ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

গল্প ॥ জাদুর কাঠি সোনার বাটি

প্রকাশিত: ০৯:২২, ২০ এপ্রিল ২০১৯

গল্প ॥ জাদুর কাঠি সোনার বাটি

অনেক অনেক দিন আগের কথা। এক গ্রামে এক গরিব কৃষক বাস করতেন। তিনি গরিব হলেও ছিলেন সৎ ও সরল মানুষ। এই কৃষকের নিজের কোন জমি ছিল না। তাই তিনি জমিদারের জমি চাষ করতেন। খুব খেটে ফসল ফলাতেন। জমির ফসল তিন ভাগের দুইভাগ দিতেন জমিদারকে আর একভাগ পেতেন নিজে। জমিদার ছিলেন খুব লোভী ও অত্যাচারী। একবার কৃষক ধান কেটে জমিদারের বাড়িতে আনলেন। তখন জমিদার বললেন, ‘তুমি কাল এসে ধানের অর্ধেক নিয়ে যেয়ো।’ রাতে জমিদারের লোকেরা বেশির ভাগ ধান সরিয়ে নিয়ে গুদামে রেখে দিল। পরদিন খুব সামান্য ধান দেখিয়ে জমিদার বললেন, ‘এই ফসল তুমি ফলিয়েছো। এখন তিন ভাগের এক নিয়ে যাও।’ কৃষক ফসল ভাগ করলেন। জমিদার বললেন, ‘বাহ্ অনেক ধান পেয়েছ। তোমার ভাগ নিয়ে যাও।’ কৃষক মনে মনে বললেন, ‘কাল এত ধান আনলাম আর আমার ভাগে এত কম দিয়ে জমিদার একি কথা বলছেন!’ কৃষক মনের দুঃখে বললেন, ‘বাবুজি, আমার ভাগে এই সামান্যটুকু? আমি কি আর ফসল পাব না? গতকাল তো অনেক ধান এনেছিলাম।’ জমিদার বললেন, ‘তুমি তো বেজায় পাজি লোক দেখতে পাচ্ছি। তোমার তিনভাগের একভাগ ধান তুমি নিজের হাতেই করে নিয়েছ। তাহলে এর চেয়ে বেশি আশা করছ কেন? এইটুকু নিতে চাইলে নিয়ে যাও, না-হয় খালি হাতেই রাস্তা মাপে বাপু।’ কৃষক শেষ পর্যন্ত সামান্য ধান নিয়েই বাড়ির দিকে রওনা হলেন। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলেন। আর ভাবছেন কীভাবে সারাটা বছর খেয়ে পরে বাঁচবেন। কৃষকের কান্না দেখে পথের পাশের এক জঙ্গল থেকে এক দরবেশ বের হলেন। দরবেশ কৃষককে বললেন, ‘তুমি কাঁদছো কেন হে গরিব কৃষক?’ তখন কৃষক বললেন, ‘হুজুর, আমি অনেক ধান ফলিয়েছি। জমিদার বাবু আমাকে ঠকিয়েছেন।’ দরবেশ বললেন, ‘অত্যাচারী জমিদার, কাজটা ভাল করেননি। আচ্ছা, তোমার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, তুমি খুব দুঃখী মানুষ। আচ্ছা, ঠিক আছে, তুমি চিন্তা কর না।’ এই বলে দরবেশ এক হাত লম্বা একটা বাঁশের কাঠি দিয়ে বললেন, ‘তুমি এটি দিয়ে যদি মাটির বাটিতে আঘাত করে বলতে পারÑ ছুঁয়ে দিলাম জাদুর কাঠি হয়ে যাও তো সোনার বাটি। তাহলে দেখবে, মাটির বাটি সোনার বাটি হয়ে যাবে। তখন সোনার বাটি বিক্রি করে তুমি ধনী হতে পারবে। তবে দুটি কথা মনে রাখবে- একটি হলো, এই কাঠি যদি মাটিতে রাখ, তাহলে সেটি কিন্তু সাপ হয়ে যাবে। তাই এই কাঠি সব সময় তোমার ঘরের চালে গুঁজে রাখবে। আর দ্বিতীয় কথা হলো, এই কাঠি দিয়ে প্রতিমাসে একটি মাটির বাটি সোনার বাটি বানাতে পারবে। তুমি কখনও লোভে পড়ে এক মাসে একটির বেশি বাটিকে সোনার বাটি বানাবে না। তাহলে একটি সোনার বাটি বানিয়ে দ্বিতীয়টি বানাতে চাইলে দুটিই মাটির বাটি হয়ে যাবে।’ কৃষক তো মহা খুশি। তিনি হাসতে হাসতে বাড়িতে চলে গেলেন। তারপর রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে কৃষক কাঠি দিয়ে একটা মাটির বাটিতে আঘাত করে বললেন- ছুঁয়ে দিলাম জাদুর কাঠি হয়ে যাও তো সোনার বাটি। কৃষক অবাক হয়ে দেখলেন, বাটিটি সোনার হয়ে গেছে। এখন এই বাটি কোথায় বিক্রি করবেন? পড়লেন মহাচিন্তায়। হঠাৎ তাঁর মনে হলো জমিদারের কাছে করবে। রাতে ঘরের চালে লাঠিটি গুঁজে রেখে কৃষক ঘুমিয়ে পড়লেন। পরদিন সকালবেলা কৃষক জমিদারের কাছে সোনার বাটি বিক্রি করতে গেলেন। জমিদার তো সোনার বাটি দেখে অবাক। জমিদার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এই বাটি কোথায় পেয়েছ? নিশ্চয়ই আমার বাড়ি থেকে চুরি করেছ?’ কৃষক বললেন, ‘বাবুজি, আমি চুরি করি নাই। আমি এটি পেয়েছি।’ জমিদার রেগে বললেন, ‘কী পেয়েছিস? মিথ্যে বলছিস। সোনার বাটি কি পথে ঘাটে পড়ে থাকে?’ জমিদার তখন তার লাঠিয়ালকে ডেকে বললেন, ‘একে বেঁধে পিটুনি লাগাও। ব্যাটা চোর কোথাকার। আর বাটিটি আমার ঘরে রেখে আস।’ জমিদারের কথায় লাঠিয়াল কৃষককে পিটাতে শুরু করলে কৃষক ঘটনা খুলে বললেন। জমিদার তো মহা খুশি। তিনি মনে মনে বললেন, ‘বাঃ! তাহলে তো আরও বড় জমিদার হওয়ার যন্ত্র পেয়ে গেছি।’ জমিদার কৃষককে বললেন, ‘তাহলে তোমার কাঠি এনে সোনার বাটি বানিয়ে দেখাও দেখি, তোমার কথা সত্য কিনা? না-হয় কেন বিশ^াস করব?’ গরিব কৃষক তখন বললেন, ‘একটা নিয়ম আছে বাবুজি। একবার বাটি বানালে তারপর এক মাস পরে আরেকবার বানাতে হবে। আমাকে এক মাস সময় দিন।’ জমিদার বললেন, ‘ঠিক আছে, তা-ই হবে। তুমি এক মাস পরে এসে আমাকে সোনার বাটি বানিয়ে দেখাবে।’ এক মাস পরে কৃষক ঘরের চালে গুঁজে রাখা কাঠি এনে একটা মাটির বাটিতে আঘাত করে বললেন, ছুঁয়ে দিলাম জাদুর কাঠি হয়ে যাও তো সোনার বাটি।’ আর তখনই বাটিটি সোনার হয়ে গেল। এই দৃশ্য দেখে জমিদারের জ্ঞান হারানোর অবস্থা। তিনি তাড়াতাড়ি বুদ্ধি করে কৃষকের কাছ থেকে কাঠিটি রেখে দিয়ে পিটিয়ে বিদায় করে দিলেন। পিটুনি খেয়ে কৃষক আবার কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে চলে গেলেন। জমিদার তখন লাঠি নিয়ে তাঁর নিজের ঘরে চলে গেলেন। তিনি এক মাস পরে সোনার বাটি বানাতে হয় তাও ভুলে গেলেন। নিজের ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে দশটি মাটির বাটি এক সারিতে রাখলেন। তারপর প্রথম বাটিতে কাঠি দিয়ে আঘাত করে বললেন, ছুঁয়ে দিলাম জাদুর কাঠি হয়ে যাও তো সোনার বাটি।’ মাটির বাটি সোনার বাটি হয়নি। এই অবস্থা দেখে জমিদার আগের সোনার বাটিটি দেখলেন, সেটিও মাটির হয়ে গেছে। জমিদার তো খুব মুশকিলে পড়লেন। তিনি রাগে ফেটে পড়লেন। তারপর জমিদার দ্বিতীয় বাটিতে আঘাত করলেন, কিন্তু সেটিও সোনার বাটি হলো না। জমিদার আবার তৃতীয় বাটিতে কাঠি দিয়ে আঘাত করে বললেন সোনার বাটি হতে। কিন্তু না, আর কোন বাটিই সোনার বাটি হলো না। জমিদার রাগে-দুঃখে তখন লাঠিটি মাটিতে ছুড়ে মারলেন। সঙ্গে সঙ্গে এক বিরাট সাপ হয়ে গেল। সাপ দেখে তো জমিদার দৌড়াতে লাগলেন। দৌড়াতে দৌড়াতে কৃষকের বাড়িতে এসে উঠলেন। তারপর কৃষকের কাছে ক্ষমা চেয়ে বললেন, ‘কৃষক ভাই, আমি তোমার সঙ্গে অবিচার করেছি। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও।’ কৃষক ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মনে মনে খুশি হলেন। কৃষক ঠিকই বুঝতে পারলেন যে কাঠিটি এখন সাপ হয়ে গেছে। জমিদার ভয়ে কাবু হয়ে গেছেন। তখন তিনি বললেন, ‘তোমার সোনার বাটির দাম এবং ফসলের সব পাওনা তোমাকে দিয়ে দেব। তবু তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। না হয় আমাকে সাপের কামড়ে মরতে হবে।’ জমিদার তখন কৃষকের ফসলের ঠিক পাওনা এবং সোনার বাটির দাম দিয়ে দিলেন। কিন্তু কৃষক মনে মনে সাপটি খুঁজতে লাগলেন। না, কাঠিটি সাপ হয়ে পালিয়ে গেছে। তাই কৃষকও সেটিকে আর পেলেন না। তাতে কী? কৃষক এখন অনেক ফসল আর জমিদারের কাছ থেকে সোনার বাটির অনেক টাকা পেলেন। তা দিয়ে জমি কিনলেন। তাঁর তো সম্পদের লোভ নেই, তাই তিনি সেই কাঠি আর খুঁজতে যাননি। তিনি তার জমিতেই ফসল চাষ করতে লাগলেন। তাতে যে ফসল হয়, তা নিয়েই তিনি সুখী। অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার
×