
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্র ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর পর পুরো বিশ্ব এখন তীব্র উৎকণ্ঠায় রয়েছে— ইরান কীভাবে জবাব দেবে, সেটি নিয়েই চলছে আলোচনা। ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই হামলা ছিল ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে ইরানের ওপর সবচেয়ে বড় পশ্চিমা সামরিক অভিযান।
শনিবার যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ফোর্দো পারমাণবিক কেন্দ্রে ৩০,০০০ পাউন্ড ওজনের বাংকার-বাস্টার বোমা নিক্ষেপ করে। এর পরপরই ইরান প্রতিশোধের ঘোষণা দেয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রোববার ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে ইঙ্গিত দেন ‘রেজিম চেঞ্জ’ বা সরকার পরিবর্তনের। তিনি লেখেন, “বর্তমান সরকার যদি ইরানকে আবার মহান করতে না পারে, তাহলে রেজিম চেঞ্জ কেন নয়?”
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চলছেই। ইসরায়েলের দাবি, তাদের যুদ্ধবিমান ইরানের পশ্চিমাঞ্চলে একাধিক সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। এর আগে ইরান থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রে তেলআবিবে বহু ভবন ধসে পড়ে ও বহু মানুষ আহত হন।
যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ দেশে বাড়তি নিরাপত্তা সতর্কতা জারি করেছে। সাইবার হামলা ও নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ওপর সহিংসতার শঙ্কা রয়েছে বলে জানানো হয়েছে। বিভিন্ন মার্কিন শহরে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও কূটনৈতিক ভবনগুলোতে টহল জোরদার করা হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে আকাশপথে যাতায়াত বিঘ্নিত হওয়ায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বিশ্বজুড়ে মার্কিন নাগরিকদের জন্য নিরাপত্তা সতর্কতা জারি করেছে। এতে বিক্ষোভের সম্ভাবনা ও ভ্রমণজনিত ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানানো হয়েছে।
তবে এখনো পর্যন্ত ইরান সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে হামলা বা হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে তেল সরবরাহে বাধা দেয়নি। কিন্তু ইরান ইঙ্গিত দিয়েছে, প্রতিশোধ অবশ্যই হবে।
ইস্তাম্বুলে দেওয়া বক্তব্যে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইন মানে না। তারা শুধু শক্তির ভাষাই বোঝে। এখন আমাদের প্রতিক্রিয়ার পরেই কূটনৈতিক পথ বিবেচনায় আসবে।”
টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে ট্রাম্প দাবি করেন, এই অভিযানে ইরানের মূল পারমাণবিক স্থাপনাগুলো “সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস” হয়ে গেছে। স্যাটেলাইট ছবি থেকে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, ফোর্দোর পারমাণবিক স্থাপনায় বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে, তবে ক্ষতির প্রকৃত মাত্রা এখনো নিশ্চিত করা যায়নি।
জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থা জানিয়েছে, হামলার পর তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সংস্থার প্রধান রাফায়েল গ্রোসি বলেন, গোপন পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে এখনো সময় লাগবে।
একজন ইরানি কর্মকর্তা দাবি করেন, ফোর্দো থেকে অধিকাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম আগেই সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। তবে এই দাবি স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
ইরানের সংসদ হরমুজ প্রণালী বন্ধের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে, তবে এটি কার্যকর করতে দেশটির সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন প্রয়োজন। এই প্রণালী বন্ধ হলে বিশ্বজুড়ে তেলের দাম বাড়বে, অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা আসবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি সামরিক সংঘাতে জড়ানোর আশঙ্কা তৈরি হবে।
এই খবরের পর রবিবার ব্রেন্ট তেলের দাম ৩.২০ ডলার বেড়ে দাঁড়ায় ৮০.২৮ ডলার, আর যুক্তরাষ্ট্রের অপরিশোধিত তেলের দাম বেড়ে হয় ৭৬.৭৩ ডলার।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জানান, ইরান যদি নতুন কোনো ‘ভুল’ না করে, তাহলে আর কোনো সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা নেই।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ রবিবার জরুরি বৈঠকে বসে। রাশিয়া, চীন ও পাকিস্তান অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব তোলে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, “এই পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যকে বিপজ্জনক এক মোড়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এখনই যুদ্ধ বন্ধ করে আলোচনায় ফিরে আসা জরুরি।”
এদিকে, ইসরায়েল ইরানের শাসকগোষ্ঠীকে সরাতে চায় বলে ইঙ্গিত দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেন, তারা ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক হুমকি থেকে মুক্তির লক্ষ্যে খুব কাছাকাছি চলে এসেছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্ট করে বলেছে, তাদের লক্ষ্য সরকার পরিবর্তন নয়। প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথ বলেন, “এটি একটি নির্দিষ্ট সামরিক অভিযান, কেবল পারমাণবিক কর্মসূচিকে লক্ষ্য করেই পরিচালিত হয়েছে।”
এদিকে, নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটনসহ বিভিন্ন শহরে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা “ইরান থেকে হাত সরাও” লেখা প্ল্যাকার্ড বহন করে।
ইরানের জনগণ যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আতঙ্কে রয়েছেন। তেহরান থেকে এক শিক্ষিকা জানান, “আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আমরা যেন এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে বাস করছি।”
ইসরায়েলের হামলায় ইতোমধ্যে ইরানে ৪০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক। ইরানের পাল্টা হামলায় ইসরায়েলে নিহত হয়েছে অন্তত ২৪ জন। তেহরানের বহু মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে পালিয়ে গেছেন।
রবিবার ইসরায়েলে আবারও সাইরেন বেজে ওঠে, মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ নিরাপদ কক্ষে আশ্রয় নেয়। তেলআবিবে এক বাসিন্দা বলেন, “ঘর ধ্বংস হয়ে গেছে, তবুও আমরা শক্ত আছি। আমরা জানি, আমরা জিতবো।”
সূত্র: রয়টার্স
এম.কে.