ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৮ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২

টাইমস অব ইন্ডিয়ার বিশ্লেষণ

শীর্ষ কমান্ডারদের হারিয়ে ভেঙে পড়ছে ‘অক্ষশক্তি’, ধ্বংসস্তূপেও একা দাঁড়িয়ে আছেন খামেনি!

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ১৮ জুন ২০২৫; আপডেট: ০৬:৩৭, ১৮ জুন ২০২৫

শীর্ষ কমান্ডারদের হারিয়ে ভেঙে পড়ছে ‘অক্ষশক্তি’, ধ্বংসস্তূপেও একা দাঁড়িয়ে আছেন খামেনি!

ছ‌বি: সংগৃহীত

তেহরানে ইসরায়েলের অভাবনীয় বিমান হামলার পর ধ্বংসস্তূপের মাঝেও একা দাঁড়িয়ে আছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। ৮৬ বছর বয়সী এই নেতা এক রাতেই হারিয়েছেন তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সামরিক, গোয়েন্দা ও কৌশলগত কমান্ডারদের, যারা কয়েক দশক ধরে তাঁর শাসনের মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করে আসছিলেন।

১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে ইরানের নেতৃত্ব এত বড় ধাক্কা আর কখনও খায়নি। এই মৃত্যুগুলো কেবল প্রতীকী নয়, বরং পরিকল্পিত এবং নিখুঁতভাবে পরিচালিত। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন রেভল্যুশনারি গার্ডের প্রধান, ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির স্থপতি, সামরিক গোয়েন্দা প্রধান এবং জাতীয় প্রতিরক্ষা সমন্বয়ক— সবাই একে একে খামেনির পাশে থেকে হারিয়ে গেলেন।

গত শুক্রবার মধ্যরাতে শুরু হয় হামলা। ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন টার্গেট করে তেহরান ও আশপাশের এলাকায় থাকা গোপন বাঙ্কার, কমিউনিকেশন সেন্টার ও সামরিক ঘাঁটিগুলোতে। সাথে সাথে ধ্বংস হয় সেই ঘাঁটিগুলোর শীর্ষ নেতৃত্ব।

প্রথমেই নিহত হন বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল হোসেন সালামি। খামেনির ঘনিষ্ঠ এই নেতা শুধু একজন সেনা কর্মকর্তা ছিলেন না, বরং তাঁর রাজনৈতিক কৌশল এবং আদর্শিক বলয়ের মূল চালিকাশক্তি। এরপর নিহত হন আমির আলী হাজিজাদে— ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির মূল স্থপতি।

পরবর্তী কয়েক ঘণ্টায় নিহত হন গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ কাজেমি, সেনাপ্রধান মোহাম্মদ বাঘেরি এবং যুগ্ম সামরিক পরিকল্পনার প্রধান গোলাম আলি রশিদ। শনিবার সকাল নাগাদ ইরানের সামরিক নেতৃত্ব কার্যত ধ্বংস হয়ে যায়।

সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ছিল নিখুঁত পরিকল্পিত একটি অভিযানে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে এটি ছিল একটি ভূমিকম্প।

আয়াতুল্লাহ খামেনি সবসময়ই ঘনিষ্ঠ আস্থা ও আনুগত্যের বলয়ের মধ্য দিয়ে শাসন চালিয়েছেন— যেখানে ছিল ধর্মীয় নেতারা, গার্ড বাহিনী এবং গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। কিন্তু এই বলয় এখন ভেঙে পড়েছে।

যারা নিহত হয়েছেন, তারা কেবল কর্মকর্তা ছিলেন না, ছিলেন খামেনির সহযোদ্ধা, সহচর, দীর্ঘ পথচলার সঙ্গী। তাঁদের মৃত্যু কৌশলগতভাবে যেমন ক্ষতি, তেমনি ব্যক্তিগতভাবে খামেনির জন্য গভীর এক শূন্যতা।

বর্তমানে তাঁর চারপাশে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা ও ক্ষমতা আগের মতো নয়। খামেনির ছেলে মোজতবা খামেনি এখন কার্যত নীতিনির্ধারণ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রধান রূপে আবির্ভূত হয়েছেন। কোনও সরকারি পদ না থাকলেও, দীর্ঘদিন ধরেই পর্দার আড়ালে তাঁর প্রভাব ছিল ব্যাপক।

পুরনো দপ্তরের যারা বেঁচে আছেন— যেমন আলি আকবর ভেলায়াতি, কামাল খারাজি কিংবা মোহাম্মদ গোলপায়েগানি— তাঁরা এখন এই ধ্বংসপ্রাপ্ত কাঠামোর শেষ স্তম্ভ হয়ে রয়ে গেছেন।

খামেনির সবচেয়ে আস্থাভাজন আঞ্চলিক মিত্রদের তালিকাটিও আজ প্রায় শূন্য। ২০২০ সালে কাসেম সোলাইমানি নিহত হন আমেরিকান ড্রোন হামলায়। একই বছর পরমাণু কর্মসূচির প্রধান মোহসেন ফখরিজাদে নিহত হন তেহরানের কাছে। ২০২১ সালে মারা যান কুদস ফোর্সের উপপ্রধান মোহাম্মদ হেজাজি।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ। আর ডিসেম্বরে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ বিদ্রোহীদের হাতে ক্ষমতা হারান।

এই মৃত্যু ও পতনের ফলে খামেনির 'অক্ষশক্তি' আজ ছিন্নভিন্ন। লেবানন ও সিরিয়ায় ইরানের প্রভাব হ্রাস পেয়েছে। হিজবুল্লাহ দুর্বল, সিরিয়ায় অস্ত্র সরবরাহের পথ ভেঙে পড়েছে। প্রতিরোধের কাঠামো আজ ধ্বংসপ্রায়।

তেহরান সরকার বাইরে থেকে দৃঢ়তার বার্তা দিলেও, বাস্তবতা হলো— তারা আজ বিপর্যস্ত। প্রতিশোধের ভাষণে টিভি ভরিয়ে দিলেও, নতুন নেতারা এখনও যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য প্রস্তুত নন। গোয়েন্দা ব্যবস্থা দিশেহারা। গার্ড বাহিনী দুর্বল হওয়ায় এখন হয়তো ঐতিহ্যগতভাবে পিছিয়ে থাকা নিয়মিত সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব নিতে হতে পারে।

এই অবস্থায় খামেনির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো শাসনব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা। এখন পর্যন্ত তাঁর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল 'রেজিম সারভাইভাল', তাত্ত্বিকতা বা কূটনীতি নয়।

কিন্তু যাঁদের ওপর ভর করে তিনি এতদিন এই ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখেছিলেন, তাঁরা আর নেই। এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক দাবার ছকে সবচেয়ে নিঃসঙ্গ ঘরটি এখন তেহরান— যেখানে সেনারা নেই, মিত্ররা মৃত এবং যুদ্ধের দামামা কানে কানে বাজছে।

সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া

এম.কে.

×