ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

সিলেটের খাসিয়া নৃগোষ্ঠীর মাতৃতান্ত্রিক পরিবার

প্রকাশিত: ০৯:০৩, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

সিলেটের খাসিয়া নৃগোষ্ঠীর মাতৃতান্ত্রিক পরিবার

সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ধারায় মাতৃতান্ত্রিক পরিবার অতি আদিমতম একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। যে পরিবারে নারীরাই ছিল একচ্ছত্র আধিপত্যের সর্বময় কর্ত্রী। আদিম সমাজের চরম স্বেচ্ছাচারের দুঃসময়ে নারীদের অবস্থা ছিল একেবারে শীর্ষ স্থানে। অবাধ স্বেচ্ছাচারে পিতার পরিচয় জানার কোন সুযোগই ছিল না। মায়ের গর্ভ থেকে সন্তান আসত বলে মাকেই চেনা যেত। ফলে মা-ই হতো সম্পত্তি কিংবা বংশপঞ্জীর একমাত্র নির্ণায়ক। পৃথিবীতে দীর্ঘকাল ধরে টিকে থাকা এই নারী কর্তৃত্ব আর্থ-সামাজিক বলয়ে ও এক বিশিষ্ট মাইলফলক। কারণ সভ্যতা সূর্যের দেখা না মিললেও নারী জাতির জন্য তা ছিল সুবর্ণকাল। পারিবারিক সমস্ত কিছুর নিয়ন্ত্রণের ভার ছিল বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলাদের। সভ্যতার আলোয় যখন সারা বিশ্ব উদ্ভাসিত হলো তখন থেকেই অধিকাংশ নারী জাতির জীবনে নেমে আসে দুর্ভাগ্যের কালো ছায়া। বিবর্তনের অনিবার্য গতিতে আর্থ-সামাজিক বলয় যখন নতুন পথের নিশানা খুঁজে পেল, সম্পদ নামক মহামূল্যবান বিষয়টি আদিম মানুষকে তাড়িত করল তখন থেকে আদিম সভ্যতার মোড় ঘুরলেও সমাজের একটা অংশ নারীর অবস্থা গিয়ে দাঁড়াল পূর্বের চেয়ে অধিকতর মানবেতর। সম্পদ আর আবিষ্কারের অভিঘাতে নারী কর্তৃতাধীন মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের পতন অনিবার্য হলো। সম্পত্তিকে নিজ গোত্রে ধরে রাখার জন্য পিতৃত্বের পরিচয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ল। ফলে ভেঙ্গে গেল আদিম সমাজের সাম্যবাদী গড়ন। সেখানে ব্যক্তি মালিকানার সদর্প বিচরণে ছোট পরিবারেও এলো যুগান্তকারী রদবদল। একক পরিবারের ভিত্তিতে নারীদের সার্বিক ক্ষমতা হলো খর্বিত। এ্যাঞ্জেলসের ভাষায়, ‘সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব নারী জাতির ঐতিহাসিক পরাজয়। শুধু পরাজয়ই নয় চিরস্থায়ী অধোগতি যেখান থেকে উঠতে নারীদের এখনও সংগ্রাম করে যেতে হচ্ছে। বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে পিতৃতান্ত্রিক একক পরিবারের কাঠামো দৃশ্যমান। তার পরেও গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু আদিম নৃগোষ্ঠী এখনও সভ্যতাবিবর্জিত যুগের আদল নিয়ে নিজেদের জীবন প্রবাহের গতিকে চালিত করছে। বাংলাদেশেও সেই রকম কিছু ক্ষুদ্র জ্ঞাতি গোষ্ঠী সেই সাবেকী আমলের ধারাকে বহন করে তাদের যাপিত জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, সিলেট এবং রাজশাহীতেও এমন কিছু আদিম গোষ্ঠী দৃশ্যমান যাদের মধ্যে আমরা সেই পুরনো সভ্যতার অনেক নিদর্শন খুঁজে পাই। ময়মনসিংহের গারো এবং সিলেটের খাসিয়া উপজাতি তেমন এক ক্ষুদ্র জাতিসত্তা যারা এখনও মাতৃতান্ত্রিক পরিবারে বসবাস করে দীর্ঘকালের পুরনো ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। সিলেটের খাসিয়া পুঞ্জিতেও এমনই কিছু নৃগোষ্ঠী পরিবার তাদের ঐতিহ্যিক বলয়ে নিজেদের প্রতিদিনের জীবনকে চালিত করে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় এখানে তারা প্রায়ই ১২৫টি পরিবার নিয়ে এক সঙ্গে মিলে মিশে বাস করছে। তাদের পূর্ব পুরুষের আদিবাস ছিল সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকা জাফলংয়ে। ১৯৫৫ সালে কিছু খাসিয়া উপজাতি সিলেটের হবিগঞ্জের পাহাড়ী এলাকায় তাদের বসতি স্থাপন করে। সেই থেকে তারা এই খাসিয়া পুঞ্জির অধিবাসী। এখনও তারা মাতৃতান্ত্রিক পরিবারকেই মেনে চলছে। সংসারে মায়ের কর্তৃত্বই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হলেও আধুনিকতার ছোঁয়ায় সাবেকী আমলের এই পারিবারিক কাঠামোতে নতুন কিছু যোগও হয়েছে। যেমন পুরুষরা আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন করে। কৃষিপ্রধান এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সীমাবদ্ধ এলাকায় সংসারের কর্তার অধিকারকেও একেবারে অস্বীকার করা হয় না। টাকা পয়সা মায়ের হাতে থাকলেও বাবার সিদ্ধান্ত দেয়ার এবং খরচ করার অধিকার আছে। তবে বিয়ের পর মেয়েরা বাপের বাড়িতে থাকার রেওয়াজের কারণে ছেলেদেরই শ্বশুরালয়ে গিয়ে উঠতে হয়। ফলে বিধি মোতাবেক বিবাহের সমস্ত আচার অনুষ্ঠানে মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের নিয়মকেই মেনে চলা হয়। তবে শিক্ষার প্রচলন এখনও সেভাবে অবাধ আর মুক্ত নয়। ছোট একটা প্রাইমারী বিদ্যালয় আছে খাসিয়া পুঞ্জিতে, যেখানে হবিগঞ্জ থেকে শিক্ষক এসে ক্লাসে পড়ান। অর্থাৎ কখনও নিজেদের মধ্য থেকে কোন শিক্ষিত সম্প্রদায় গড়ে উঠতে পারেনি যারা বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার দায়িত্ব নিতে পারেন। সেটা পুরুষ কিংবা নারী প্রত্যেকের বেলায় এই শিক্ষার বিষয়টি প্রযোজ্য। তবে যে সম্পদের কারণে পুরুষরা একদিন মাতৃতান্ত্রিক পরিবারকে পরাভূত করেছিল প্রায়ই একই ব্যাপার খাসিয়া উপজাতির মধ্যেও দৃশ্যমান। খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী এ খাসিয়া নৃগোষ্ঠীর মধ্যে যোগ্যতম এবং সম্পদশালী পুরুষরা নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত সচেতন। সচ্ছল এবং অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেরা বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি অবধি যায় না। তারা নববধূকে নিজের ঘরে এনে তোলে। এমন সংখ্যা হাতেগোনার মতো। তার পরেও বলা যায় পরিবর্তনের হাওয়া খাসিয়া উপজাতিদের ও নতুন সমাজ গঠনে প্ররোচিত করছে। এমনকি শিক্ষাকেও তারা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে বিবেচনায় এনে শিক্ষিত হওয়ার তাগিদও অনুভব করছে। তাদেরই একজন অবস্থাপন্ন ব্যবসায়ী যিনি বিয়ের পর স্ত্রীকে নিজের বাড়িতেই বরণ করেছেন এবং তার ছেলে ঢাকা বিশ্বাবদ্যালয়ে স্নাতকের (সম্মান) শিক্ষার্থী। তবে এখনও সিংহভাগ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় নিজেদের অর্থনৈতিক জীবন নির্বাহ করছে। শুধু তাই নয় মাতৃতান্ত্রিক কাঠামোকে এখনও পারিবারিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অগ্রগণ্য ভাবছে। তবে লক্ষণীয় ছেলেমেয়ে উভয়েই কর্মঠ এবং পরিশ্রমী। চাষাবাদে যৌথ শ্রমে তাদের জীবন ও জীবিকা চলে। নারীরা অনেক স্বাধীন হলেও পুরুষের অধিকার কোন অংশেই কম বলে মনে হয়নি। সমবেত প্রচেষ্টায় এই ক্ষুদ্র জ্ঞাতি গোষ্ঠীর প্রাচীনপন্থী সদস্যরা সমতল ভূমির মানুষদের থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। এখনও তারা নিজেদের সঙ্গে সিলেটী বাঙালীদের যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে চলে। নিজেদের সংস্কৃতি, ধর্ম, ঐতিহ্য এবং জীবনাচরণের হরেক রকম মূল্যবোধ নিয়ে আলাদা জাতিসত্তা হিসেবে তাদের বৈশিষ্ট্যকে অক্ষুণœ রেখেছে। সেটাই বিস্ময়ের। আধুনিকতার এমন বাঁধভাঙা জোয়ারে তাদের যেন কোন ভ্রƒক্ষেপ নেই। আপন গ-ির বেড়াজালে আবদ্ধ এই খাসিয়া উপজাতি নিজেরাই যেন নিজেদের মধ্যে নিমগ্ন, আবিষ্ট। সংসারের কর্তৃত্ব নারীদের হাতে থাকলেও সব ধরনের মৌলিক অধিকার নিয়ে তারা মোটেও বিচলিত নয়। কয়েক মহিলার সঙ্গে আলাপ করে এ সম্পর্কে কোন ধারণাই জানা গেল না। মেয়েদের এক ধরনের আড়ষ্টতা, নির্লিপ্ততা এবং জড়তা লক্ষণীয় যা তাদের কোনভাবেই অধিকার সচেতন গোষ্ঠী হিসেবে ভাবতে দেয় না। সাবেকী আমলের সংস্কার এবং মূল্যবোধ নিয়ে তৈরি এই খাসিয়া নৃগোষ্ঠীকে সত্যিকার অর্থে পশ্চাৎপদ এক জাতিসত্তা বললে অত্যুক্তি হয় না। সে সব নিয়ে তাদের কোন গরজ কিংবা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে কিনা তাও বোঝার উপায় নেই। শিক্ষার দ্বারও সবার জন্য অবাধ আর অবারিত নয়। আধুনিকতার সংস্পর্শে এসে তারা কবে যে ঘুরে দাঁড়াবে তা শুধু সময়ের অপেক্ষায়।
×