
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আবারও প্রকাশ্যে এলেন আর সঙ্গে এনেছেন এক ভিন্নধর্মী সতর্কবার্তা। এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন এমন এক বিপজ্জনক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে সরকার পরিচালনার ধরন একনায়কতান্ত্রিক দেশের মতো হয়ে উঠছে। যদিও তিনি সরাসরি কারও নাম বলেননি, তবুও তার ইঙ্গিত যে ট্রাম্প প্রশাসনের দিকেই, তা বুঝতে কষ্ট হয়নি।
কানেকটিকাটের হার্টফোর্ডে একটি নাগরিক সংগঠনের আয়োজনে ওবামা অংশ নেন লেখক ও ইতিহাসবিদ হিদার কক্স রিচার্ডসনের সঙ্গে। সেখানেই তিনি বলেন, “বর্তমানে যারা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকার চালাচ্ছেন, তারা এমন সব কথা বলছেন আর এমনভাবে কাজ করছেন, যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে না গিয়ে বরং একনায়কতান্ত্রিক আচরণের দিকে ইঙ্গিত দেয়।”
তিনি মনে করিয়ে দেন, প্রকৃত গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচন নয়, বরং আইনের শাসন, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং প্রতিবাদের অধিকার রক্ষা করাই আসল। ওবামার ভাষায়, “এই দেশটা এমনভাবে গড়া হয়নি, যেখানে নেতারা যা খুশি তাই করবেন। শপথ নেওয়া মানে সেটা গুরুত্ব দিয়ে পালন করাও জরুরি।”
তিনি বলেন, “আমরা এখনো পুরোপুরি একনায়কতন্ত্রে ঢুকিনি। তবে আমরা খুব কাছাকাছি চলে এসেছি, এবং সেই কারণেই এখনই আমাদের থামতে হবে। একবার নিচে পড়ে গেলে সেখান থেকে ফিরতে অনেক কষ্ট হয়।”
তবে এমন এক সময়, যখন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়ছে, সাধারণ মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে, এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও যুদ্ধের শঙ্কা বাড়ছে ওবামা তবুও সরাসরি কাউকে দায়ী না করে সতর্ক বার্তার আড়ালে থাকাই পছন্দ করেছেন।
তিনি উল্লেখ করেননি, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সম্ভাব্য বোমা হামলার পরিকল্পনার বিষয়টি। আবার, সম্প্রতি যেভাবে ডেমোক্রেট নেতাদের গ্রেপ্তার, হুমকি কিংবা হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটেছে তাও এড়িয়ে যান।
এর পরিবর্তে তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়, করপোরেট প্রতিষ্ঠান, আইনজীবীদের উচিত এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হওয়া। শুধু সরকার নয়, বাইরের মানুষদেরও বলতে হবে, ‘না, আমরা এভাবে চলতে পারি না।’”
ওবামা এবার মুখ খুলেছেন ধনী প্রগতিশীলদের নিয়েও। তিনি বলেন, “আমার প্রেসিডেন্সির সময় অনেক প্রগতিশীল ব্যক্তি নিজের আদর্শ নিয়ে গর্ব করতেন। কারণ তাদের তা প্রমাণ করতে হতো না। তারা সমাজ সচেতন হতেন, আবার হ্যাম্পটনে বিলাসবহুল জীবন যাপন করতেন, ইউরোপে ঘুরে বেড়াতেন, এবং নিজেদেরকে ‘প্রগ্রেসিভ’ ভাবতেন।”
কিন্তু এখন সময় বদলেছে। “এখন পরীক্ষার সময়। এখনই বোঝা যাবে আপনি কী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। যদি আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতা হন, কিছু দাতা হারাতে পারেন। আইন ফার্মের আয় কমে যেতে পারে। যার মানে, এই গ্রীষ্মে আপনার হ্যাম্পটনের বাড়ির রান্নাঘরটা আর নতুন করে সাজানো নাও হতে পারে,” বলেন ওবামা।
তার এমন বক্তব্যে কেউ কেউ হতাশও হয়েছেন। অনেকেই চান, ওবামা যেন আরও স্পষ্টভাবে ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে মুখ খোলেন। কিন্তু তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি নিয়মিত সমালোচনা করে তার কণ্ঠের শক্তি ক্ষয় করতে চান না। তাই তার কথাবার্তায় থাকে পরোক্ষ ইঙ্গিত, ভাবনার খোরাক আর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে টানা উদাহরণ।
ওবামা মনে করেন, গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্ষতি তখনই হয়, যখন মানুষ আর সত্যের ওপর ভরসা রাখে না। তিনি বলেন, “২০২০ সালের নির্বাচন কে জিতেছে এটা একটা স্পষ্ট সত্য। আমি জানি না কে সেটা মানতে চায় না। আবার আমার অভিষেকে কত মানুষ এসেছিল তাও একটা পরিসংখ্যান। আমি ব্যক্তিগতভাবে এসব নিয়ে ভাবি না, কিন্তু সত্য গুরুত্বপূর্ণ।”
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “আগে আমরা নীতিনির্ধারণ বা মতাদর্শ নিয়ে তর্ক করতাম। এখন আমরা তর্ক করি কোনটা সত্য, আর কোনটা নয় এটা খুবই উদ্বেগজনক।”
যদিও প্রকাশ্যে খুব বেশি দেখা যায় না, তবে ওবামা এখনো দলের অনেক নেতা, গভর্নর ও প্রার্থীদের নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে চলেছেন। আগামী মাসে তিনি ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির তহবিল সংগ্রহের একটি বড় আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন নিউ জার্সির গভর্নরের বাসভবনে।
এখনো তিনি হাজার হাজার মানুষের ভিড় টানতে পারেন রাজনৈতিক মঞ্চে। ধারণা করা হচ্ছে, নিউ জার্সি ও ভার্জিনিয়ায় আসন্ন গভর্নর নির্বাচনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।
তাছাড়া, তিনি এখন তার আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ড লেখায় ব্যস্ত। পাশাপাশি তার প্রোডাকশন কোম্পানি ‘Higher Ground’-এর মাধ্যমে তৈরি করছেন ডকুমেন্টারি ও শো। সাম্প্রতিক একটি প্রজেক্টে তিনি তুলে ধরেছেন বিমানবাহিনীর অভিজাত স্কোয়াড্রন Thunderbirds-এর গল্প। আর শিকাগোতে তার প্রেসিডেন্সিয়াল সেন্টার চালুর প্রস্তুতিও চলছে, যা আগামী বসন্তেই উদ্বোধনের সম্ভাবনা।
নির্বাচনের পর দলের অনেকেই ওবামার সময়ের নীতির সমালোচনা করেছেন। তরুণ ভোটারদের একাংশ তার প্রতি উদাসীন, আবার কিছু প্রগ্রেসিভ নেতাও তার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তবুও তিনি বিশ্বাস করেন, দলের ভবিষ্যৎ আছে নতুন নেতৃত্বের হাতেই।
এক ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, ওবামা মনে করেন এই সময়টা অনেকটা ২০০৫ সালের মতো, যখন তিনি প্রথম সেনেটর হন। তখনও ডেমোক্রেটরা ক্ষমতার বাইরে ছিল। কিন্তু ২০০৬ সালে কংগ্রেসে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, আর তার দুই বছর পরই তিনিই হন দেশের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট।
গণতন্ত্রের চর্চা কি আসলেই দুর্বল হয়ে যাচ্ছে? সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মতে, এখনই সময় সেই প্রশ্নের জবাব খোঁজার। তিনি সরাসরি না বললেও, তার বক্তব্যে স্পষ্ট এক বার্তা গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি যখন নড়ে যায়, তখন আর হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। এখন দরকার সাহসী কণ্ঠস্বর, মূল্যবোধে বিশ্বাস এবং সত্যকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি। না হলে, হয়তো সেই প্রান্তে গিয়ে পড়ে যেতে বেশি সময় লাগবে না যেখান থেকে ফেরার পথ অনেক কঠিন।
সূত্র:https://tinyurl.com/3f9ms3cn
আফরোজা