ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ জুন ২০২৫, ৯ আষাঢ় ১৪৩২

রবীন্দ্রনাথের গান ॥ কল্পনা ও বাস্তবতা

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ৬ মে ২০১৬

রবীন্দ্রনাথের গান ॥ কল্পনা ও বাস্তবতা

বহুমাত্রিক রবীন্দ্রনাথ কবি হিসেবে ছিলেন রোমান্টিক। প্রকৃতি প্রেম, সৌন্দর্যবোধ, আবেগপ্রবণতা, মিষ্টিক-চেতনা, অসীমের খোঁজ এবং রোমান্টিসিজমের কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে তিনি ছিলেন প্রকৃতি ও মানবের কবি। তার কবি সত্তার মাঝেই আমরা খুঁজে পাই বাংলা সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ গীতিকার ও সুরকারকে। রোমান্টিকদের কল্পনা আর ভাববাদ জন্ম দেয় নতুন জীবন দর্শনের। রবীন্দ্র মানসে যেমন কল্পনা আছে; আছে ভাববাদের চমৎকার নিদর্শন। তার গানগুলো সুর প্রধান নয় বাণী প্রধান আর এই বাণীর মাঝেই লুকিয়ে আছে কল্পনা আর ভাববাদী দর্শনের ছড়াছড়ি। তিনি কোন নির্দিষ্ট ভাববাদীকে এক্ষেত্রে অনুসরণ করেননি; তার বিশ্বাস আর মানসিক মূল্যবোধ এক্ষেত্রে বেশি পরিলক্ষিত। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের বৈষ্ণবপদাবলীতেও রোমান্টিকতার আমেজ খুঁজে পাওয়া যায়; যা রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করেছিল। রবীন্দ্রনাথের গানের কথা ও সুরে উপনিষদ, বৈষ্ণবপদাবলী ও বাউল গানের প্রভাব রয়েছে। সুরের দিক থেকে তার গানে হিন্দুস্তানী ও কর্নাটিক শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত, বাউল গান, ইংরেজী, আইরিশ ও স্কটিশ লোকসঙ্গীতেরও প্রভাব দেখা যায়। কল্পনা যেহেতু শূন্য থেকে আসে তেমনি তার গানে কল্পনার শুরু শূন্য থেকে। নিরালোক থেকে রবীন্দ্রনাথ রাঙিয়ে দেন নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে এই শূন্যতাকে। তিনি শূন্য আকাশে বিহার করে তার সীমাহীন কল্পনায় অবগাহন করেন এই বিখ্যাত গানটিতে : ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা/ মম শূন্যগগনবিহারী/ আমি আপন মনের মাধুরী মেশায়ে তোমারে করেছি রচনা।’ তার গানের সুধারস পানে সবাইকে তার আমন্ত্রণ : ‘জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো/ সকল মাধুরী লুকায়ে যায়, গীতসুধারসে এসো।’ সৌন্দর্য-চেতনা রোমান্টিক ভাববাদের বিশেষ এক দিক; রবীন্দ্রনাথের ছন্দ বেজে ওঠে সেই সুন্দরের সান্নিধ্যেÑ ‘এই লভিনু সঙ্গ তব সুন্দর হে সুন্দর/ পুণ্য হলো অঙ্গ মম/ ধন্য হলো অন্তর।’ সুন্দর অন্বেষণে তিনি চলে যান ধ্যানে আর আধ্যাত্মিকতায়। এটি তার কল্পনাকে আরও বর্ণিল করে দেয়। তার গান যেমন না পাওয়া প্রিয়ার প্রতি আবেদনপূর্ণ তেমনিভাবে একজন ভক্তের তার স্রষ্টার প্রতি ভক্তি নিবেদনও। তাই শুধু সাধারণ এক প্রেমিকা নয় রবীন্দ্রনাথ তার গানে অনন্তের সন্ধান করেন। সে যেন আধাচেনা কেউ। সে সিন্ধু পাড়ে থাকে তবু অচেনা। অনেকে একে রবীন্দ্রনাথের ‘জীবন দেবতা’ বলেন। লালনের ‘মনের মানুষ’-এর মতো খানিকটা। এগুলো সব রবীন্দ্রনাথের সমৃদ্ধ কল্পনার রূপায়ণ। সীমার মাঝেই অসীম স্রষ্টার বাস সেখানেই তিনি সুখময়তায় তাঁকে আবিষ্কার করেন : ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর/ আমার মাঝে তোমার প্রকাশ তাই এত সুমধুর।’ এভাবেই রবীন্দ্রনাথ এক সুমধুর পিপাসা নিয়ে তার কল্পনাকে সাজান পেতে চান নির্বস্তু অসীম সত্তার অনুভব। রোমান্টিক লেখকদের মানসচিত্তে যে জাগরণ সেটি ঘটে তিনটি ধাপে; প্রথমে তারা হৃদয়ে কোন এক সত্যের (ংধঃুধস) সন্ধান পান; এটা আসে রোমাঞ্চ নিয়ে প্রকৃতির অনুপম রূপে মুগ্ধ হয়ে এক অজানা অনুভবে পুলকিত হয়ে। রবীন্দ্রনাথ অনির্বচনীয় আনন্দে মেতে ওঠেন; ‘মোর ভাবোনারে কী হাওয়ায় মাতালো/ দোলে মন দোলে অকারণ হরষে।’ এর পরের স্তরে তারা খুঁজে পান এক ধরনের জ্ঞানের সন্ধান (মুধহধস) এ মুহূর্তে সে বুঝতে পারে তার জীবনী শান্তি পরিপূর্ণ হবে না যদি তা প্রকাশিত না হয় অনন্তে। রবীন্দ্রনাথ যেন জানেন; আনন্দলোকে মঙ্গল আলোকে বিরাজ করে সত্য ও সুন্দর। জাগরণের তৃতীয় ধাপে এক অনন্ত (ধহধহঃধস) ভালবাসা এদের মনের নিভৃত কোণ জাগিয়ে তোলে। রবীন্দ্রনাথ জগতব্যাপী ভালবাসার জাল বিস্তৃত দেখেন : ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি/এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি।’ মায়াময় হৃদয় ভোলানো কল্পনায় রবীন্দ্র-মন আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে যায়। রূপ সাগরে তিনি ডুব দেন অরূপ রতন আশা করে। তাই সুর বেজে ওঠে : ‘রূপ সাগরে ডুব দিয়েছি অরূপ রতন আশা করি, ঘাটে ঘাটে ঘুরব না আর ভাসিয়ে আমার জীর্ণ তরী।’ রোমান্টিকদের এই কল্পনায় হারিয়ে যাবার পেছনে থাকে এক গভীর বোধ। হতে পারে তা ব্যক্তিগত না পাওয়া, বিরাট নিরাশা, বা সামাজিক ও মানসিক শিথিলতা যা তাদের কোমল আবেগকে ক্ষতবিক্ষত করে। তাই রবীন্দ্রনাথের ‘জীর্ণ তরী’ হচ্ছে জীবনের বেদনার ভার। এই বেদনার ভার সহ্য করতে না পেরে তিনি আশ্রয় নেন কল্পলোকের মোহময় ভুবনে। সেখানে তৈরি করেন নব নব চেতনায় মোহনীয় ভুবন। অনিন্দ্য আলোকের ঝরনাধারায় ডুবে যান; তিনি প্রার্থনা করেন ‘আরো আলো আরো আলো/ এই নয়নে প্রভু ঢালো।’ স্বপন পারের ডাকে রবীন্দ্রনাথ চলে যান, জাগতিক বেদনা ভুলতে, আনন্দময় স্বপ্নলোকে সেখানে বিশ্ব হৃদয়ের সঙ্গে মানব হৃদয়ের সেতুবন্ধন ঘটে; ভরহরঃব-এর সঙ্গে রহভরহরঃব-এর। কিন্তু কবি মন তখনও দোলায় দুলে কারণ তিনি জানেন না কেউ কখনও স্বপ্নলোকের চাবি খুঁজে পান কিনা। চাবি রবীন্দ্র গানে প্রতীক হয়ে আসে; তিনি সেই চাবি দিয়ে অপার পাড়ে যেতে চান। তার চাওয়া : ‘ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে।’ এমনিভাবে রবীন্দ্রনাথ তলিয়ে যান কল্পনার অনন্ত গহিনে আনন্দঘন প্রেম নিয়ে। সুদূরের দিকে তার উদাসী মন উড়ে যায় ‘দূরে কোথায় দূরে/ আমার মন বেড়ায় ঘুরে।’ লালনের মতো অচিনকে খুঁজে : ‘যে পথ সকল দেশ পারায়ে / উদাস হয়ে যায় হারায়ে/ সে পথ বেয়ে কাঙাল পরান/ যেতে চায় কোন অচিন পুরে।’ সুদূরের প্রতি এই পথ চাওয়ায় তার আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে : ‘আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ/ খেলে যায় রৌদ্র ছায়া, বর্ষা আসে আনন্দ।’ কল্পনার অবিরাম সুগন্ধ তাঁকে মোহিত করে : ‘ততখন ক্ষণে ক্ষণে হাসি গাই আপন মনে/ ততখন রহি রহি ভেসে আসে সুগন্ধ।’ কিন্তু আনন্দঘন ভুবনেও পৃথিবীর বেদনা তাঁকে খোঁচা দেয়। তাই তার আনন্দের গানেও বেদনা প্রতীয়মান। ‘আনন্দ ধারা বহিছে ভুবনে / দিবস রজনী কত অমৃতরস উথলি যায় অনন্ত গগনে।‘ স্বার্থপরতা মানুষে মানুষে যে শূন্যতা বপন করে রবীন্দ্রনাথ সেটাও ধ্বনিত করেন এই গানে। তার প্রশ্ন ‘বসিয়া আছো কেন আপন মনে/ স্বার্থ নিমগ্ন কী কারণে? তার আহ্বান এই বিশ্ব প্রকৃতির মহা উদারতায় ব্যর্থ জীবনকে প্রেমে পরিপূর্ণ করতে। তিনি জীবনের দায়িত্বে ভুলে ছিলেন নিজেকে; ছিলেন ভুলে তার স্রষ্টাকে; হয়ত তা তার উদ্বায়ী কল্পনার কারণেই তাই তার অকপট প্রকাশ- ‘জীবন দোলায় দুলে দুলে আপনারে ছিলাম ভুলে / এখন জীবন মরণ দুদিক দিয়ে নিবে আমায় টানি।’ বিজন ঘরের অজানা অতিথিকে সব ফেলে তুলে দিতে চান নিজেকে। তিনি যেমন জেনেশুনে বিষপান করেন তেমনি জানেন তার আকাক্সক্ষা কখনও মিটবে না তবু সবার বেদনাকে নিজের করে নিয়ে বলেন ‘আমি সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়/ আমি তার লাগি পথ চেয়ে আছি যে জন আমায় ভাসায়।’ রবীন্দ্রনাথের কল্পনা যেমন বিপুল তেমনি তা না মেটা অপ্রাপ্তিতে অতৃপ্ত। কারণ তিনি জানেন যার জন্য মনের ভেতরে এত হাহাকার সে ধরা দিবে না । তার গভীর বেদনাবোধ আবার ধরা পরে ‘দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি।’ তিনি তার স্বপ্নের কথাও বলেন ‘জাগরণে তারে না দেখিতে পাই, থাকি স্বপনের আশেÑ’ এই স্বপ্নই তার কল্পনা। কিন্তু তিনি পুরোপুরি ব্যর্থ নন কারণ তার পরিশুদ্ধ কল্পনা স্বপ্নচারিণীকে তার মনের কোণে নিয়ে আসে ‘এত ভালোবাসি, এত যারে চাই / মনে হয় না তো সে যে কাছে নাই।’ এভাবেই তার না পাওয়া প্রেম পূর্ণ হয় ব্যাকুল বাসনাকে কল্পনার-সত্যে রূপ দিয়ে। কিছু কিছু গানে সুদূরের ছোঁয়া লেগে থাকে। তার ব্যক্তি প্রেমকে মহাজাগতিক প্রেমে ছড়িয়ে দেন। ‘কোথায় তুমি মম অজনা সাথি / কাটাও বিজনে বিরহ- রাতি/ এসো এসো উধাও পথের যাত্রী।’ উধাও শব্দটি বিশেষ বার্তা বহন করে। ‘মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে’ গানটিও কল্পনার আশ্রয়ে রঞ্জিত ‘কম্পিত হৃদয়’ ‘তুমি আছো দূর ভুবনে’ কল্পনার অসফলতার ইঙ্গিত; রবীন্দ্রনাথের কল্পনারও এখানে একটা অন্তিমতা লক্ষ্য করা যায়। তার কল্পনা মনে দ্বিধা রেখে চলে যায়। তার দিনগুলি বেশিদিন সোনার খাঁচায় থাকে না। তিনি ব্যথিত অর্ন্তযামীর নিঃশব্দতায় : ‘এত বেদন হয় কি ফাঁকি/ ওরা কি সব ছায়ার পাখি/ আকাশ পানে কিছুই কি গো বইলো না।’ তার কল্পনার পাখি ছায়ার পাখি হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারেন কল্পনার জগত সীমাহীন আনন্দময়ী হতে পারে কিন্তু পার্থিব জগত মিথ্যা নয়। তাই তার মায়া বনে বিহার বেশি সময় টেকে না। কীটস ‘সাইকি’ কবিতা দিয়ে স্বপ্ন রাজ্যে ডুব দেন কিন্তু আবার ‘ওড টু অটম’ দিয়ে পার্থিব জগতে ফিরে আসেন; কারণ তার কল্পনার জগত বেশিক্ষণ মায়া দিয়ে তাঁকে ধরে রাখতে পারে না। কোলরিজের ‘আনসান্ট ম্যারিনার’ও কুহকী সমুদ্র থেকে ফিরে আসে সত্য সমুদ্রের কুলে। রবীন্দ্রনাথও তেমনি অনেক হতাশা ভরে বুঝতে পারেন তার কল্পনার নিস্ফলতা ‘আমি কেবলই স্বপন করেছি বপন বাতাসে/ তাই আকাশকুসুম করিনু চয়ন হতাশে।’ মিথ্যা স্বপ্নের মায়াজাল থেকে এভাবেই বাস্তবে ফেরেন স্বপ্নের আসমানদারী রবীন্দ্রনাথ। তিনি বুঝতে পারেন তিনি যেই মায়ার জগতে বিহার করছিলেন তা আসলে এক ধরনের ভ্রান্তি-বিলাস; স্বপ্ন নিমগ্নতা। তার গানে তাই ধ্বনিত হয় ‘এ শুধু অলস মায়া/ এ শুধু মেঘের খেলা।’ কল্পনার মিথ্যা জগতে তিনি বিভ্রান্ত ‘কুহকের দেশে যেন সাধ করে পথ ভুলি।’ রবীন্দ্রনাথ নিদারুণ ব্যর্থতায় মেনে নেন তার অসফল স্বপ্ন-বিলাসিতা ‘যে ছিলো আমার স্বপনচারিণী তারে বুঝিতে পারিনি। / দিন চলে গেছে খুঁজিতে খুঁজিতে।’ রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারেন কে যেন তার কল্পনাকে নিয়ন্ত্রণ করছেন তাই তিনি তার প্রতি নির্মোহভাবে বলেন ‘তোমার আপন হাতের দোলে দোলাও।’ তার স্বীকারোক্তি ‘আমি ছিলাম তোমার খেলার সাথি।’ তার মোহের জগতের প্রতি আরও নিস্পৃহতা পরিষ্কার হয় তার প্রবল বাসনা ভঙ্গের শেষ পর্যায়ে ‘আমি কান পেতে রই ও আমার আপন হৃদয় গহন-দ্বারে বারে বারে/ কোন গোপনবাসীর কান্নাহাসির গোপন কথা শুনিবারে।’ ঐন্দ্রজালিক মোহ তাঁকে আড়াল করে রাখে কিছু বুঝে ওঠার মাঝে দেয়াল হয়ে ‘কে সে মোর কেই বা জানে, কিছু তার দেখি আভা/ কিছু পাই অনুমানে, কিছু তার বুঝি না বা।’ এভাবেই মায়ার লোক থেকে রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে ফিরে আসেন পৃথিবীর পথে। তিনি বিধাতার কাছে নিজেকে তুলে দেন ‘পথ আমারে সেই দেখাবে যে আমারে চায়/ আমি অভয় মনে ছাড়ব তরী এই শুধু মোর দায়।’ ‘রূপ নারানের কুলে’ কবিতায় কবি সরাসরি এই দৃশ্যমান জগতকে মেনে নেন শত প্রতিকূলতাকে স্বীকার করে নিয়ে; তার বিখ্যাত উক্তি ‘সত্য যে কঠিন সে কঠিনেরে ভালোবাসিলাম।’ এই সত্য হচ্ছে এই জগতের বেদনা, ক্ষয়, মৃত্যু; এসব মেনে নিয়েই কবি এই বস্তু-জগতে ফিরে আসেন। ‘মাটির ডাক’ কবিতাটি এটির নাম দিয়েই বুঝায় কবিকে এই সত্য জগত ডাকছে। মৃত্যু, বেদনা, কষ্ট এগুলো জীবনের পথে পাথেয়; বাঁধা নয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছিলেন জীবনের এই ঋণ আমরা পরিশোধ করি মৃত্যু দিয়ে। তিনি, উল্লেখযোগ্যভাবে, এই ক্ষয়িঞ্চু পৃথিবীর মাঝেও খুশির রেশ খুঁজে পান: ‘আছে মৃত্যু, আছে দুঃখ, বিরহ দহন লাগে/ তবু শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে’। এভাবেই রবীন্দ্রনাথ অনন্তের মাঝে ক্ষুদ্র নিজেকে সঁপে দেন আর গ্রহণ করেন অনেক ব্যথার জীবনকে হাসি মুখে, কারণ : ‘হাসি কান্না হীরা পান্না দোলে ভালে/ কাঁপে ছন্দ ভালো মন্দ তালে তালে/ নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু , পাছে পাছে।’ মৃত্যু ছাড়া জীবন পূর্ণ হতে পারে না। বেদনা ছাড়া এই জীবন পূর্ণ হতে পারে না এটা তার এক বড় আত্ম-উপলব্ধি। দুঃখ, কষ্ট, হাসি-কান্না নিয়েই এই জীবন; বেদনাকে পুরোপুরি পরিত্যাগ করলে সুখের কোন মূল্য থাকে না। বেদনা আছে বলেই সুখ সুখতর হয়ে ওঠে। এটা রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক বোধগম্যতা। তাই ‘মধুর বেদনা’ ‘ভালোবাসার ঘায়’ জীবনের সুখ ও বেদনাকে পাশাপাশি রাখার সাহস যোগায় তাঁকে।’ রবীন্দ্রনাথ আরও জোরালোভাবে ফিরে আসেন মাটির টানে অলীক কল্পনার চেয়ে বেশি সুখময়তা এই মাটি, গাছ আর ফুল ফসলে। তিনি স্বপ্ন ভেঙ্গে নেমে আসেন সত্যি ধরা তলে; ফসলের মাঠে। কীটস যেমনটা ‘ওড টু অটম’ কবিতায় প্রকৃতিরূপে বিমুগ্ধ; রবীন্দ্রনাথও তেমনি। তার বস্তু জগতকে গ্রহণ বিখ্যাত হয়ে থাকে এই গানে : ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরির খেলা / নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা/ আজ বিনা কাজে বাজিয়ে বাঁশি কাটবে সকল বেলা।’ এভাবে রবীন্দ্রনাথ আকাশ কুসুম কল্পনা থেকে এই মাটির পৃথিবীতে নেমে আসেন। তিনি স্বপ্নচারিতা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন আর মহাবিশ্বে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে তার অস্তিত্ব বুঝতে পারেন; সুরের কবি এভাবে এক থেকে সর্বজনে ছড়িয়ে দেন তার চেতনা আর সমৃদ্ধ মানব দর্শন। তিনি পরম আনন্দে এই পৃথিবীতে তার জাগরিত সত্তার অবস্থান দেখেন : আকাশ ভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ/ তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান/ বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।’ শুধু উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প বা কবিতায় নয় তার গানেও রবীন্দ্রনাথ রেখে গেছেন জীবনের জন্যে গভীর দর্শন। তার গানকে তাই নানান দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়। তবে জীবনের জন্য তার যে দর্শন; কল্পনার মায়াবী জগত থেকে ভূমিতলে তার যে পদার্পণ ও জীবনের সত্যরূপের সন্ধান-চেষ্টা তা অতুলনীয় হয়ে থাকে। এভাবেই রবীন্দ্রনাথের গান শুধু মধুর সুর নয় অমিয় বাণী দিয়ে জীবনের জন্য বিশেষ বার্তা বহন করে চলে।
×