জীবন ও জগতের প্রতি তার অকুণ্ঠ ভালোবাসা, মমত্ববোধ উচ্চকিত হয়েছে গভীর ঋদ্ধতায়। দুঃখবোধের সঙ্গে মৃত্যু চিন্তা তার কবিতাকে সব সময় আক্রান্ত করেছে। ব্যক্তিগত আবেগের সঙ্গে একাত্ম হয়ে মিশে গেছে। যেমন- আমার শরীর খোঁড়া, দুঃখময় আত্মার গাঁথুনি, দ্যাখো আমি ঠিকই/খ-িত ইটের মতো খুলে যাব সহজেই, কিছুই থাকবে না। (ভেতর বাহির, যে তুমি হরণ করো)।

দুঃখের অতল প্রবাহ তার আত্মচেতনারই বহির্প্রকাশ। যেন তা কষ্টের মথিত চুড়ায় শিল্পের শিখা। সেখানে তিনি নতজানু। কিন্তু সৃষ্টিতে গভীর ও প্রসারিত। এখানে তার কবি হৃদয় মাঝে মাঝে অবদমিত হয়েছে। তবে তা নেতিবাচক বৃত্তে আটকে পড়েনি। তিনি এ জীবন বিমুখ বৃত্তকে টপকাতে চেয়েছেন। বিশুদ্ধতার বৈভবে জীবনকে রাঙাতে চেয়েছিলেন। এতো কিছুর পরেও তিনি থাকতে চেয়েছেন স্বপ্ন বাস্তবতায়। তার কবিতায় তারই প্রতিফলন চোখে পড়ে। যেমন- হারানো পারের ঘাটে জেলে ডিঙ্গি, জাল তোলা কুচো মাছে/ কাচালী সৌরভ- শোনো/ সেখানে সংগুপ্ত এক নদীর নির্মল ব্রিজে/ বিশুদ্ধির বিরল উত্থানের মধ্যে আমি আছি/(নচিকেতা, পৃথক পালঙ্ক )।
এক সময় হয়তো অসুখ, বিষাদ, বিপন্নতাকে তিনি অমোঘ বিধান হিসাবেই মেনে নিয়েছেন। তবুও মানুষের জন্য দায় পালনের ঐকান্তিক বোধ থেকে সরে যান নি। নিজের কিছু হোক বা না হোক
মানবিক শুভ কামনায় তার হৃদয় উন্মুখ ছিল সব সময়। একটি ছোট্ট কবিতায় তার বিস্মিত প্রকাশ- ঝিনুক নীরবে সহো/ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও/ভেতরে বিষের বালি, মুখ বুঁজে মুক্তা ফলাও। (ঝিনুক নীরবে সহো, পৃথক পালঙ্ক)। দুঃখ, শোক, জরা, মৃত্যু-ভয় এ নিয়ে তো শুধু জীবন নয়। তাই যেন সত্য, অমোঘ হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার জীবন, কবিতায়। এ সত্য ও বাস্তবতাকে ধরেই তিনি বলেন, ‘স্বেচ্ছাচার ধীরে ধীরে গিলে খায়-নিয়তিও আমাকে অস্থির/বধির বিনাশে রেখে ধাবমান, দ্যাখো ওই, ওই ধাবমান (ভালোবাসা, পৃথক পালঙ্ক)।
আবুল হাসান তাই দুঃখতাড়িত বেদনার কবি। তার কবিতা বিষাদ মগ্নতার বহমান নদী। আর সে স্বচ্ছ জলের ধারায় উদ্ভাসিত মুখ আবুল হাসান। কবিতার বিচ্ছুরিত আলো। বিষাদের ব্যপ্তিতে জাগরূক, কবিতার বিভাসিত অনিন্দ্য মুখ।

×