ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৯ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

তাপপ্রবাহ মোকাবেলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘জাতীয় গাইডলাইন’ 

এবারই শেষ নয়, এখন থেকেই প্রস্তুত থাকতে হবে : স্বাস্থ্যমন্ত্রী

প্রকাশিত: ১৭:৩১, ৫ মে ২০২৪; আপডেট: ১৮:১৯, ৫ মে ২০২৪

এবারই শেষ নয়, এখন থেকেই প্রস্তুত থাকতে হবে : স্বাস্থ্যমন্ত্রী

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে তাপমাত্রা। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে তাপমাত্রা যখন ৩৬-৩৭.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়, তখন তাকে মৃদু তাপপ্রবাহ বলে। ৩৮-৩৯.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বলা হয়। আর তাপমাত্রা যখন ৪০-৪১.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে তখন তাকে তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয়। এছাড়া তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি হলে তাকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বলে। ২০১৭ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশে তীব্র তাপপ্রবাহ দেখা গেলেও চলতি বছর টানা এক মাস অতি তীব্র তাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে কাটিয়েছে দেশের মানুষ। গরমে হাঁসফাঁস হয়ে মানুষজন আক্রান্ত হয়েছেন নানান ধরণের রোগে। আর তাই এখন থেকে তীব্র থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ মোকাবেলায় ‘জাতীয় গাইডলাইন’ তৈরি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। যেখানে গরমজনীত রোগে নিজেকে সুস্থ রাখতে কি কি করণীয়সহ লক্ষণ ও চিকিৎসা যাবতীয় পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির কথা তুলে ধরা হয়েছে।

রবিবার রাজধানীর একটি হোটেলে এই জাতীয় গাইডলাইনের মোড়ক উন্মোচন করেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। জাতিসংঘের জরুরি শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) সার্বিক সহযোগিতায় তৈরি হওয়া গাইডলাইনের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়া পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশের গত কয়েকদিনের যে পরিমাণ তাপমাত্রা বেড়ে গিয়েছিল তাতে সাধারণ মানুষকে পোহাতে হয়েছে চরম দুর্ভোগ। এই তাপপ্রবাহ যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে তখনই আমরা এই নীতিমালা তৈরির নির্দেশ দেই। এটি সময় উপযোগী একটি নির্দেশিকা, যা সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। চিকিৎসকদের এই নীতিমালার আলোকে অনলাইনে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, যখন গরম চরম পর্যায়ে যায়, তখন আমি সবাইকে একটাই নির্দেশনা দিয়েছিলাম, যে সব রোগের অপারেশন করতে দেরি হবে ও পরে চিকিৎসা করা যাবে তা আপাতত বন্ধ করে আমাদের হাসপাতালগুলো যেন ফাঁকা থাকে। তীব্র গরমের মধ্যে বাচ্চা ও বয়স্করা এবং যাদের বিভিন্ন অসুখ আছে তাদের বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। আজকে যেটা উদ্বোধন করা হলো এটি একটা সময়োপযোগী জিনিস। আমার মনে হয় এই গরম আগামী বছরও আসবে এবং চলতেই থাকবে। ইতোমধ্যে এ নির্দেশনা সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। আমরা স্কুলে স্কুলে লিফলেট বিতরণ করার ব্যবস্থা করছি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপর কারো কোনো হাত নেই, এটা আমরা কিছু করতে পারবো না। তবে আমাদের মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব, আমরা এই গরমের মধ্যে কীভাবে মানুষকে সুস্থ রাখতে পারি। এই কাজে অংশগ্রহণ করার জন্য ইউনিসেফকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এছাড়া আমাদের মন্ত্রণালয়সহ যারা এ কাজটি করতে দীর্ঘদিন পরিশ্রম করেছেন তাদেরও আমার আন্তরিক ধন্যবাদ। 

নগরপরিকল্পনাবিদদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রী বলেন, আমরা দেখি গ্রামের চেয়ে ঢাকা শহরে তাপমাত্রা অত্যধিক বেশি। এর কারণ আমরা ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে ঢাকা শহরে গাছপালা সব কেটে সাবাড় করে ফেলেছি। জলবায়ু পরিবর্তনের উপর হয়তো আমরা খুব প্রভাব ফেলতে পারি না। কিন্তু নগর পরিকল্পনা করার সময় যদি এসব বিষয় আমরা মাথায় রাখি তাহলে অনেকাংশে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। 

অনুষ্ঠানে গাইডলাইন জানাতে গিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সাবরিনা ফ্লোরা বলেন, অন্তঃসত্ত্বা নারী, শিশু ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে উচ্চ তাপজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে সুরক্ষা দিতেই এই জাতীয় নীতিমালা বা গাইডলাইন চালু করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবে বাংলাদেশের ক্ষতি ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকার প্রেক্ষাপটে এই উদ্যোগ শিশুদের নিরাপদ রাখার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। গাইডলাইনে গরমের সময়ে দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী ও সাধারণ মানুষকে তাপপ্রবাহের বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানের আয়োজক ও বড় আকারের অনুষ্ঠানের সময় টেলিভিশন, রেডিও, সামাজিক গণমাধ্যমসহ অন্যান্য সকল মাধ্যমে সচেতনতামূলক বার্তা প্রচার করতে হবে। বার্তাগুলোর মধ্যে অন্যতম, গরমের সময়ে রোদে অথবা বাইরে কোনো ধরণের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার আগে আবহাওয়ার পূর্বাভাস সম্পর্কে জেনে নিতে হবে। তীব্র গরমে বেশিক্ষণ রোদে থাকা যাবে না। মাঝে মাঝে ছায়ায় বিশ্রাম নিতে হবে। সারাদিনে কমপক্ষে আড়াই লিটার থেকে ৩ লিটার নিরাপদ পানি পান করতে হবে। অস্বাস্থ্যকর পানীয় ও খাবার পরিহার করতে হবে। প্রয়োজনে বাইরে অথবা রোদ থেকে বাসায় এসে গোসল করতে হবে। তিনি আরও বলেন, গরমে সুস্থ থাকতে রোদে বা বাইরে থাকার সময়ে ঢিলেঢালা পাতলা কাপড় পড়তে হবে। রঙ্গিন পোশাক এড়িয়ে চলতে হবে। তীব্র গরমের সময় প্রয়োজনে যদি গর্ভবতী মা, শিশু ও বয়স্কদের রোদে অথবা বাইরে যেতেই হয় তাদের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। নিয়মিত বিরতিতে ছায়ায় বিশ্রাম নিতে হবে। গরমের সময় বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, প্রচ- মাথা ব্যাথা, শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, প্র¯্রাব কমে যাওয়া, প্র¯্রাবে জ্বালা পোড়া করা, অস্বাভাবিক আচরণ ও অজ্ঞান হয়ে গেলে দ্রুত হাসপাতালে যাওয়া এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার কথা বলেন তিনি। ডা. সাবরিনা ফ্লোরা আরও বলেন, অন্তঃসত্ত্বা নারী, শিশু ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে উচ্চ তাপজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে সুরক্ষা দিতেই এই জাতীয় নীতিমালা বা গাইডলাইন চালু করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবে বাংলাদেশের ক্ষতি ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকার প্রেক্ষাপটে এই উদ্যোগ শিশুদের নিরাপদ রাখার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসব ঝুঁকি মধ্যে রয়েছে, তাপমাত্রা প্রতি ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধিতে অপরিণত শিশু জন্মের ঝুঁকি ৫ শতাংশ বাড়ে এবং তাপপ্রবাহ না থাকা সময়ের তুলনায় তাপপ্রবাহের সময়ে এই হার ১৬ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। এর মানে হলো, তাপপ্রবাহের সময়ে অপরিণত শিশু জন্মের ঝুঁকি অনেক  বেশি। অর্থাৎ তাপপ্রবাহ যত বেশি এবং যত তীব্র হবে ঝুঁকি তত বাড়বে। বাংলাদেশে অপরিণত শিশু জন্মের হার বিশ্বে সবচেয়ে বেশি (১৬.২ শতাংশ) এবং তাপপ্রবাহে এটি আরও বাড়ে।

এছাড়া ইউনিসেফের হিট ফ্রেমওয়ার্কও বি.ই.এ.টি এই নীতিমালা বা গাইডলাইনের অন্তর্ভুক্ত। ইউনিসেফের হিট  ফ্রেমওয়ার্ক ইংরেজি শব্দাক্ষরের ভিত্তিতে তৈরি। যেমন, ১. গরমজনিত চাপ সম্পর্কে সচেতন থাকুন এবং নিজেকে সুরক্ষিত রাখুন, ২. গরমজনিত চাপের লক্ষণগুলো সহজেই শনাক্ত করুন, ৩. নিজেকে ও অন্যদের সুরক্ষার জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নিন এবং ৪. কারো মধ্যে গুরুতর লক্ষণ দেখা গেলে তাকে অবিলম্বে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যান। 

এসময় জানানো হয়, এই নির্দেশাবলির লক্ষ্য হলো জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা বাড়ানো এবং গরমজনিত স্বাস্থ্য উদ্যোগে মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা। বৃহত্তর কমিউনিটি ও জনসাধারণের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, গণমাধ্যম ও তৃণমূল পর্যায়ের সংগঠনের মাধ্যমে এই নীতামালা বা গাইডলাইন সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার চালানো হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম, ইউনিসেফ বাংলাদেশের ডেপুটি রিপ্রেজেনটেটিভ এমা ব্রিগহাম। 

 

স্বপ্না

×