ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৪ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২

হরমুজ প্রণালী: ইরানের তুরুপের তাস? বন্ধ মানেই বৈশ্বিক সংকট?

নয়ন আসাদ, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০৯:০৮, ২৪ জুন ২০২৫

হরমুজ প্রণালী: ইরানের তুরুপের তাস? বন্ধ মানেই বৈশ্বিক সংকট?

ছবি: সংগৃহীত

অসংখ্য জলপথ ও প্রণালী ছড়িয়ে আছে বিশ্বজুড়ে। কিন্তু এদের মধ্যে যে প্রণালীটির নাম মাঝে মাঝেই বিশ্ব সংবাদে জায়গা করে নেয় তা হচ্ছে হরমুজ। এই প্রণালীটি কেবল ভূগোলের মানচিত্রেই নয়, বিশ্ব অর্থনীতির স্নায়ুতন্ত্রেও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পারস্য উপসাগরের প্রবেশপথে অবস্থিত হরমুজ প্রণালী কেবল একটি নৌপথ নয়, বরং বলা যায় ইরানের তুরুপের তাস।

যখনই বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির দাবা খেলায় ইরানের ওপর চাপ বাড়ে, তখনই এই প্রণালীর নাম উঠে আসে এক অদম্য অস্ত্র হিসেবে। যা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে ইরান বিশ্বকে নিজের শক্তি এবং প্রতিবাদের বার্তা দেয় হরহামেশাই।

হরমুজ প্রণালীর অবস্থান ওমান এবং ইরানের মাঝে। এর সবচেয়ে সরু অংশটি মাত্র ২১ নটিক্যাল মাইল (৩৯ কিলোমিটার) চওড়া, যেখানে জাহাজ চলাচলের পথটি আরও সংকীর্ণ, মাত্র ৩ কিলোমিটার। এই সংকীর্ণতা এর কৌশলগত গুরুত্বকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

প্রণালীটি পারস্য উপসাগরকে ওমান উপসাগর এবং আরব সাগরের সাথে সংযুক্ত করে, যা বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সরবরাহের একটি অপরিহার্য জলপথ। এর এই ভৌগোলিক অবস্থানই ইরানের জন্য একটি প্রধান ভূ-রাজনৈতিক হাতিয়ার করে তুলেছে।

এই হরমুজ প্রণালীর অর্থনৈতিক গুরুত্ব অভাবনীয়। প্রতিদিন প্রায় ১৭-২০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল এই প্রণালী দিয়ে পরিবাহিত হয়, যা বিশ্বের মোট তেল সরবরাহের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত ও ইরাকের মতো প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো তাদের উৎপাদিত অপরিশোধিত তেলের সিংহভাগই এই পথ দিয়ে এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে।

শুধু তেল নয়, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোর তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রপ্তানির বড় অংশও ঘটে এই প্রণালী ব্যবহার করে। এই প্রণালী দিয়ে তেল ও গ্যাস পরিবহনে সামান্যতম বিঘ্ন ঘটলে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দামে মারাত্মক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে, যা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সরাসরি মুদ্রাস্ফীতি ও মন্দার কারণ হতে পারে। একারণেই বিশ্ব অর্থনীতি হরমুজ প্রণালীর স্থিতিশীলতার ওপর গভীরভাবে নির্ভরশীল।

হরমুজ প্রণালীর উত্তর তীরে অবস্থিত হওয়ায় ইরান এর ওপর একটি উল্লেখযোগ্য নিয়ন্ত্রণ রাখে। যদিও এটি একটি আন্তর্জাতিক জলপথ, ইরানের ইসলামিক বিপ্লবী গার্ড কর্পস (IRGC) এর নৌবাহিনী এই অঞ্চলে সক্রিয় এবং তারা অতীতেও তেলবাহী জাহাজ আটক করেছে বা হুমকি দিয়েছে।

এই প্রণালী ইরানের কূটনৈতিক দর কষাকষির ক্ষমতাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিলেও এটি কিন্তু ইরানের জন্য দু’ধারী তলোয়ারের মত। কারণ এতে যে কেবল অন্যরাই চাপে পড়বে তা নয়। চাপে পড়বে ইরান নিজেও।

হরমুজ প্রণালী বন্ধের মাধ্যমে বিশ্ববাজারে তেলের দাম অভাবনীয়ভাবে বেড়ে যাবে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। এর মাধ্যমে ইরান পশ্চিমা দেশগুলোর উপর চাপ সৃষ্টি করে তাদের উপর আরোপিত অবরোধ প্রত্যাহার বা সামরিক পদক্ষেপ থেকে বিরত রাখতে পারে।

কিন্তু হরমুজ প্রণালী বন্ধ করলে ইরান নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ ইরানও এই পথ দিয়েই তাদের তেল রপ্তানি করে। এমনিতেই অবরোধের কারণে ইরানের অর্থনীতি দুর্বল, এমন পরিস্থিতিতে প্রণালী বন্ধ করলে তাদের আয়ের প্রধান উৎসও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

এছাড়া এমন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা কঠোর সামরিক প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে, যা একটি আঞ্চলিক বা এমনকি বৈশ্বিক সংঘাতেরও জন্ম দিতে পারে।

তাই হরমুজ প্রণালীর কৌশলগত গুরুত্বকে ব্যবহার করে ইরান বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আলোচনায় নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করলেও সহজে বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় না। ইরান একে তুরুপের তাস হিসেবেই রাখতে চায় যাতে সবচেয়ে কার্যকর সময়ে কার্যকরভাবে এই প্রণালীকে ব্যবহার করা যায়।

তবে ইরানের হুমকিই এটি মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার ভারসাম্যে একটি বিশাল ভূমিকা রাখে। এখন পর্যন্ত এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা এবং বৈশ্বিক জ্বালানি নিরাপত্তা হরমুজ প্রণালীর ওপর সরাসরি নির্ভরশীল। প্রণালীটি বন্ধ হলে কেবল তেলের দাম বাড়বেই না, বরং তা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা এবং ভূ-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে।

এই প্রণালীকে কেন্দ্র করে ইরানের ক্ষমতা এবং এর ব্যবহারের সম্ভাবনা, বিশ্ব মঞ্চে তাদের দর কষাকষির ক্ষমতাকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। তবে, এর অপব্যবহারের পরিণতি ইরান এবং বিশ্ব উভয়ের জন্যই মারাত্মক হতে পারে, যে কারণে এই ‘তুরুপের তাস’ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সম্ভবত ইরানও সর্বোচ্চ বিচক্ষণতা দেখানোর চেষ্টাই করছে।

নয়ন আসাদ/রাকিব

×