ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ জুন ২০২৫, ১ আষাঢ় ১৪৩২

ওয়াশিংটন পোস্টকে ইরানে হামলা সংক্রান্ত গোপন বিস্তারিত তথ্য জানালেন ইসরায়েলি নিরাপত্তা কর্মকর্তা

প্রকাশিত: ২৩:০৪, ১৪ জুন ২০২৫; আপডেট: ২৩:০৯, ১৪ জুন ২০২৫

ওয়াশিংটন পোস্টকে ইরানে হামলা সংক্রান্ত গোপন বিস্তারিত তথ্য জানালেন ইসরায়েলি নিরাপত্তা কর্মকর্তা

শুক্রবার ভোরে যখন ইসরায়েলের যুদ্ধবিমানগুলো ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখনই আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে ইরানে আগে থেকেই লুকিয়ে থাকা মোসাদের সশস্ত্র গোপন কমান্ডো দল, বিস্ফোরকে বোঝাই সাধারণ যানবাহন এবং একঝাঁক সশস্ত্র ড্রোন। এসব অস্ত্র ও হামলাকারী দল ইরানের অভ্যন্তরে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ ও স্থাপনাগুলোর দিকে এগোতে শুরু করে।

এই গোপন অভিযানের লক্ষ্য ছিল ইরানের সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, পারমাণবিক কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানী এবং ইসলামী রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি)-এর নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিরা। ইসরায়েলের এক জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তার ভাষ্য মতে, যাদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে, তাদের অধিকাংশই তখন নিজ বাড়িতে, নিজ বিছানায় অবস্থান করছিলেন।

বিশ্ববিখ্যাত সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ইসরায়েলি ও পশ্চিমা নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, এই ‘রাইজিং লায়ন’ নামের অভিযানে মোসাদ এবং ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সমন্বয়ে গোপনে দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তুতি চলছিল। বিভিন্ন অস্ত্র ও প্রযুক্তি ইরানের অভ্যন্তরে বহু মাস আগেই গোপনে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল, যা হামলার সময় সক্রিয় করা হয়।

হামলার প্রথম ধাপে যাঁরা নিহত হন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন—

ইরানের সামরিক বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি,

রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের প্রধান মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি এবং

প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী ও ইসলামিক আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মেহদি তেহরাঞ্চি।

এছাড়া আরও একাধিক শীর্ষ নেতা ভোর হওয়ার আগেই ড্রোন হামলা ও বিস্ফোরণে নিহত হন। এ বিস্ফোরণগুলো তেহরানের আবাসিক ভবন ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার কাছে ঘটানো হয়, যা শহরের মধ্যে বিশাল গর্ত সৃষ্টি করেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মোসাদ পরিকল্পিতভাবে এই হামলার জন্য ইরানের ভেতরে অস্ত্র, ড্রোন এবং বিস্ফোরক ঢোকায় এবং তা নির্দিষ্ট অবস্থানে মজুত রাখে। ইরানে ঢোকার পদ্ধতি ও অস্ত্র পাচার নিয়ে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা মুখ না খুললেও ধারণা করা হচ্ছে, ব্যাপক নেটওয়ার্ক ও ভুয়া পরিচয়ে বছরের পর বছর ধরে এর পেছনে কাজ হয়েছে।

ওয়াশিংটন পোস্টে দেওয়া তথ্যে আরও বলা হয়, এই পুরো অভিযান কয়েক ধাপে গঠিত। শুরুতে শীর্ষ নেতাদের হত্যা, পরে ক্ষেপণাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম বহনকারী ট্রাক ধ্বংস এবং সর্বশেষে ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেঙে যুদ্ধবিমানের পথ সুগম করা হয়। এজন্যই কিছু ড্রোন এসফাজাবাদের ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ কেন্দ্র লক্ষ্য করে পাঠানো হয় এবং প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নিষ্ক্রিয় করতে বিস্ফোরক বোঝাই সাধারণ গাড়ি ব্যবহার করা হয়।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এটি ছিল এক জটিল এবং বহুস্তরবিশিষ্ট অভিযান—যার নেতৃত্বে ছিল মোসাদ। এটি শুধু শত্রুর শীর্ষ নেতাদের সরিয়ে দেওয়ার কৌশল নয়, বরং একে ইরানের সামরিক সক্ষমতাকে ভেঙে দেওয়ার প্রচেষ্টা হিসেবেও দেখা হচ্ছে।

অভিযানের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে দীর্ঘমেয়াদি ধাক্কা দেওয়া। যদিও ইরান বরাবরই দাবি করে আসছে যে তাদের পারমাণবিক কার্যক্রম শান্তিপূর্ণ, পশ্চিমা নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই অভিযানের প্রভাব স্থায়ী হবে কি না, তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

অভিযানের আরও একটি নাটকীয় দিক হলো—মোসাদের হুমকি বার্তা। যাদের এখনো হত্যা করা হয়নি, সেই দ্বিতীয় সারির কমান্ডারদের উদ্দেশ্যে ফোন, গোপন চিঠি কিংবা পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে বার্তা পাঠানো হয়েছে। এই বার্তায় বলা হয়েছে—“আমরা জানি তুমি কোথায় আছো।”

অভিযানের ঘনিষ্ঠ সূত্রের মতে, এমন সময়েও এই পরিকল্পনার প্রস্তুতি চলছিল, যখন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক আলোচনা পুনরায় শুরু করেছিল। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও এই অভিযানে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছেন। এক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পোস্টে তিনি নিহতদের উদ্দেশে লেখেন, “তাঁরা সবাই এখন মৃত” এবং ইরানকে হুঁশিয়ার করে বলেন—“পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ না করলে, আরও বড় হামলা আসবে।”

সব মিলিয়ে, ‘রাইজিং লায়ন’ কেবল একদিনের অভিযান নয়। এটি ছিল বহু বছরের প্রস্তুতিতে গড়া মোসাদের এক বিস্ময়কর এবং ভয়াবহ সামরিক অভিযান—যার প্রভাব আগামী দিনে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে আরও বড় প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে।

 

সূত্রঃ ওয়াশিংটন পোস্ট 

রিফাত

×