
বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাবশালী পরমাণু সাবমেরিন চুক্তি 'অকাস' নিয়ে নতুন করে ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প প্রশাসনের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ কৌশলের সঙ্গে মিলিয়ে চুক্তিটির পর্যালোচনা শুরু করেছে হোয়াইট হাউজ। ফলে অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
চীনের প্রভাব মোকাবেলায় ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল এই বহু বিলিয়ন ডলারের অকাস চুক্তি। এর আওতায় অস্ট্রেলিয়া যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রথমবারের মতো পারমাণবিক চালিত সাবমেরিন পেতে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে তিন দেশের যৌথ প্রযুক্তিতে নির্মিত হবে নতুন প্রজন্মের সাবমেরিন বহর।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এখন বলা হচ্ছে, ট্রাম্প প্রশাসনের 'আমেরিকা ফার্স্ট' নিরাপত্তা কৌশলের সঙ্গে এই উদ্যোগ কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা মূল্যায়নের জন্য চুক্তির নতুন করে পর্যালোচনা শুরু করা হয়েছে।
যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া অবশ্য বিষয়টিকে স্বাভাবিক প্রশাসনিক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখছে। দুই দেশই বলেছে, নতুন প্রশাসন এলে এ ধরনের চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করা স্বাভাবিক।
চাপের মুখে মিত্ররা
ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে সামরিক খাতে আরও বেশি অর্থ ব্যয়ের জন্য মিত্রদের ওপর চাপ দেওয়া হচ্ছে। যুক্তরাজ্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ২০২৮ সালের মধ্যে সামরিক খাতে জিডিপির ২.৫ শতাংশ খরচ করবে, আর আগামী পার্লামেন্ট মেয়াদে সেটা ৩ শতাংশে উন্নীত করবে। তবে অস্ট্রেলিয়া এখনো যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া ৩.৫ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে রাজি হয়নি।
এদিকে, অকাস পর্যালোচনার নেতৃত্ব দিচ্ছেন এলব্রিজ কোলবি, যিনি এর আগে এই চুক্তির সমালোচনায় বলেছিলেন, “যুক্তরাষ্ট্র যখন নিজেই এই পারমাণবিক প্রযুক্তির ঘাটতিতে ভুগছে, তখন কেন সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ অন্যকে দেবে?”
অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী রিচার্ড মার্লেস স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানান, তিনি অকাস চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে আত্মবিশ্বাসী। তিনি বলেন, “আপনি শুধু মানচিত্র দেখলেই বুঝবেন, অস্ট্রেলিয়ার জন্য দীর্ঘপাল্লার সাবমেরিন সক্ষমতা কতটা জরুরি।”
মার্লেস আরও বলেন, দেশীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার পরিকল্পনায় স্থির থাকা উচিত। এটি পূর্ববর্তী সরকারের সেই বিতর্কিত সিদ্ধান্তের প্রতি ইঙ্গিত, যেখানে ফ্রান্সের সঙ্গে সাবমেরিন চুক্তি বাতিল করে অকাসকে বেছে নেওয়া হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ কী?
বিবিসি সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেন, “এই উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য ছিল মিত্রদের মধ্যে যৌথ প্রতিরক্ষা দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া। এটি এখন প্রেসিডেন্টের 'আমেরিকা ফার্স্ট' কৌশলের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
মার্কিন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘ডিফেন্স প্রায়োরিটিজ’-এর গবেষক ড. জেনিফার কাভানাগ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাবমেরিন উৎপাদন সক্ষমতা ইতোমধ্যেই চাপে রয়েছে। তার মতে, “যুক্তরাষ্ট্রের নিজেদের প্রয়োজনই মেটাতে সমস্যা হচ্ছে, এই অবস্থায় অন্য দেশে এই প্রযুক্তি পাঠানো কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।”
তিনি আরও জানান, অকাস চুক্তির ভবিষ্যৎ যদি সাবমেরিন সরবরাহের পরিবর্তে দীর্ঘপাল্লার অস্ত্র প্রযুক্তি ভাগাভাগিতে কেন্দ্রিত হয়, সেটিও অবাক হওয়ার কিছু হবে না।
তবে যুক্তরাষ্ট্র যদি অকাস থেকে পুরোপুরি সরে আসে, তাহলে সেটা হবে চীনের জন্য বড় জয়। কারণ শুরু থেকেই এই চুক্তির তীব্র সমালোচনা করে এসেছে বেইজিং, একে অস্ত্র প্রতিযোগিতার উৎস হিসেবে চিহ্নিত করে।
অস্ট্রেলিয়ার এক সরকারি মুখপাত্র জানান, “নতুন প্রশাসনের পক্ষে এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি নিরাপত্তা চুক্তি পর্যালোচনা করা স্বাভাবিক। যুক্তরাজ্যও সম্প্রতি এরকম একটি রিভিউ শেষ করেছে।”তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রে পুরো রাজনৈতিক পরিসরজুড়েই এই প্রকল্পের ব্যাপারে সুস্পষ্ট ও ধারাবাহিক সমর্থন রয়েছে।” ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে এই ঐতিহাসিক প্রকল্পে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেন তিনি।
অকাস কী?
অকাস চুক্তি অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা সক্ষমতার এক বড় পরিবর্তন। যুক্তরাজ্যের পর এটি হবে দ্বিতীয় দেশ, যাকে যুক্তরাষ্ট্র তার পরমাণু প্রযুক্তির প্রবেশাধিকার দিচ্ছে।এই সাবমেরিনগুলো ডিজেলচালিত সাবমেরিনের তুলনায় দ্রুত এবং দীর্ঘ দূরত্বে অভিযান চালাতে সক্ষম হবে। একইসঙ্গে শত্রুপক্ষকে দূর থেকে লক্ষ্য করে আঘাত হানার সামর্থ্যও থাকবে অস্ট্রেলিয়ার হাতে।
২০২৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য পার্থ শহরে কিছু পারমাণবিক সাবমেরিন মোতায়েন করবে। এরপর ২০৩০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে তিনটি পুরনো ভার্জিনিয়া-ক্লাস সাবমেরিন কিনবে অস্ট্রেলিয়া, পরে আরও দুটি কেনার সুযোগ থাকবে।পরবর্তীতে তিন দেশের প্রযুক্তিতে তৈরি হবে সম্পূর্ণ নতুন ডিজাইনের পারমাণবিক সাবমেরিন, যা যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার জন্য নির্মিত হবে।
এই চুক্তিকে ঘিরে বহুবার উদ্বেগ জানিয়েছে চীন। তাদের মতে, এটি অঞ্চলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে দেবে এবং নিরাপত্তা ভারসাম্য নষ্ট করবে।
যদিও অকাস চুক্তির ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত নয়, তবে যুক্তরাষ্ট্রের পর্যালোচনার ঘোষণা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা জোটগুলো এখন আরও বেশি করে ‘জাতীয় স্বার্থ’-নির্ভর হয়ে উঠছে। অকাসের ভবিষ্যৎ ঠিক কীভাবে রূপ নেবে, তা নির্ভর করবে আগামী কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত ও সামরিক কৌশলের ওপর।
সূত্র:বিবিসি নিউজ
আফরোজা