
ছবি: সংগৃহীত
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা ঘিরে মধ্যপ্রাচ্যে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে। উভয় পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে হামলা চালিয়ে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে, যা বিশ্লেষকদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি করেছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ হুমকি দিয়েছেন যে, ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চলতে থাকলে তেহরানকে 'জ্বালিয়ে দেওয়া হবে'।
এই সংঘাতের সূত্রপাত হয় বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে ইরানের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনায় ইসরায়েলের 'অপারেশন রাইজিং লায়ন' নামের অভিযানের মধ্য দিয়ে। ওই রাতের হামলার পর শুক্রবার ও শনিবারও ইরানের বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এসব হামলায় ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা, পরমাণুবিজ্ঞানীসহ অন্তত ৭৮ জন নিহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে ইরান। শনিবার রাতেও ইরানের বিভিন্ন স্থানে ইসরায়েলের হামলা অব্যাহত ছিল।
ইসরায়েলের হামলার কড়া জবাব দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিসহ বিভিন্ন কর্মকর্তা। এরপর শুক্রবার রাতে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী আইআরজিসি (ইসলামি বিপ্লবী গার্ড কোর) 'ট্রু প্রমিজ-৩' নামে অভিযান চালিয়ে তেল আবিব ও জেরুজালেমে ক্ষেপণাস্ত্র এবং রকেট হামলা চালায়। এই হামলায় ইসরায়েলের বেশ কয়েকটি ভবন বিধ্বস্ত হয়। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর তথ্য অনুযায়ী, এই হামলায় তিন ইসরায়েলি নিহত ও অন্তত ৩৪ জন আহত হয়েছেন।
ইরানের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, 'ট্রু প্রমিজ-৩' অভিযান অব্যাহত থাকবে। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে এক ইরানি কর্মকর্তা ফারস নিউজকে বলেন, "গত রাতে ইরানের চালানো সীমিত হামলার মধ্য দিয়ে ইসরায়েলকে মোকাবিলা শেষ হবে না। হামলা চলবে। আগ্রাসনকারীদের জন্য তা হবে খুবই পীড়াদায়ক।" ইসরায়েলের পাশাপাশি দেশটির মিত্রদেরও হুমকি দিয়েছে ইরান। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের সামরিক ঘাঁটি এবং যুদ্ধজাহাজ ইসরায়েলকে সহায়তা করলে তাদেরও হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হবে বলে ইরান সরকার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে।
তেহরানকে ‘জ্বালিয়ে দেওয়ার’ হুমকি ও ইসরায়েলের পাল্টা হুঁশিয়ারি: ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ শনিবার আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির উদ্দেশে বলেছেন, "খামেনি ইরানের নাগরিকদের জিম্মি করছেন। ইসরায়েলের জনগণের ক্ষতি হলে ইরানকে চড়া মূল্য দিতে হবে। খামেনি যদি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে থাকেন, তাহলে তেহরান 'জ্বলবে'।" পরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, "আমরা আয়াতুল্লাহ সরকারের প্রতিটি স্থাপনা ও লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানব। (ইসরায়েলের হামলা) থেকে এত দিন তারা যা টের পেয়েছে, তা আগামী দিনগুলোতে যে হামলা চালানো হবে, তার তুলনায় কিছুই নয়।" তিনি জানান, ইসরায়েলি বাহিনী বর্তমানে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনের সক্ষমতা ধ্বংস করছে।
দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের আশঙ্কা: বিবিসির মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সংবাদদাতা হুগো বাচেগা মনে করেন, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি সামরিক সংঘাত শুরু হতে পারে। তিনি বলেন, "ইরানে চালানো হামলাকে দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের সূচনা বলে ইতিমধ্যে উল্লেখ করেছেন ইসরায়েলের কর্মকর্তারা। এর অর্থ হলো তাঁরা ইরানে আরও লম্বা সময় ধরে হামলা চালাতে চান।" অস্ট্রেলিয়ার ডেকিন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শাহরাম আকবারজাদেহ মনে করেন, ইসরায়েল এই সংঘাতের মাধ্যমে ইরানে 'শাসক পরিবর্তনের' আশা করছে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে এতে জড়াতে চাইছে।
ইসরায়েলে হামলার বিস্তারিত: শুক্রবার রাতে ইসরায়েলে চালানো ইরানের হামলায় তেল আবিবের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় একটি বহুতল ভবনের নিচের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং শহরের উপকণ্ঠে নয়টি ভবন ধ্বংস হয়ে যায়। জেরুজালেমেও বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শোনা গেছে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর দাবি, ইরান দেড় শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়লেও, সেগুলোর বেশিরভাগই আকাশে থাকতে প্রতিহত করা হয়েছে। সংঘাত বৃদ্ধির শঙ্কায় লেবানন ও জর্ডান সীমান্তে সেনা মোতায়েন করেছে ইসরায়েল এবং বেন গুরিয়ন বিমানবন্দর বন্ধ ঘোষণা করেছে।
ইরানে ইসরায়েলি হামলার বিস্তারিত: বৃহস্পতিবার রাতের হামলায় তেহরান থেকে ২২৫ কিলোমিটার দূরে নাতাঞ্জ পরমাণু প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে শুক্রবার ও শনিবার ইরানের ফোর্ডো ও ইসপাহান পরমাণুকেন্দ্রে হামলা চালানো হয়। তবে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক নজরদারি সংস্থা (আইএইএ) জানিয়েছে, এসব পরমাণুকেন্দ্র থেকে তেজস্ক্রিয় পদার্থের বিকিরণ বৃদ্ধি পায়নি। ইসরায়েল জানিয়েছে, বৃহস্পতিবারের হামলায় প্রায় ২০০ যুদ্ধবিমান অংশ নিয়েছিল এবং শুক্র ও শনিবারের হামলায়ও কয়েক ডজন যুদ্ধবিমান অংশ নেয়। ইরানের বেশ কিছু ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন কারখানা এবং তেহরানের মেহরাবাদ বিমানবন্দরের যুদ্ধবিমান রাখার স্থানেও হামলা চালানো হয়েছে। জানজান শহরের একটি সেনাঘাঁটি ও বুশেহর প্রদেশের সাউথ পার্স গ্যাসক্ষেত্রেও বোমা হামলা হয়েছে, যাতে আগুন ধরে যায়। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে শনিবার জানানো হয়েছে, হামলা শুরুর পর থেকে ইরানের মোট ২০ জন সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যা করেছে তারা, যার মধ্যে সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল বাঘেরি ও আইআরজিসির প্রধান হোসেইন সালামি রয়েছেন। এছাড়াও ৯ জন পরমাণুবিজ্ঞানীকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি ইসরায়েলের। অন্যদিকে, জাতিসংঘে ইরানের রাষ্ট্রদূত আমির সায়েদি জানিয়েছেন, ইসরায়েলের হামলায় ইরানে ৭৮ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ২০টি শিশুসহ তেহরানের একটি আবাসিক ভবনে ৬০ জন নিহত হয়েছেন। ইরান তিনটি ইসরায়েলি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে দুই পাইলটকে আটক করারও দাবি করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ও আন্তর্জাতিক আহ্বান: সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই জানিয়েছে, ইরানে হামলার আগে ইসরায়েলকে গোপনে প্রায় ৩০০টি অত্যাধুনিক ‘হেলফায়ার’ ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, যা হামলার বিষয়ে তাদের পূর্ব-জ্ঞানের ইঙ্গিত দেয়। যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হামলায় মার্কিন বাহিনীর জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। এই হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দোষারোপ করে ইরান পারমাণবিক আলোচনা স্থগিত করেছে।
এদিকে, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ দুই পক্ষকেই সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। গত শুক্রবার নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকেও এই আহ্বান জানানো হয়। পোপ চতুর্দশ লিও এবং যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য ও তুরস্কের শীর্ষ নেতারা ফোনালাপে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা কমানোর বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন।
সাব্বির