ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

একাত্তরের অপরাজিতা মমতাজ বেগম

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

একাত্তরের অপরাজিতা মমতাজ বেগম

বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মমতাজ বেগম। একাত্তরে বাংলার মুক্তি যুদ্ধের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলির এক নারী সাহসিকা। রক্তে তার রাজনীতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছার স্নেহছায়ায় লালিত মমতাজ বেগম পাড়ি দিয়েছেন রাজনীতির দীর্ঘ বন্ধুর পথ। স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি আদর্শিক আনুগত্য আর নারী অধিকারের পক্ষে সোচ্চার কণ্ঠের প্রতীক। কিছুটা নিভৃতচারী, পেশায় অধ্যাপক। বর্ণাঢ্য কর্ম ও রাজনৈতিক জীবন। জন্ম ১৯৪৬ সালের ১৩ এপ্রিল। বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা থানার শিমরাইল গ্রামে। পিতা মরহুম আব্দুল গনি ভূঁইয়া ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কর্মী হিসেবে ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৮তে সামরিক শাসনকালে পিতা ছিলেন রাজবন্দী, মহান মুক্তিযুদ্ধে পালন করেছেন সংগঠকের ভূমিকা। মাতা সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যা জাহানার খানমও ভূমিকা রাখেন মুক্তিযুদ্ধে। বীর মুক্তিযোদ্ধা দুই ভাইয়ের একমাত্র বোন মমতাজ বেগম। মমতাজ বেগমের রাজনৈতিক পথচলার শুরু শৈশবে। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনে ঢাকায় ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র মমতাজ বেগম চাচাত ভাইয়ের হাত ধরে অবস্থান নেন রেল লাইনে। ঢাকার কামরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ ১৯৬১তে। ইডেন কলেজে পড়াকালীন ১৯৬২তে শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বে ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের আন্দোলেন অগ্রনী ভূমিকার কারণে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়া হয়নি যথাসময়ে। অতঃপর কুমিল্লা মহিলা কলেজ থেকে ১৯৬৫তে উচ্চ মাধ্যমিক ও ১৯৬৭তে স্নাতক। ১৯৬৯-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে এমএ। ১৯৭৮-এ এলএলবি। কুমিল্লা মহিলা কলেজের ছাত্রী সংসদে ১৯৬৫-৬৬তে প্রথম নির্বাচিত সহ-সভাপতি হিসেবে ৬ দফা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তার সভাপতিত্বে ১৯৬৭-৬৮ সালে গঠিত হয় রোকেয়া হল ছাত্রলীগের প্রথম কমিটি। ভূমিকা রাখেন ১১ দফা আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে। অসহযোগ আন্দোলনে শেখ ফজলুল হক মণির প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন, সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে ব্যাপক গণসংযোগ এবং বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছার পরামর্শে নির্বাচনে অংশ নিয়ে তৎকালীন জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত। বঙ্গবন্ধু নিজে মমতাজ বেগমসহ অন্যান্য নির্বাচিত নারী সদস্যকে অভিনন্দন জানান। ৭ মার্চ ভাষণ শোনার পর মনোযোগী হন মহিলাদের গোপন সামরিক প্রশিক্ষণ ও প্রাথমিক পরিচর্যার প্রশিক্ষণ প্রদানে। ২৫ মার্চ হানাদার বাহিনীর আক্রমণ শুরু হলে ঢাকা থেকে হেঁটে, নৌকায়, রিক্সায় চড়ে কসবায় নিজ বাড়িতে পৌঁছান। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে আসা মেজর বাহারকে সহযোগিতা করেন মুক্তিবাহিনী গঠনে। পাকিস্তানী গুপ্তচর সন্দেহে ভুল বোঝাবুঝিতে আটক জেনারেল ওসমানীকে আগরতলায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন। ৯ এপ্রিল রাতে ভারত থেকে শেখ ফজলুল হক মণি একটি জীপে করে আসেন তাদের বাড়ি কসবার ‘গনি মঞ্জিলে’। ওইদিনই মমতাজ বেগম শেখ মণির সঙ্গে জীপে করে আগরতলা সার্কিট হাউসে যান। ১০ এপ্রিল সন্ধ্যায় আগরতলা সার্কিট হাউসে গঠন করা হয় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার। মহিলা জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি একাই উপস্থিত ছিলেন সে অনুষ্ঠানে। পরদিন ১১ এপ্রিল ফিরে আসেন নিজ বাড়ি ‘গনি মঞ্জিলে’। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম সফল অপারেশনের অন্যতম ইলিয়টগঞ্জের দুটি পুল উড়িয়ে দেয়াতে রাখেন বিশেষ ভূমিকা। ১৯৭১ এর মে মাসে ‘বিএলএফ’, যা ‘মুজিব বাহিনী’ নামেও পরিচিত গঠিত হলে সেখানে যোগ দেন। ছিলেন পূর্বাঞ্চলীয় ‘বিএলএফ’র পরিচালনা পর্ষদের সদস্য, যার প্রধান ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি। আগরতলা বিএসএফ হেডকোয়ার্টারে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন হাল্কা অস্ত্র ও যুদ্ধ পরিচালনার। দায়িত্ব পালন করেছেন ‘বিএলএফ’ ও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মাঝে যোগাযোগ রক্ষার। ‘বিএলএফ’-এর আর্থিক তহবিলও রক্ষিত ছিল তার কাছে। এই তহবিলকে ঘিরে আছে মজার স্মৃতি। তখনকার নিবাস বিশালগড়ের বাড়িতে সিঁদকেটে চুরি হয়, চোর টাকার ট্রাঙ্ক ভেবে চুরি করে নিয়ে যায় তার গহনা রক্ষিত ট্রাঙ্কটি। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর খাতাগুলো ছিল সে ট্রাঙ্কে যা শেখ ফজলুল হক মণি রাখতে দিয়েছিলেন মমতাজ বেগমের কাছে। চোর গহনা নিয়ে আত্মজীবনীর খাতাগুলো ফেলে যায়। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো ছিল তাঁর জীবনে গর্বের ও কর্মমুখর দিন। কাজ করেছেন নারী মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে তোলা থেকে সেবা ও তাদের রাজনৈতিক মোটিভেশনে। সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন ক্যাপ্টেন গাফ্ফার ও মেজর খালেদ মোশারফের কর্মকা-ে। যুদ্ধাহত খালেদ মোশারফের চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। স্বাধীন বাংলাদেশে গণপরিষদের সদস্য হিসেবে শাসনতন্ত্র রচনায় সহযোগিতা ও স্বাক্ষর করেন। সংরক্ষিত মহিলা আসনের ব্যাপারে তার আনীত সংশোধনী প্রস্তাব গৃহীত হয় সংসদে। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ও নির্যাতিত মহিলাদের পুনর্বাসনে গঠিত ‘নারী পুনর্বাসন বোর্ডের’ সদস্য হয়ে কাজ করেছেন দেশজুড়ে। ১৯৭২-এ বাংলাদেশ মহিলা সমিতির লিগাল এইড কমিটির সদস্য হিসেবে ও পরবর্তীতে চেয়ারম্যান পদে আইনী সহায়তা প্রদানে নিরলস শ্রম দিয়েছেন। মহিলা সমিতির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন। ১৯৭৩-এ জাতীয় নির্বাচনে সাংসদ ও ১৯৭৪-এ বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন। জাতির পিতার নির্মম হত্যাকা-ের পর বেগম সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে জিয়াউর রহমান বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ। ১৯৯৬-এ মহিলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গঠনে সাজেদা চৌধুরীর সঙ্গে কার্যকরী ভূমিকার পাশাপাশি সহ-সভাপতির দায়িত্বও পালন করছেন অদ্যাবধি। ১৯৭০-এর ১৩ আগস্ট সরকারী শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী কলেজে অধ্যাপনা শুরু এবং টিচার্স ট্রেনিং কলেজের উপাধ্যক্ষ থেকে অবসর গ্রহণ ২০০৪-এ। অধ্যাপক মমতাজ বেগম ২০১৩ সাল থেকে যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক নারী উন্নয়ন সংস্থা। অংংড়পরধঃবফ ঈড়ঁহঃৎু ডড়সবহ ড়ভ ঃযব ড়িৎষফ এর অৎবধ ঢ়ৎবংরফবহঃ, ঈবহঃৎধষ ধহফ ঝড়ঁঃয’ং অৎবধ চৎবংরফবহঃ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ২০১৬ পর্যন্ত। ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে সর্বস্তরের মহিলাদের অবস্থার পরিবর্তনে কাজ করে যাচ্ছেন কোন পারিশ্রমিক না নিয়েই। বঙ্গবন্ধুর নারী-পুরুষ সমতার ভিত্তিতে সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্নে এখনও কাজ করে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। ডিজিটাল বাংলাদেশের পাশাপাশি আরেকটি শ্লোগাণ পৌঁছে দিতে চান ঘরে ঘরে, ‘শেখ হাসিনার বারতা, নারী পুরুষ সমতা’। বাংলাদেশের নারীদের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেছেন ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, বুলগেরিয়া, আমেরিকা, জার্মানি, হংকং, কানাডা, ভারত, মালয়েশিয়াসহ নানা দেশে। অধ্যাপনা-রাজনীতির পাশাপাশি লেখালেখিতেও সমান সাবলীল। তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলার নারী’। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা, নারীর ক্ষমতায়ন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘বেগম রোকেয়া-২০১৪’ পদকে ভূষিত হন। তিন সন্তানের জননী অধ্যাপক মমতাজ বেগমের জীবনসঙ্গী বাংলাদেশের আইন অঙ্গনে অত্যন্ত সম্মানিত নাম এডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান। পরিচিত মহলে তাদের দাম্পত্য জীবন অনুকরণীয় উদাহরণ। সৈয়দ রেজাউর রহমান বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ্যাটর্নি জেনারেল পদমর্যাদায় প্রসিকিউটর হিসেবে কর্মরত। ২১ শে আগষ্ট গ্রেনেড হামলা মামলার চীফ প্রসিকিউটর। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে ৮ বার নির্বাচিত সদস্য, ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি। ছিলেন ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, পূর্বাঞ্চলীয় স্টুডেন্ট লিয়াজোঁ অফিসার, বৃহত্তর কুমিল্লার মুজিব বাহিনীর অধিনায়ক ও ইনডাকশনের চার্জে ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য। ত্যাগ-তিতিক্ষা, লড়াই, সংগ্রাম, আদর্শের প্রতি অবিচল আনুগত্য, দেশপ্রেম, সাহসের অনন্য উদাহরণ অধ্যাপক মমতাজ বেগম। একাত্তরের তরুণী বীর মুক্তিযোদ্ধা আজও- জননী অপরাজিতা।
×