ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৮ জুন ২০২৫, ১৪ আষাঢ় ১৪৩২

পাবনার মজুমদার পরিবারের খ্যাতিমান মূকাভিনয় ও সঙ্গীত শিল্পীরা 

হৃদয় হোসাইন,কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার,পাবনা

প্রকাশিত: ১৮:৩৪, ২৮ জুন ২০২৫; আপডেট: ১৮:৩৬, ২৮ জুন ২০২৫

পাবনার মজুমদার পরিবারের খ্যাতিমান মূকাভিনয় ও সঙ্গীত শিল্পীরা 

দৈনিক জনকণ্ঠ

পণ্ডিত বারীণ মজুমদার ছিলেন একজন বাংলাদেশি সঙ্গীত-অধ্যক্ষ,রাগসংগীত বিশারদ ও উচ্চাঙ্গ সংগীতশিল্পী।তাঁর পিতা নিশেন্দ্রনাথ মজুমদার সংগীতশিল্পী ছিলেন। মাতা মণিমালা মজুমদার সেতার বাজাতেন।

বারীণ মজুমদারের স্ত্রী ইলা মজুমদার একজন উচ্চাঙ্গ সংগীতশিল্পী ছিলেন। তাদের দুই সন্তান। হারানো কন্যা পার্থ শারোতি মজুমদার সঙ্গীত সুরকার। কনিষ্ঠপুত্র বাপ্পা মজুমদারও একজন সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালক। পার্থ প্রতীম মজুমদার লব্ধপ্রতিষ্ঠ একজন মূকাভিনয় শিল্পী। বারীণ মজুমদার ও পারিবারিক ঐতিহ্যের সান্নিধ্যে পেয়ে তারা সকলে দেশসেরা খ্যাতিমান সঙ্গীত শিল্পী।

বারীণ মজুমদার ১৯২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাবনা জেলার রাধানগরে এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁকে আখ্যায়িত করা হয় আগ্রা ও রঙ্গিলা ঘরানার যোগ্য উত্তরসাধক হিসেবে। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ১৯৮৩ সালে একুশে পদক এবং ২০০২ সালে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।

শিক্ষা জীবনে রাধানগর মজুমদার একাডেমি স্কুল এন্ড কলেজ পাবনা থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। বারীণ মজুমদারের পিতা নিশেন্দ্রনাথ মজুমদার ছিলেন একজন সঙ্গীতশিল্পী ও নাট্যকার। বারীণ মজুমদার ইলা মজুমদারের সাথে সংসার বাঁধেন।

ইলা একজন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পীও ছিলেন। বারীণ মজুমদার ২০০১ সালের ৩ অক্টোবর ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। বাংলা সঙ্গীতে অসাধারণ অবদানের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার সহ তিনি আরও যে সকল পুরস্কার পেয়েছিলেন,১৯৭০ সালে তমঘা-ই-ইমতিয়াজ়। ১৯৮৩ সালে একুশে পদক। ১৯৮৩ সালে বরেন্দ্র অ্যাকাডেমির সংবর্ধনা।

১৯৮৮ সালে কাজী মাহবুবউল্লাহ জনকল্যাণ ট্রাস্ট পুরস্কার। ১৯৯০ সালে সিধু ভাই স্মৃতি পুরস্কার। ১৯৯১সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে গুণিজন সম্মাননা। ১৯৯৩ সালে জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ থেকে রবীন্দ্র পদক।

১৯৯৫ সালে বেতার টেলিভিশন শিল্পী সংসদ থেকে শিল্পী শ্রেষ্ঠ খেতাব। ১৯৯৭ বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ। ১৯৯৮ জনকণ্ঠ গুণিজন সম্মাননা পদক অর্জন করেন। বারীণ মজুমদারের সান্নিধ্যে পেয়ে ইলা মজুমদার খ্যাতিমান শিল্পী হয়ে উঠেন।

শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী ইলা মজুমদার ১৯৪১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি তাকে সম্মাননা প্রদান করে। সংসার জীবনের অনেক আগে ১৯৫৪ সাল থেকে বারীণ মজুমদার ইলা মজুমদারকে সংগীত শেখানো শুরু করেন।

তিনি ১৯৬১ সালে তার মাস্টার্স দর্শনশাস্ত্র সম্পন্ন করেন। এরপর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ন্যাশনাল মিউজিক কলেজে ১৫ বছরের জন্য পার্ট টাইম শিক্ষক হিসেবেও কাজ করেন। ২০০১ সালের ৩ মে মৃত্যুবরণ করেন। মূকাভিনয় শিল্প পার্থ প্রতিম মজুমদার ১৯৫৪ সালের ১৮ জানুয়ারি পাবনা জেলার কালাচাঁদপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।

৩৭ বছরের ফ্রান্স প্রবাসী এই মূকাভিনয় শিল্পী মূকাভিনয়ের বিচারে বিশ্বে তিনি দ্বিতীয়৷ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ফ্রান্স সরকারের শেভালিয়র উপাধি পান তিনি। তিনিই প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পদক পান। তার অভিনীত একটি ফরাসি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ২৬টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পায়।

মঞ্চের পাশাপাশি ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার বিভিন্ন চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। তিনি ছিলেন বাবা মায়ের দ্বিতীয় সন্তান৷ তাঁর বাবার নাম হিমাংশু কুমার বিশ্বাস এবং মায়ের নাম সুশ্রিকা বিশ্বাস। বারীণ মজুমদার ছিল তার দুঃসম্পর্কের আত্মীয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় বারীণ মজুমদারের মেয়েটি হারিয়ে যায়।

তখন মেয়ে-হারানো বারীণ মজুমদারের অনুরোধে তিনি চলে যান ঢাকার সেগুনবাগিচার বাসার। তখন থেকেই তিনি পার্থ প্রতিম মজুমদার নামে পরিচিত। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি সেগুনবাগিচা ছিলেন। শিক্ষাজীবন শুরু করেন পাবনা শহরের জুবিলি স্কুলে। জানা যায়,প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তার বড়ো ভাইয়েরা তাকে কাকা সুধাংশু কুমার বিশ্বাসের তত্ত্বাবধানে কলকাতার চন্দননগরে পাঠিয়ে দেন।

সেখানে পরার সময় পরিচয় হয় মূকাভিনয় বা মাইমের আর্টিস্ট যোগেশ দত্তের সাথে। তার কাছে মাইম শেখা শুরু। পার্থপ্রতিম মজুমদার ১৯৬৬ থেকে যোগেশ দত্ত মাইম একাডেমি থেকে মাইমের উপর শিক্ষাগ্রহণ শুরু করে৷ ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা মিউজিক কলেজ থেকে স্নাতক হন।

এরপর ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত মারসেল মার্সোর কাছে "ইকোল ইন্টারন্যাশনালি দ্য মাইমোড্রামা দ্য প্যারিস" এ মাইমের উপর উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ করেন৷ তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে মূকাভিনয় নিয়ে গৌরবমণ্ডিত করেছেন বাংলাদেশের পতাকাকে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) দুটি অনুষ্ঠানে প্রথমবারের মতো মূকাভিনয় প্রদর্শন করেন তিনি৷

এছাড়া লন্ডনে একটি ছোট ভিডিও ধারণসহ 'বিবিসিতে' তার একটি কাজ প্রদর্শন করা হয়। ১৯৮৬ সালে মাইমের তত্ত্ব বিষয়ক গবেষণা কাজের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন৷ তিনি ‘নিঃশব্দ কবিতার কবি’ বলে পরিচিত। ১৯৮৭ সালে কলকাতা যোগেশ মাইম একাডেমি থেকে "মাস্টার অব মাইম" উপাধি পান। ১৯৮৮ সালে সারা বিশ্বে বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃতি লাভ করেন।

২০০৯ সালে ফ্রান্সের জাতীয় থিয়েটারের মোলিয়ার অ্যাওয়ার্ড ও ২০১০ সালে একুশে পদক। এবং ২০১১ সালে ফ্রান্স সরকারের শেভালিয়র (নাইট) উপাধিতে ভূষিত হয়। সংগীতশিল্পী,গীতিকার এবং সুরকার শুভাশিস মজুমদার বাপ্পা ১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী বারীণ ও ইলা মজুমদারের ঘর আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেন।

তিনি বিভিন্ন মিউজিকাল টক শো-এর উপস্থাপনা করেছেন। তার ব্যান্ড,দলছুট। তিনি ব্যান্ড এবং নিজের জন্যই গান লেখার পাশাপাশি তিনি অন্যান্য শিল্পীদের জন্যেও গান লিখেছেন। তিনি সঙ্গীত জীবন শুরু করেন গিটারবাদক হিসেবে। একটি সঙ্গীত পরিবারের মধ্যে বেড়ে উঠেন। বাবা-মা দুজনই শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী হওয়ায় তাকে বাড়ির বাইরে গান শিখতে যেতে হয়নি।

তার সঙ্গীদের হাতেখড়ি শুরু হয় পরিবারের কাছ থেকে। সংগীত শিক্ষা জীবনে পিতা সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ বারীন মজুমদারের সঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মণিহার সঙ্গীত একাডেমী-তে তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীদের উপর পাঁচ বছর মেয়াদী একটি কোর্স গ্রহণ করেন। সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ১৯৯৫ সালে তার প্রথম অ্যালবাম তখন ভোর বেলা।

এরপর থেকে তিনি এযাবৎ নয়টি স্টুডিও অ্যালবাম প্রকাশ করেন এবং ২০০-এর বেশি অ্যালবামের প্রযোজনা করেন।সঙ্গীত জীবনে তিনি প্রায় বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পীদের সাথে গান গেয়েছেন। বাপ্পা মজুমদার ২০১৯ সালে সত্তা চলচ্ছিত্রের গানে সূর করার জন্য শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত সুরকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। দাদা-দাদি,বাবা-মা,ভাই-বোনের আশীর্বাদে পরিবারের ঐতিহ্য ধরে রেখে বাপ্পা মজুমদার দেশসেরা খ্যাতিমান সঙ্গীত শিল্পী।

হ্যাপী

×