
ছবি: সংগৃহীত
গাজা যেন এক দীর্ঘশ্বাসে ভরা মৃত্যুপুরী। গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি গোলাবর্ষণ ও বিমান হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১৪০ জন ফিলিস্তিনি, জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সহিংসতার লাগাতার ধারা অব্যাহত থাকলেও, অনেক গাজাবাসীর অভিযোগ—তাদের দুঃসহ পরিস্থিতি এখন বিশ্ববাসীর মনোযোগ হারিয়ে ফেলেছে। কারণ, এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ইরান-ইসরায়েল সংঘাত।
বুধবারের হামলায় নিহতদের একটি বড় অংশই সহায়তার আশায় জড়ো হওয়া সাধারণ মানুষ। মে মাসের শেষদিকে অবরোধ আংশিক শিথিলের পর থেকে এমন মৃত্যু যেন হয়ে উঠেছে নিত্যদিনের ঘটনা।
সহায়তা নিতে গিয়ে জীবন যাচ্ছে
চিকিৎসকরা জানান, মাজগাজি শরণার্থী শিবির, জেইতুন পাড়া এবং গাজা শহরে বাড়িঘরে চালানো হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ২১ জন। খান ইউনিস শহরের একটি ক্যাম্পে বোমাবর্ষণে মারা যান আরও পাঁচজন। আর মধ্য গাজার সালাহউদ্দিন সড়কে জাতিসংঘের সাহায্য বহনকারী ট্রাকের অপেক্ষায় থাকা মানুষের ওপর চালানো গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন ১৪ জনেরও বেশি।
ইসরায়েলি বাহিনীর দাবি, সতর্কবার্তা সত্ত্বেও নুসাইরাত এলাকায় সেনাদের দিকে অগ্রসর হওয়া ব্যক্তিরা "ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ" করেছেন। তবে তারা হতাহতের তথ্য জানায়নি। তারা বলছে, "হামাসের সামরিক সক্ষমতা ধ্বংস করাই লক্ষ্য", এবং তারা নাগরিক হতাহত এড়াতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।
সহিংসতার মাঝে ক্ষুধার্ত মানুষের আর্তনাদ
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, মে মাসের শেষদিক থেকে শুরু হওয়া সহায়তা বিতরণের পর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৩৯৭ জন নিহত ও ৩,০০০ জনের বেশি আহত হয়েছেন শুধুই খাদ্য সংগ্রহের চেষ্টা করতে গিয়ে।
গাজা শহরের বাসিন্দা আদেল বলেন, “বোমায় না মরলে মানুষ মরছে ক্ষুধায়। খাবার নিতে এসে প্রাণ হারানোর এ লজ্জা আমরা আর কতদিন বইব?” তিনি আরও বলেন, “রক্তে রাঙা হয়ে যাচ্ছে সেই ময়দার বস্তা, যা মানুষ নিজের হাতে পেয়ে ভেবেছিল জীবন বাঁচল।”
বিশ্ববাসী কি ভুলে গেছে গাজাকে?
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমর্থনে পরিচালিত একটি নতুন সংগঠন ‘গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন’ কিছু সহায়তা পাঠালেও তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। ফিলিস্তিনের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, ইসরায়েল পরিকল্পিতভাবেই ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। যদিও ইসরায়েলের দাবি, সহায়তা যেন হামাসের হাতে না পড়ে, সেজন্যই তারা সতর্ক।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা UNRWA-এর প্রধান ফিলিপ লাজারিনি বলেছেন, “গাজায় সহায়তা বণ্টনের বর্তমান প্রক্রিয়া আমাদের সম্মিলিত মানবিক চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।”
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) জানিয়েছে, গত চার সপ্তাহে তারা গাজায় ৯,০০০ মেট্রিক টন খাদ্য সরবরাহ করলেও তা আসলে প্রয়োজনের খুবই সামান্য অংশ। সহায়তার আশায় মানুষ রাস্তায় ঝুঁকি নিয়ে জড়ো হচ্ছে, যেকোনো মুহূর্তে হতে পারে প্রাণহানি।
“ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ আমাদের ব্যথা ঢেকে ফেলছে”
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান ক্ষেপণাস্ত্র হামলার খবর ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করছেন গাজাবাসীরাও। অনেকের চোখে এতে সাময়িক স্বস্তি থাকলেও, বাস্তবতা আরও নির্মম।
“ইরানের হামলায় ইসরায়েল ভোগ করুক—এটা আমরা হয়তো চাই। কিন্তু প্রতিদিন এই যুদ্ধ আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে নিরীহ মানুষের জীবন,” বলেন গাজার উত্তরের বাসিন্দা, পাঁচ সন্তানের জনক শাবান আবেদ। তার আকুতি, “আমরাও চাই গাজায় যুদ্ধ শেষ হোক। আমরা যেন না-দেখা কোনো ভৌতিক জাতি নই, যাদের কথা কেউ মনে রাখে না।”
আলোচনার বাইরে পড়ে থাকা গাজার ক্ষতচিহ্ন
গাজা উপত্যকায় সহিংসতা ও মানবিক বিপর্যয়ের মাত্রা যখন দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে, তখন আন্তর্জাতিক দৃষ্টি ক্রমেই সরছে ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনার দিকে। গত ২৪ ঘণ্টায় নিহত ১৪০ জন ফিলিস্তিনির মৃত্যু যেন কেবল একটি সংখ্যায় পরিণত হয়েছে, মানবিক বেদনায় নয়। শিশু, বৃদ্ধ, নারী—কেউই আজ নিরাপদ নয় গোলাবর্ষণ কিংবা খাদ্য সংগ্রহের চেষ্টায়।
বিশ্ব রাজনীতির পালাবদলে গাজা যেন পরিণত হয়েছে এক ‘ভুলে যাওয়া যুদ্ধক্ষেত্রে’। যেখানে প্রতিদিন মানুষ মরছে ক্ষুধায়, গুলিতে, বা চিকিৎসার অভাবে—তবে তাদের গল্প খবরের শিরোনামে জায়গা পাচ্ছে না। এমন বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক মানবিক সংগঠনগুলোর অভিযোগ, বর্তমান সহায়তা প্রক্রিয়া অকার্যকর এবং নৈতিক দায় এড়ানোর পথ।
অন্যদিকে, স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, গাজায় বেঁচে থাকা এখন একমাত্র লড়াই—শত্রু পক্ষ নয়, বরং ক্ষুধা, আতঙ্ক ও অবহেলার বিরুদ্ধে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি এই সংকটে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না আসে, তবে গাজার চিত্র শুধু আরও ভয়াবহ হবে। এমনকি এটি মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতা তৈরির ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখতে পারে।
Mily