ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

মাছের কেন ঘাড় নেই

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ২০ মে ২০১৬

মাছের কেন ঘাড় নেই

মাছের পাখনা আছে, কানকো আছে। কিন্তু ঘাড় নেই, গলা নেই। কেন নেই? কারণ ঘাড় থাকলে তা পানিতে সামনে-পেছনে নড়ত এবং তাতে করে মাছের পক্ষে দ্রুত সাঁতার কাটতে অসুবিধা হতো। তার চেয়েও বড় কথা সংজ্ঞা অনুযায়ী যে প্রাণীটিকে মাছ বলা হয় সেটির ঘাড় থাকতে পারে না। মাছের মতো কোন প্রাণীর যে মুহূর্তে ঘাড় গজায় সে মুহূর্তে সেটি আরেক ধরনের প্রাণীর শ্রেণীভুক্ত হয়ে যায়। মাছ জাতীয় প্রাণীর ঘাড় থাকার প্রাচীনতম রেকর্ডের অধিকারী হচ্ছে টিকটালিক রোজাই নামক এই প্রাণী। এটি প্রায় সাড়ে সাঁইত্রিশ কোটি বছর আগে ডেভোনীয় যুগে বাস করত। বিজ্ঞানীরা টিকটালিক রোজাইকে আংশিক মাছ, আংশিক চতুষ্পদী প্রাণীর শ্রেণীতে ফেলেছেন। তবে ঘাড় না থাকলেও মাছের বেশ কিছু হাড় আছে যেগুলো বায়োটিক কাঁধের বন্ধনীর সঙ্গে যুক্ত করে। এই বন্ধনী আবার পাখনার সঙ্গে যুক্ত থাকে। কাঁধের বন্ধনীগুলো হচ্ছে কণ্ঠাস্থি ও অংসফলক বা পিঠের ডানার মতো হাউময় উপাদান যা সামনের উপাঙ্গের ভার বহন করে- তা সেটা পাখনাই হোক আর প্রত্যঙ্গই হোক। মাছের ক্ষেত্রে এই হাড়ময় উপাদানগুলো যে সর্বদা অতি শক্তভাবে যুক্ত থাকে তা নয়। তবে এটা হলো হাড়ের কঠিন উপরিতল। কালের প্রবাহে কিছু কিছু মাছ আকার-আকৃতি বদলাতে শুরু করে। যেমন লোব-ফিন্ড ফিশের কথাই ধরা যাক যার মধ্যে কোয়েলাকান্থও রয়েছে। এটি হলো এক প্রাচীন গোত্রের মাছ যা অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে ধারণা করা হতো। কিন্তু ১৯৩৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার উপকূলের অদূরবর্তী সাগরে জেলেদের জালে একটি কোয়েলাকান্থ ধরা পড়ার ফলে আগের ধারণা ভেঙ্গে যায়। বিজ্ঞানীরা ভাবতে শুরু করেন যে, কোয়েলাকান্থ বিরল হলেও একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। জীবাশ্মর রেকর্ড ঘেঁটে জানা যায় লোব-ফিন্ড মাছদের যেসব হাড় কাঁধ দুটিকে কশেটির সঙ্গে যুক্ত করে রাখত কালের প্রবাহে সেই হাড়গুলোর কয়েকটি লুপ্ত হয়ে গেছে। গবেষকরা ৯ ফুট লম্বা টিকটালি রোজাইকে লোব-ফিন্ড ফিশ বলে মনে করেন। তবে এর যেসব হাড় করোটিকে কাঁধের বন্ধনীর সঙ্গে যুক্ত করে রাখত সেগুলো সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল এবং সে জায়গায় মাছটির ঘাড় গজিয়েছিল। এই ঘাড়ই সম্ভবত প্রাণীটিকে অগভীর স্বাদু পানির পরিবেশে শিকার করতে সাহায্য করত। ঘাড় থাকার জন্যই প্রাণীটি শরীর থেকে স্বাধীনভাবে মাথা নড়াচড়া করতে পারত। অগভীর জলাভূমিতে বাস করলে এটা দারুণ কাজে লাগে। কারণ শিকারকে খপ করে ধরে ফেলার জন্য অথবা পানির ওপর মাথাটা উঁচু করে শ্বাস নেয়ার জন্য দ্রুত মাথা ঘুরিয়ে নেয়ার প্রয়োজন হতে পারে। পক্ষান্তরে ঘাড় না থাকায় মাছদের কোন নির্দিষ্ট দিকে মাথাটা তাগ করার জন্য গোটা শরীর ঘুরিয়ে নিতে হয়। নিখুঁত বিচারে বলতে গেলে টিকটালিক কি মাছ ছিল না চতুষ্পদী জলজপ্রাণী ছিল? বিবর্তনের ইতিহাসে এটা এক ধূসর অধ্যায় যেখানে এ জাতীয় প্রশ্নের কোন সহজ উত্তর নেই। এই ধূসর অধ্যায়টি প্রায় ২ কোটি বছর স্থায়ী ছিল। এ সময় লোব-ফিন্ড ফিশ থেকে বংশধারা বিবর্তিত হয় চারপেয়ে উভচর প্রাণীতে। বিজ্ঞানীরা এই ধূসর অধ্যায়কে মোজাইক বিবর্তনের যুগ বলে থাকেন যখন কোন প্রাণীর কিছু অংশের বিবর্তন ঘটেছিল আবার অন্য অংশগুলো সেই আদিম রূপেই থেকে গিয়েছিল। ঘাড়ওয়ালা প্রাণীদের এক অনন্য সুবিধা আছে। তারা দ্রুত তাদের মুখ ঘুরিয়ে নিতে পারে। গোটা শরীর ঘোরানোর দরকার পড়ে না। বলাবাহুল্য, প্রথমদিকের এই চারপেয়ে প্রাণীদের সবাই ছিল শিকারি। তবে এ কথাও তুললে চলবে না যে অনেক মাছও শিকারি এবং ঘাড় না থাকলেও তারা শিকারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সফল। উপরন্তু তিমি ও ডলফিনও একদা ডাঙ্গায় বাস করত। পরে ওরা পানির জগতে ফিরে গেছে। নতুন করে সামুদ্রিক প্রাণীতে পরিণত হওয়ার পর তিমি ও ডলফিনের ঘাড়ের কশেরুকা দারুণভাবে ছোট হয়ে যায়। তাই দেখা যায় ওদের গোটা ঘাড় লম্বা ও নমনীয় তো নয়ই বরং হ্রস্ব ও কঠিন। সূত্র : সায়েন্স ডেইলি
×