ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ জুন ২০২৫, ৯ আষাঢ় ১৪৩২

সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের শহর: কুয়াকাটার অপরূপ সম্ভাবনার গল্প

ইব্রাহিম ওয়াহিদ, কনট্রিবিউটিং রিপোর্টার,কুয়াকাটা,পটুয়াখালী

প্রকাশিত: ০৭:২১, ২৩ জুন ২০২৫

সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের শহর: কুয়াকাটার অপরূপ সম্ভাবনার গল্প

ছবি: জনকণ্ঠ

প্রতিদিনের একঘেয়ে জীবনের ক্লান্তি থেকে বেরিয়ে যারা প্রকৃতির কোলে একটু প্রশান্তি খোঁজেন, তাদের জন্য বাংলাদেশের দক্ষিণ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে সাগরকন্যা খ্যাত কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত।

এটি বাংলাদেশের একমাত্র জায়গা,যেখানে দাঁড়িয়ে চোখের সামনেই দেখা যায় রাঙা ভোরের সূর্যোদয় আর সন্ধ্যার সোনালি সূর্যাস্ত। একপাশে যখন সমুদ্রের তীরে সূর্য ধীরে ধীরে জেগে ওঠে, অন্য পাশে তখনো তার রং লেগে থাকে বালিতে। এমন অভিজ্ঞতা কুয়াকাটায় না এলে অনুভব করা যায় না শুধু দেখা যায়।


কুয়াকাটা শুধু একটি সমুদ্র সৈকত নয়, এটি যেন প্রকৃতির হাতে গড়া এক শিল্পকর্ম। পরিচ্ছন্ন বালুকাবেলা,ঢেউয়ের একটানা ছন্দ,নীল আকাশ আর শান্ত বাতাস সব মিলিয়ে এখানে সময় যেন অন্যরকম চলে।

শীত এলেই ভিড় বাড়ে পর্যটকদের। সমুদ্রের ধারে হাঁটা,সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ অবলোকন করা এবং নৌকায় চড়ার পাশাপাশি রয়েছে স্থানীয় খাবার এবং শত শত বছরের রাখাইনদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি।

সমুদ্রের বুক চিরে জেগে ওঠা নতুন সৈকত 'চর বিজয়' যেন কুয়াকাটার নতুন চমক। প্রায় ৫ হাজার একরের বিস্তৃত বালুর চরে হাজারো লাল কাঁকড়ার আনাগোনা আর হাজার হাজার অতিথি পাখিদের কোলাহল একটি জীবন্ত পোস্টকার্ডের মতো।

এখানে পা রাখলে মনে হয়, আপনি বাংলাদেশের মধ্যে থেকেও কোনো অজানা দ্বীপে হারিয়ে গেছেন। ট্রলার বা স্পিড বোট ভাড়া করে এক ঝলকেই দেখা যায় এই বিস্ময়কর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য,যদিও এটি শুধু শীতকালে উপভোগ করা যায়।

পাশাপাশি এখানে রয়েছে ফাতরার বন,গঙ্গামতির চর,কাউয়ার চর,লেম্বুর বন,শুঁটকি পল্লী,মিশ্রীপাড়া রাখাইন পল্লী,রাখাইনদের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প,বৌদ্ধ মন্দির এবং  লাল কাঁকড়ার চর প্রতিটি জায়গার আছে আলাদা-আলাদা গল্প। কখনও নিঃশব্দ বন, কখনও সাগরের গর্জন, কখনও বা রাখাইনদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি, সবকিছুই মিলেমিশে গড়ে তুলেছে কুয়াকাটাকে এক ভিন্ন অভিজ্ঞতার নাম।


আগের সেই কষ্টসাধ্য যাত্রার দিন শেষ,এখন এখানকার যাতায়াত ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। এখন ঢাকা থেকে সরাসরি সব ব্যানারের বাস চলে কুয়াকাটায়।পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর পথ যেমন ছোট হয়েছে, তেমনি কমেছে সময়ও।এই সহজ যাতায়াত ব্যবস্থাই পর্যটকদের আগ্রহ বাড়িয়েছে কয়েক গুণ।

তবে স্বপ্নপূরণের পথে কিছু বাধাও রয়েছে। এখানের সৈকত রক্ষায় জিও ব্যাগের মাধ্যমে সমুদ্রের বালু ক্ষয়রোধে যে প্রকল্প হাতে নিয়েছিলো, সেগুলো এখন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। আগত পর্যটকরা প্রায়ই সমুদ্রে গোসলে নেমে আহত হয়ে ফিরে যাচ্ছে, পাশাপাশি পর্যাপ্ত বিশ্রামের জায়গা এবং নিরাপত্তার ঘাটতি অনেক পর্যটককে বিব্রত করে।


তবে আশার খবর হচ্ছে, সরকার ইতোমধ্যে কুয়াকাটাকে বিশ্বমানের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। বেসরকারি পর্যায়েও তৈরি হচ্ছে আধুনিক রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট ও ভ্রমণ সুবিধা। স্থানীয় তরুণরা যুক্ত হচ্ছেন গাইডিং, হোমস্টে সহ বিভিন্ন পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়।

পর্যটন বিশেষজ্ঞদের মতে, কুয়াকাটার অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য,সমুদ্রস্নানের সুবর্ণ সুযোগ এবং সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত একসাথে দেখার অনন্য অভিজ্ঞতা।এই অঞ্চলটিকে একটি আন্তর্জাতিক মানের ট্যুরিস্ট হাবে রূপান্তরের বিপুল সম্ভাবনা এনে দিয়েছে।

তবে এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে পরিণত করতে হলে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা,পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণ, নিরাপত্তা জোরদারকরণ এবং পর্যটকদের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ। তাদের পর্যটন বান্ধব দক্ষতা বৃদ্ধি, সেবামূলক খাতে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং ক্ষুদ্র ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করলে স্থানীয় অর্থনীতি যেমন শক্তিশালী হবে, তেমনি পর্যটকদের অভিজ্ঞতাও হবে আন্তরিক ও অর্থবহ। এতে স্থানীয় মানুষ নিজেরাই হয়ে উঠবেন কুয়াকাটার 'পর্যটন দূত'।


সূর্যোদয়ের আলো যেমন নতুন দিনের বার্তা দেয়, কুয়াকাটাও তেমনি হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের পর্যটনের নতুন সকাল। দরকার শুধু সহানুভূতিশীল পরিকল্পনা, সচেতনতা আর ভালোবাসা।

সাব্বির

×