ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ জুন ২০২৫, ১ আষাঢ় ১৪৩২

হরমুজ প্রণালী যেভাবে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে প্রভাব ফেলতে পারে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশিত: ০৭:৫৪, ১৫ জুন ২০২৫

হরমুজ প্রণালী যেভাবে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে প্রভাব ফেলতে পারে

ছবিঃ আল জাজিরা

ইরানি সংসদ সদস্য জানিয়েছেন, তেহরান বিশ্বে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তেল পরিবহন চোকপয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত জলপথটি বন্ধ করার চিন্তাভাবনা করছে।

ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাত তীব্রতর হওয়ায় ইরানি বার্তা সংস্থা IRINN জানিয়েছে, দেশটি হরমুজ প্রণালী বন্ধ করার কথা ভাবছে — এই তথ্য দিয়েছেন প্রভাবশালী রক্ষণশীল সংসদ সদস্য এসমাইল কোসারি।

এই পদক্ষেপ তেলের দাম ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দেবে এবং যুদ্ধের পরিসর বাড়ানোর ঝুঁকি তৈরি করবে। তাহলে হরমুজ প্রণালী আসলে কী এবং কেন এটি বৈশ্বিক বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?

হরমুজ প্রণালী হল পারস্য উপসাগরে প্রবেশের একমাত্র সামুদ্রিক পথ। এটি একদিকে ইরান এবং অপরদিকে ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতকে বিভক্ত করেছে। এটি পারস্য উপসাগরকে ওমান উপসাগর ও ভারত মহাসাগরের আরব সাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করে।

মার্কিন জ্বালানি তথ্য প্রশাসনের (US Energy Information Administration) মতে, বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত মোট তেলের প্রায় ২০ শতাংশ এই প্রণালী দিয়ে পরিবাহিত হয়। সংস্থাটি একে “বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেল পরিবহন চোকপয়েন্ট” হিসেবে বর্ণনা করেছে। প্রণালীর সবচেয়ে সরু অংশ মাত্র ৩৩ কিলোমিটার (২১ মাইল) প্রশস্ত হলেও, জাহাজ চলাচলের নির্ধারিত পথ আরও সরু, যা একে হামলার জন্য অধিক ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।

১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ইরান-ইরাক যুদ্ধ চলাকালে — যেখানে উভয় পক্ষের শত-সহস্র মানুষ নিহত হয় — দুই দেশই উপসাগরে বাণিজ্যিক জাহাজকে লক্ষ্য করে হামলা চালায়, যা “ট্যাঙ্কার যুদ্ধ” নামে পরিচিত। তবে হরমুজ প্রণালী কখনোই সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়নি।

সাম্প্রতিক সময়ে, ২০১৯ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম প্রেসিডেন্সির সময় ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির মধ্যে ফুজাইরাহ, সংযুক্ত আরব আমিরাত উপকূলে প্রণালীর কাছে চারটি জাহাজে হামলা হয়। ওয়াশিংটন এই ঘটনার জন্য তেহরানকে দায়ী করলেও, ইরান তা অস্বীকার করে।

সংঘাতের সময়ে জাহাজ চলাচলের পথ লক্ষ্য করা অনেক পুরনো কৌশল। গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা আরব উপদ্বীপের অপর প্রান্তে অবস্থিত বাব আল-মানদেব প্রণালীর আশেপাশে জাহাজে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।

হুতি আক্রমণ বৈশ্বিক বাণিজ্যে প্রভাব ফেলেছে, তবে জাহাজগুলো আফ্রিকা ঘুরে বিকল্প পথ ব্যবহার করতে পারে — যদিও তা দীর্ঘ কিন্তু তুলনামূলক নিরাপদ। কিন্তু হরমুজ প্রণালী ব্যতীত পারস্য উপসাগর থেকে কোনো সামুদ্রিক রপ্তানি সম্ভব নয়।

এমনকি যারা উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে সরাসরি তেল আমদানি করে না, তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে কারণ সরবরাহ হ্রাস পেলে বৈশ্বিক বাজারে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম বেড়ে যাবে।

যদিও ইরানি সংসদ সদস্য হুমকি দিয়েছেন, তবে ইরান এই প্রণালী বন্ধ করার সক্ষমতা বা সদিচ্ছা রাখে কি না, তা এখনও পরিষ্কার নয়।

এমন কোনো পদক্ষেপ প্রায় নিশ্চিতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ডেকে আনবে, কারণ দেশটির নৌসামরিক উপস্থিতি অঞ্চলটিতে রয়েছে।

শুক্রবার ভোরে ইসরায়েল ইরানে সামরিক নেতৃবৃন্দ, আবাসিক ভবন, সেনা ঘাঁটি এবং পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে আঘাত হানলে, ইরান শত শত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে পাল্টা জবাব দেয়।

যুক্তরাষ্ট্র ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করতে সহায়তা করলেও, সরাসরি ইরানকে আঘাত করেনি। মার্কিন কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলেছেন যে, তারা ইসরায়েলি হামলার সঙ্গে যুক্ত নয়।

তেহরানও এখনও পর্যন্ত অঞ্চলটিতে মার্কিন সেনা বা স্বার্থকে লক্ষ্য করেনি।

তবে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করা হলে মার্কিন নাগরিকদের অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষতি হবে এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে সামরিক প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।

যদিও ইরান এখনই প্রণালী বন্ধ করতে যাচ্ছে এমন কোনো তাৎক্ষণিক ইঙ্গিত নেই, তবে কোসারির মন্তব্য ইঙ্গিত দেয় যে সংঘাত চলাকালে জাহাজ চলাচলের পথ লক্ষ্য করাটা তেহরানের একটি কৌশল হতে পারে।

২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে, সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলের প্রাণঘাতী হামলার পর, ইরানি সশস্ত্র বাহিনী হরমুজ প্রণালীর কাছে একটি কনটেইনার জাহাজ জব্দ করে। ওই ঘটনার পর ইরান সীমিত পাল্টা হামলা চালায়, যার প্রতিশোধ হিসেবে ইসরায়েল ইরানে পাল্টা আঘাত হানে। তখন এই দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের মধ্যে এটি ছিল সবচেয়ে গুরুতর সামরিক মুখোমুখি সংঘর্ষ।

মুমু

×