রমেন্দ্র কুমার দাস ওরফে রমা তার নাম। বয়স একুশের চেয়ে কম। এলোমেলো, লম্বা চুল। ক্যাম্পের তিনদিনের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হচ্ছে মাকে এখানে রেখেই চলে যাওয়া উত্তম হবে তার। এটা অবশ্য পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা। সংসার বলতে রমা, তার নববিবাহিতা স্ত্রী কবরী আর তার মা। বাবাকে পাকিস্তানী মিলিটারিরা লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি ছুড়ে মেরেছে। কবরীকে ধরে নিয়ে গেছে পাকবাহিনী। গাঁয়ে দিয়েছে আগুন। নারী-পুরুষ-বউ-ঝি-শিশু-কিশোর সবাই পালিয়েছে। ঘটনার পরদিনই সুনামগঞ্জের ভাঙ্গাডহর থেকে পূর্বপুরুষের ভিটা ছেড়ে ভারতের মেঘালয়ের পাদদেশে।
ঝুপড়ি শিবিরে কনকনে রাত পেরিয়ে যখন ভোরের আলো ফোটে, তখন রওনা দেয়ার কথা তার। শীতবস্ত্রের বদলে আগুনই এখানে শীত নিবারণের একমাত্র ভরসা। দু’চারজনের থাকলেও, অধিকাংশ শরণার্থীর ঘরেই নেই শীত নিবারণের ব্যবস্থা। তাই দিনের বেলায় কুড়ানো লাকড়ির পরিত্যক্ত অংশ জ্বালিয়ে কোন রকমে শীত থেকে বাঁচার উপায় খোঁজার চেষ্টা অসহায় মানুষগুলোর। রমার বস্ত্র বলতে পরনের একখানি লুঙ্গি আর গায়ের হাফ হাতাওয়ালা শার্ট। প্রচ- শীত, শরীর কাঁপছে; তবু ট্রেনিংয়ে যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়ায় লম্বা সড়কের কিনারে।
হঠাৎ একটি অচেনা লোক এসে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কী রমা?’
হ্যাঁ, শব্দটি মুখে উচ্চারণ না করেও আস্তে মাথা নেড়ে বোঝাল, সঠিক।
রমা তাকালো চেহারার দিকে। রং ফর্সা, গোলমুখ। সত্তরোর্ধ লোকটি একটি কাপড়ের পুঁটলি দিয়ে বলল, ‘এগুলো তোমার।’
গায়ের চাদর আর গরম কাপড় পেয়ে প্রাণ ফিরে পেল শীতবস্ত্রহীন রমা। খুশি হলো। প্রশ্ন-উত্তর করল না রমা। তখন কথা বলতেই কী ভুলে গিয়েছিল? নিজেকেই নানা জিজ্ঞাসা। লোকটি কে? কিছুক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকল লোকটির দিকে। নীরবে চলে যাচ্ছে কোট পরা কুঁজো লোকটি।
অপর সঙ্গীর অপেক্ষা করার পাশাপাশি সড়কের খালি জায়গায় নতুন করে গড়ে ওঠা সারি সারি শরণার্থী শিবিরের দিকে তাকাচ্ছিল রমা। মাটি দেখে বোঝা যায় এক সপ্তাহ আগে উঠেছে বাড়িঘর। খুব কাছ থেকে এসব রমার যেন দেখা। মানুষের কী কষ্ট। ক’দিন ধরে ঠা-ায় খুব কষ্ট হচ্ছে। সেখানে কয়েকটি ঘরে ছাউনি থাকলেও নিচে বালিমাটিতে বসবাস করছে অনেকে। নারী শিশুরা সবচেয়ে বেশি কষ্টে।
রমা অপেক্ষা করছে সঙ্গীর। ভোরের আলো ফুটে দিন শুরু হতে যাচ্ছে। দেখা গেল, তরুণ এক যুবতীর কোলে শিশু। অপরটি পাঁচ বছর বয়সের কন্যাশিশু, প্র¯্র্রাব করছে রাস্তার ওপাশে। কোলের শিশুটি সর্দি-কাশির প্রভাবে নিশ্বাস নিতে কষ্ট পাচ্ছে। চোখ-মুখ দেখেই অনুমান করা যায়।
সঙ্গী সুধারাম এলো আচমকা। এসেই তাড়া দিয়ে বলল, ‘চল, বেলা হয়ে যাচ্ছে। আমাদের তো সাতটায় পৌঁছতে হবে।’
রমা বলল, ‘আমি ঠিক সময় থেকে তৈরি হয়েই অপেক্ষায় আছি।’
‘দেরি হয়ে গেল, মায়ের জন্যি। তাকে কোনভাবেই বোঝাতে পারি না, আমি ফিরে আসব। বুঝলে রমা, মা তো? নরম মন। নারী জাতি বলে কথা?’
‘হু’। উত্তর দেয় রমা। হাঁটা শুরুর একটু পর জানতে চাইল, ‘আমরা কই যাব পয়লা’।
‘হাঁট জোরে জোরে, এখন কোন কথা না।’
রমা উত্তর করে না। হাঁটতেই থাকে। রাস্তা শেষ হয় না। নববিবাহিতা স্ত্রীর মুখটি ভেসে ওঠে। একসপ্তা কেটেছে সুখ সংসার। এর মধ্যেই কত কী। শ^শুর বলেছিলেন, ‘বাবা, হ¹ল বাপের কাছেই তার কন্যা ভাল, উত্তম। আমি বেশি কিছু বলব না, খালি বলব, তুমি ঠকবা না। মাইয়া আমার খুব ভালা।’
রমা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, ‘কষ্ট দেব না।’
শ^শুর বললেন, ‘যুদ্ধ বাজছে বইলা কাজটা তাড়াহুড়ো করে করছি। কওন তো যায় না।’
রমা এবারও মাথা ঝাঁকালো হ্যাঁ ভঙ্গিতে।
‘আমার আচানক মেয়ের দিকে খারাপ মাইনষের চোখ পড়েছে।’
রমা বলল, ‘আপনি ভাববেন না, ওর কষ্ট হবে না।’
‘বাবারে ভাবতে চাই না কিন্তু মনটা ভাবে, কান্দে। এই আর কী। তুমি আমার ভরসা।’
রমা এদিনই ভাল করে তাকিয়ে দেখল শ^শুরকে। বয়স পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন হবে। চোখে চশমা। ভরা বর্ষাকাল। বিদায় বেলা। নৌকায় দাঁড়িয়ে দু’জন। একে ওপরের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে দু’জনেরই অনিশ্চয়তার ছায়া। তবু শ^শুরের নৌকা ছাড়ার আগে বিদায়কালে রমা শেষকথা বলেছিল, ‘এত চিন্তা করবেন না। আমি আছি না?’
ঘন কুয়াশায় হোঁচট খায় সুধারাম। এরপর তার কাঁশির শব্দে রমা সম্বিত ফিরে পেল নিজেকে।
‘আর কত দূর?’
‘আইসা পড়ছি, ওই তো দেখা যায়।’ আশ^স্ত করে সুধা।
রমা সামনে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেল না, বুঝলও না। শুধু শরণার্থী শিবিরের লম্বা সারি সারি ঘর চোখের সামনে।
দুটি নারী কম বয়সী। যেনো বিরামহীনভাবে কেঁদে চলেছে তারা। পাশে থাকা চারটি সন্তান। গায়েও গরম কাপড় নেই। গুটিসুটি মেরে আছে যেন মায়ের পাশে। এ ক্যাম্পেও বেশির ভাগ নারী-শিশু শীতবস্ত্রের অভাবে ঠা-ায় আক্রান্ত। ওদের দেখেই বোঝা যায়।
‘এটা কত নম্বর ক্যাম্প?’
হাঁটতে হাঁটতে উত্তর দেয় সুধা, ‘পঁাঁচ নম্বর।’
প্রচ- শীত। রমার মনে পড়ে, এক কাপড়ে মাকে নিয়ে গ্রাম ছেড়েছে সে। গরম কাপড় তো দূরে, কোন কিছুই নয়। প্রাণ নিয়ে আসাটাও ছিল দুরূহ। তিনদিন অনাহারে কেটেছে। নতুন রাস্তার অদূরে ত্রিপলের ছাউনি ঘেরা ত্রাণকেন্দ্রের পাশে ধানী জমিতে নতুন করে ঘর তৈরি করতে দেখা যাচ্ছে কয়েকটি পরিবারকে। শুধু ঘরের ছাউনি দিতে পেরেছে তারা। দঁাঁড়ানো নারী-শিশুরা শীতে কাঁপছে। বাঁশের বেড়া ও দুটি ত্রিপল মাটিতে পড়ে আছে।
রমা জানতে চায়, ‘সুধাদা ওরা মনে হয় রাইতে আসছে। তাই না?’
‘হু, খুব কষ্টে আছে বাচ্চারা?’ মুখ ঘুরিয়ে শরণার্থীদের ওপর চোখ বুলিয়ে নেয় সুধা।
‘আর কত দূর?’
‘অত অস্থির হইলে চলব?’ সুধারামের জিজ্ঞাসা।
‘শীতে পা হিম হয়ে আছে।’
শরণার্থী শিবিরের মাঝখানে একটি ছোট্ট চায়ের দোকানের পাশে বেঞ্চে বসে পড়ে সুধারাম। পাশের খালি জায়গাটি দেখিয়ে বললো, ‘বসো রমা। চা খাই আমরা, লোকটি এখানে আসবে।’
দোকানটি যে শরণার্থীদের কেউ দিয়েছে তা বুঝে নিয়ে রমা বললো, ‘মুক্তিযুদ্ধে যাব, মুক্তিযুদ্ধ করব, মিলিটারিদের শক্তি শ্যাষ হবে, আর এইটাও সত্যÑ আমরা স্বধীন হব একদিন। এরপর আমার কবিতারে কী পাব সুধাদা?’
‘রমা তুমি কবিতারে নিয়া ভাবতেছো এখনও? কত কবিতা প্রাণ দিয়েছে, মান দিয়েছে, শরীর দিয়েছে মিলিটারিরেÑ এর সংখ্যা জানো? জানবা না কোনদিন? শহরে ছিলাম, আমি তো ছাত্র রাজনীতি করেছি, বহু বই পড়েছি, পৃথিবীর স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস জেনেছি। কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ভিন্ন?’ ভেঙ্গে ভেঙ্গে কথাগুলো বলে সুধারাম।
‘মানে? কী বলতে চাও?’ রমা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে জবাব জানতে চায়।
সুধারাম উত্তর দেয়, ‘পরে একবার বলব তোমারে।’
রমা চোখ ঘুরিয়ে দেখে বহু শরণার্থী খোলা আকাশের নিচে। চায়ের দোকানি জানাল, অনেকে ব্যক্তিগতভাবে ত্রিপল সংগ্রহ করেছে। ঘরে ছাউনিও দিতে পারেনি।
সকাল সাতটা হলেও রোদের দেখা নেই। এক বৃদ্ধা এসেছে। ‘পানি বসাইছ?’
বোঝা যায়, চায়ের অভ্যাস ওই বৃদ্ধার। তিনি চা পান করতে এসেছেন। ঠা-ায় কাঁপছিলেন। তার শরীরে মোড়ানো একটি ছেঁড়া কাঁথা। সুধারাম একটু দূরে গিয়ে বিড়ি জ¦ালালো। কাউকে যেন সে খুঁজছে।
রমা আগ্রহ নিয়ে শুনছিল চায়ের দোকানি আর বৃদ্ধার কথা। এবার নিজেই কথা শুরু করে বৃদ্ধা নারীর সঙ্গে। ‘আপনারা কবে আসছেন এখানে?’
বৃদ্ধা বললেন, ‘বাইশদিন হইল। কোনো গরম কাপড় নেই, একটি ঝুপড়িঘরে গাদাগাদি করে থাকছি পরিবারের এগারো নারী ও শিশু নিয়া। পুরুষ মানুষ নাই একটাও। এই খানে, শরণার্থী শিবিরে আসবার পথে তাদের ধরে নিয়ে গেছে পাঞ্জাবি মিলিটারিরা। অনেক বাচ্চার গায়ে কাপড় নাই। আমরা কেউ ইচ্ছা করে এখানে পালিয়ে আসি নাই। আত্মীয়স্বজন, ঘরবাড়ি, সহায়-সম্বল সবকিছু হারাইয়া আসছি।’
রমা জানে এর জবাব নেই। শুধু বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কোনো আশ^াস দিতে পারে না সে। কী করা যায় এখন? কী ই বা ক্ষমতা তার। চোখ যায় অদূরে, মেডিকেল ক্যাম্পে। চিকিৎসা নিতে এসেছেন কয়েকজন নারী। দুয়েকজনের কোলে ফুটফুটে শিশু। তাদের নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। দুই মাসের একটি ছেলে শিশুর অস্বাভাবিক কান্নায় রমা বুঝতে পেরেছে সে অসুস্থ। মায়া জাগে। এগিয়ে যায় রমা।
‘কী হয়েছে বাচ্চার?’
কাঁচা বয়সী নারী তার দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়, ‘পাকসেনারা স্বামীকে ধরে নিয়ে গেছে। স্বামীর কোনো খবর জানা নেই আমার। বাপ না থাকায় বাচ্চারা সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কলেজে লেকচারার ছিলাম। এখন এতিমের মতো আমি। কোলের বাচ্চাটা ঠা-া, জ্বর ও কাশিতে ভুগছে, চিকিৎসা নিতে আসছি। মেডিকেল ক্যাম্পে ডাক্তার নেই, আছে খালি নার্স।’ কথা শেষ করে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নারী অন্যদিকে মুখ ফেরায়।
শিশুদের কান্নাকাটি আর হৈচৈয়ের শব্দ এই মেডিকেল ক্যাম্পে। হঠাৎ রমার চোখ থেমে গেল মেডিকেল ক্যাম্পের প্রবেশপথের দিকে। একটি মেয়েমুখ তার দিকে চেয়ে আছে। অসুস্থ হলেও হঠাৎ যেন সকল শক্তি নিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা ওর। রমা এগিয়ে যায় মেয়েটির দিকে। চোখ জোড়া সে রকমই। যে চোখ জোড়া দেখে রমা আকর্ষিত হয়েছিল। তবে কী কবিতার চোখ? একদার প্রিয় স্ত্রী কবিতা এখানে এলো কীভাবে? ওর এমন দশা কেন? অসংখ্য প্রশ্ন, জবাব নেই। আরও কাছাকাছি হয় রমা।
‘তুমি কী কবিতা না?’
রমার এ প্রশ্নের জবাব নেই নারীমুখটিতে।
মধ্যবয়স্কা নার্স জবাব দেয়, ‘পাকমিলিটারা এ নারীর ওপর এতোটাই অত্যাচার করেছেÑ যে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে কবিতা।’
‘মানে?’
‘মানে, লিখতে পারে, বলতে পারে না।’
রমাকে খুঁজতে খুঁজতে সুধারাম মেডিক্যাল ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে আসে। ‘সময় হয়ে গেছে। লোকটি এসে গেছে, আসো তুমি।’
‘কোথায়?’
‘কেন? যুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে।’
‘আমার কবিতাকে রেখে? স্ত্রীকে রেখে?’ রমার প্রশ্ন।
জবাব দেয় সুধারাম, ‘হাজার হাজার, লাখ লাখ কবিতাকে বাঁচাতে হবে, দেশকে রক্ষা করতে হবে। মাটিকে রক্ষা করতে হবে। এটা আমাদের দায়িত্ব, রমা!’